কোমলমতি শিশুরা যখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, ঠিক তখনই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তারা। ‘শিশুদের জন্য আমরা’ নামে সংগঠনটি দাঁড় করান এলাকার ১৯ প্রতিভাবান তরুণ।
খুলনার উপকূলীয় দাকোপ উপজেলা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবেই পরিচিত। ২০০৭ সাল থেকে এ উপজেলায় ধারাবাহিকভাবে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর মধ্যে আইলার তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড উপজেলার দুটি ইউনিয়ন দীর্ঘ ২১ মাস ডুবে ছিলে পানির নিচে। সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ধ্বংস হয়ে যায় এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। তারই একটি উপজেলার সর্ববৃহৎ সুতারখালী ইউনিয়ন। চারপাশে নদী বেষ্টিত ইউনিয়নের মানচিত্র অব্যাহত নদী ভাঙনের কারণে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে।
আইলার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আজও গড়ে ওঠেনি এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। সুন্দরবনের কূলঘেষা সুতারখালী ইউনিয়নের ৯ নং কালাবগী ওয়ার্ডের একটি বড় অংশ মূল ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন। বন বিভাগের কালাবগী স্টেশনের অপর পাড়ে এ ওয়ার্ডের প্রায় শতভাগ মানুষ বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করে। ভাঙনের ভয়াবহতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এই ওয়ার্ডের ৮০ ভাগ এলাকাকে বাইরে রেখে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিতে বাধ্য হয়েছে।
বলা যায় কালাবগী ৯ নং ওয়ার্ডটি এখন ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ডের বাইরে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এই দ্বীপের বাসিন্দাদের বাসের তৈরি সাঁকো অথবা নৌকা যোগে ইউনিয়নের মূল অংশে আসতে হয়। অনুন্নত এই ওয়ার্ডে শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে আছে পণ্ডিত চন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙনের কারণে বার বার স্থানান্তরিত হওয়া স্কুলটি বর্তমানে ওয়ার্ডের শেষ মাথায় বাজার সংলগ্ন এলাকায়। যে কারণে এখানকার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কোমলমতি শিশুরা নদী পার হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে।
এমন প্রতিকূল পরিবেশে অধিকাংশ পরিবারের শিশু সন্তানেরা ধীরে ধীরে স্কুল বিমুখ হয়ে অসময়ে ঝরে পড়ে। বিষয়টি সকলের চোখের সামনে অথচ শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ধরে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন উদাসীন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা উপজেলা প্রশাসন যখন এই দ্বীপের শিশুদের দায়িত্ব নিচ্ছে না তখন অন্ধ এই দ্বীপে প্রাথমিক শিক্ষার আলোর প্রদীপ জ্বালাতে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন ওরা ১৯ জন।
‘শিশুদের জন্য আমরা’ নামের একটি অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ১৯ যুবক সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ‘আমাদের স্কুল’ নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়ের ঘর নির্মাণ, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠদান সবই চলে তাদের তত্ত্বাবধানে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়মিত ক্লাসে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ জন। ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি স্কুলটি আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।
এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা হলে তারা জানান, শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠন তাদের জন্য এক বিশেষ উপহার। এই প্রচেষ্টা না হলে তাদের সন্তানেরা কোনোভাবেই লেখাপড়ার সুযোগ পেত না।
এলাকার অধিকাংশ অশিক্ষিত যুবকের উদাহরণ তুলে ধরে তারা বলেন, যদি আরও আগে এমন উদ্যোগ নেয়া হত তাহলে হয়ত এদের অনেকেই আজ শিক্ষিত হতে পারত।
স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়ে জানতে চাইলে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের সভাপতি বেলাল হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ফারুক বলেন, কয়েকজন বন্ধু ফেসবুকে তথ্য আদান প্রদানে ভালো কিছু করার প্রবল ইচ্ছে থেকে ২০১৬ সালের ১২ জুন ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে সংগঠনে ১৯ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটিসহ একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে।
তারা জানান, ‘আমাদের স্কুল’ নামের এই স্কুলটি সরকার অনুমোদিত না হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীরা পণ্ডিত চন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত। সারা বছর পাঠদানের পর শিক্ষার্থীদের প্রি টেস্ট পরীক্ষা নেয়া হয়। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষা তারা ওই স্কুলেই দেয়। তাদের লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা।
অর্থের যোগান বিষয়ে তারা বলেন, টাকার জন্য কোনো ভালো কাজ আটকে থাকে না এই বিশ্বাস থেকে সাহস নিয়ে তারা কাজটি শুরু করেন। সংগঠনের সকল সদস্যের নিয়মিত অর্থদান, উপদেষ্টাদের সহায়তা, সর্বোপরি দেশে এবং দেশের বাইরে কিছু শুভাকাঙ্খী আছে যারা প্রতিনিয়ত কার্যক্রমে সাহস, উৎসাহ এবং সকল ধরনের সহযোগিতা করে থাকে।
শিক্ষিকা আম্বিয়া খাতুন বলেন, ‘সীমিত সামর্থ্যের মাঝে শিশুবান্ধব আনন্দঘন পরিবেশে আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করছে। আগামী বার্ষিক পরীক্ষায় এই শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’
শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা নয়, অরাজনৈতিক এবং অসাম্প্রদায়িক এই সংগঠন শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ করে আসছে। ঈদ ও পূজায় শিশু এবং অসহায় বয়স্কদের জন্য নতুন জামা কাপড়, ইফতার এবং ঈদে সেমাই-চিনি বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার দেয়াসহ জনহিতকর অনেক কাজের সাথে তারা সম্পৃক্ত। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এই সংগঠনের কর্ম-তৎপরতায় আরও বেশি উৎসাহ এবং জনকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে নিতে পারে এমন প্রত্যাশা সচেতন মহলের।