গত মঙ্গলবার রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের (বিইউপি) শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। এতে করে ওই এলাকাসহ পুরো রাজধানীতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীদের এ বিক্ষোভ আজও (বুধবার) চলছে।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের জের ধরে টানা কয়েকদিন নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর ঢাকাসহ সারাদেশে রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা।
এ প্রেক্ষিতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও যানজট নিরসনে সরকার অসংখ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সড়ক শৃঙ্খলায় দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি।
গত বছরের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকায় বিশেষ কর্মসূচি নেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু তারপরও কোনো উন্নতি হয়নি।
‘লক্কর-ঝক্কর বাসে বিশৃঙ্খল ট্রাফিক আইন’
সড়ক শৃঙ্খলায় বিভিন্ন প্রচারণাও কোনো কাজে আসছে না। চালক থেকে পথচারী কেউ আইন মানছে না। সড়কে যেন আইন ভাঙার সংষ্কৃতিই চালু হয়েছে। অপরদিকে অল্প সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ দিয়েও মানানো যাচ্ছে না ট্রাফিক আইন।
গত সেপ্টেম্বরে বাস চলার সময় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখা, গাড়ির চালকসহ সংশ্লিষ্টদের ছবি ও ফোন নম্বর ঝুলিয়ে রাখা, গাড়ি ও চালকের লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ রাখা এবং চালক ও যানবাহনের স্টাফদের জন্য মালিকের পক্ষ থেকে মাসিক বেতনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে রাজধানীতে ১২১টি স্থানে বাস থামানোর স্থান নির্ধারণ করে দেয় ডিএমপি।
এরপরও পরিবহন খাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বাসগুলো নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো যাত্রী ওঠানামা করছে, চালক ও সহকারীদের দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি, অসংখ্য আনফিট (চলাচলের অনুপযোগী) যানবাহন সেই সাথে উল্টোপথে যাত্রা অব্যাহত আছে এখনো।
বাসগুলো এখনো রাস্তায় নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লিপ্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা চালক ও সহকারীদের মাসিক ভিত্তিতে বেতন না দিয়ে দৈনিক ভিত্তিতে বেতন দেয়াকে দায়ি করেছেন।
কাগজ-কলেমে সীমাবদ্ধ উদ্যোগ
রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সড়ক বিশৃঙ্খলা রোধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
ও্ই কমিটির সদস্য ও প্রকল্প পরামর্শক ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘শৃঙ্খলা ফেরাতে মাত্র ছয়টি কোম্পানির অধীনে ৮ থেকে ৯ হাজার বাস চলাচল করার অনুমোদন দেয়া হবে।’
‘তবে বর্তমান বহরের থাকা বাসগুলোর সাথে পরবর্তীতে আরও সাড়ে ৪ হাজার নতুন বাস যোগ করা হবে’, বলেন তিনি।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাসের সকল স্টাফদের (চালক ও সহকারী) নিয়োগ দেয়া হবে জানিয়ে সালেহ বলেন, নতুন বাস ক্রয়ের জন্য পরিবহন মালিকদের ৫/৬ শতাংশ হারে ঋণ দেয়া হবে।
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী অনেক বাসই লক্কর ঝক্কর বা আনফিট। তবে তার সিঠিক সংখ্যা জানা নেই।
ফলে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়মের মধ্যে আনতে এবং সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে সাবেক মন্ত্রী ও পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের অপর একটি কমিটি গঠন করা হয়।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বলেন, ওই কমিটিকে ১৪ দিনের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিতে বলা হয়েছে।
রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া হবে, সে সময় মন্ত্রী এমন কথা জানালেও সেই কমিটির প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি।
‘মনোজগতের পরিবর্তন’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার ১৯৪টি রুটে ২০০টিরও বেশি বাস কোম্পানির বাস চলাচল করে। তাদের মধ্যে সাতটি কোম্পানির শতাধিক বাস আছে। যারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটায়।
অন্য কোনো দেশের পরিবহন খাতে এতগুলো বাস কোম্পানি নেই জানিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে অল্প সংখ্যক কোম্পানিকে বাস পরিচালনার অনুমতি দিতে হবে।
অতিরিক্ত আয়ের জন্য পরিবহন কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা যখন রাস্তায় প্রতিযোগিতা শুরু করে তখনই মড়কে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় ও দুর্ঘটনা ঘটে বলেও মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ।
জনগণ ও পরিবহন চালকদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে না উঠলে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসবে না জানিয়ে অধ্যাপক হক বলেন, ‘পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।’