কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাজারে হাতপাখার অর্ডার কমে যাওয়া বাসন্তী এবং তার সীমিত আয়ের পরিবার মহা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।
মাগুরা জেলার আরেক কারিগর নিমাই মালাকার। তিনি শোলার (যা ভারতীয় কর্ক নামেও পরিচিত) কাজের জন্য সুপরিচিত। তিনি গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়নুল ফেস্টে অংশ নিয়ে তার কারুকাজ প্রদর্শন করেছিলেন। এর মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করা সত্ত্বেও নিমাই তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য খুব সামান্য উপার্জন করতে পারেন। একটু বাড়তি উপার্জনের জন্য তাকে পূজা ও পহেলা বৈশাখের মতো অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়।
মহামারির প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রায় সব উৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, নিমাইয়ের মতো প্রতিভাবান কারিগররা আর্থিক সংকটের ফলে নিজেদের কারুকাজ চালিয়ে যেতে পারবেন কি না তা নিয়ে ভয়ে আছেন।
মসলিন, জামদানি ও অন্য আরও বিভিন্ন ধরনের কারুকাজের মাধ্যমে প্রাচীন যুগের ঐতিহ্যের গর্বকে ধারণ করা দেশ বাংলাদেশ। যে দেশটি তার হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক কারুশিল্পীদের কাছে ঋণী। যারা বছরের পর বছর ধরে তাদের হৃদয়ে এ ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলছেন।
কারুশিল্পীরা হলেন দেশের প্রতিভাবান ও সূক্ষ্ম দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, যারা তাদের শৈল্পিকতা ও কারুশিল্পের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। কারণ তারা তাদের জীবদ্দশায় কারুশিল্পের প্রতিভাটিকে সম্মান করে অন্য পেশায় যাচ্ছেন না। বরং এর মধ্য দিয়ে আরও দক্ষ হয়ে উঠার জন্য নিজেদের সর্ব্বোচ ত্যাগ দিয়ে চেষ্টা করে যান।
মহামারি কোভিড-১৯ বিশ্ব অর্থনীতি এবং বিশ্বজুড়ে জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। অনেক দেশে শিল্প ও কারুশিল্প খাতও বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে, বাংলাদেশে এর প্রভাবটি মারাত্মক রূপেই পড়েছে। কেননা, ইতোমধ্যে দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে থাকা এসব কারুশিল্পীদের আর্থিক সংকট মোকাবিলার তেমন কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না।
ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহিন খান বলেন, ‘কারুশিল্পীরা না থাকলে দেশীয় ঐতিহ্য বলতে আমাদের একটি পরিচয় থাকবে না। ভূমিহীন, দরিদ্র এসব মানুষেরা বছরের পর বছর ধরে নৈপুণ্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ অনেকগুলো ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। তাই আমাদের এ দক্ষ লোকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করা জন্য হলেও তাদের দেখে রাখতে হবে। বিশেষত চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে এটা আরও বেশি জরুরি।’
চলামান এ সংকটে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা কারুশিল্পী সম্প্রদায়কে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে এফডিসিবি। তাদের এ উদ্যোগে শিল্পী সমাজের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা বয়স্ক এবং দরিদ্ররা রয়েছেন। দেশের হাজার হাজার কারুশিল্পীদের পরিবার এ সংকট মোকাবিলায় সহায়তা চেয়েছেন। এ কারুশিল্পীদের সহায়তা করতে এফডিসিবি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সামর্থ্যবান দাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তাও চাইছে।
দেশের অন্যতম প্রশংসিত ‘মায়াসীর’ ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার ও প্রধান ডিজাইনার মাহিন খান জানান, বর্তমানে তিন মাসের জন্য এ উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে। এর আওতায় নির্বাচিত কয়েকটি বিভাগে সম্পৃক্ত কারুশিল্পীদের পরিবারগুলোকে পাঁচ হাজার টাকা নগদ সহায়তা প্রদান করা হবে। যাতে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে পারেন এবং সাময়িক এ সমস্যার মধ্যে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারেন।
ইউএনবিকে এ উদ্যোগের বিষয়ে বলতে গিয়ে এফডিসিবির সাধারণ সম্পাদক শৈবাল সাহা জানান, ইতোমধ্যে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই কারুশিল্পীরা এ অনুদান পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে- শীতল পাটি শিল্প (বেতের মাদুর কারুশিল্প), হাত পাখা শিল্প (সুতা দিয়ে হাতের তৈরি পাখার সমন্বিত কারুশিল্প), গয়না শিল্প (অলঙ্কার এবং গহনার কারুকাজ), দারু শিল্প (কাঠের তৈরি কারুকাজ), বয়ন শিল্প (হ্যান্ডলুম কারুকাজ), শুচি কর্ম শিল্প (সেলাই কারুশিল্প) এবং মৃৎশিল্প (কাদামাটি ও মৃৎশিল্পের কারুকাজ)।
বাসন্তী ও নিমাইয়ের মতো অনেক কারুশিল্পীকে এফডিসিবির #ADOPTANARTISAN প্রোগ্রামের আওতায় অনুদান দেয়া হয়েছে। আরও অনেক কারুশিল্পী তাদের পরিবার নিয়ে হয়ত মহামারিতে বেঁচে থাকতে পারবেন, যদি সামর্থ্যবানরা অনুদানের হাত বাড়িয়ে তাদের শিল্পশৈলীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
শৈবাল ইউএনবিকে বলেন, ‘বহু বছর ধরে বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গৌরবকে ধরে রেখেছেন যে কারুশিল্পী সম্প্রদায় তাদের সহায়তা, সুরক্ষা এবং সমর্থন করার জন্য আমাদের ফ্যাশন কাউন্সিলের মানবিক এ উদ্যোগে সবাই সহায়তা করতে পারেন।’
এ উদ্যোগের মাধ্যমে যদি কারুশিল্পীরা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচতে পারেন তবে জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে তারা তাদের শৈল্পিক কাজগুলো নিয়ে ভবিষ্যতের প্রদর্শনীতে অংশ নিতে পারবেন।
আগ্রহী দাতারা কারুশিল্পীদের কোনো একটি পরিবারকে এক মাসের জন্য ৫ হাজার, দুই মাসের জন্য ১০ হাজার এবং তিন মাসের জন্য ১৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। অনুদানের টাকা মোবাইল আর্থিক পরিষেবা ০১৭০৭০৬৩৫৩৭ (বিকাশ, এজেন্ট নম্বর) এবং ০১৭৭৭৪৬৮৯৮০ (নগদ, ব্যক্তিগত) এর মাধ্যমে দিতে পারবেন।
চেকে বা আরও তথ্যের জন্য দাতারা ০১৭১৭৩৭৭২৬৪ নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ইভেন্টের মাধ্যমেও উদ্যোগটিতে সহায়তা করা যাবে। যার লিংকটি হলো-
https://www.facebook.com/events/564760910898471/?active_tab=about