বিশেষজ্ঞদের মতে, যে দেশে স্বাক্ষরতার হার এখনো ৮০ শতাংশের অনেক নিচে সেখানে বইমেলা, বই পড়ার প্রতি উৎসাহ ও উপহার হিসেবে বই দেয়ার প্রচলন ধীরে ধীরে বাড়ছে।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, বইমেলাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ যুগেও পাঠক ও লেখক বাড়ানোর পাশাপাশি জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তারা দেশে মানসম্পন্ন পাঠক তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা ও প্রকাশনায় নজর দেয়া এবং বিভিন্ন বইমেলায় অংশ নেয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বই ক্রেতাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন সারাদেশে প্রতিবছর একুশে বইমেলা ছাড়াও আরও ৪০টির অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ গফুর হোসেন জানান, একুশে বইমেলার পর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর বিভিন্ন বিভাগে ১২টি বইমেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে।
এছাড়া, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি এবং অন্যান্য সংস্থা বছরব্যাপী বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৩০টি বইমেলার আয়োজন করবে। ‘মানুষের অভিভূত সাড়াদানে বইমেলার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে,’ বলেন তিনি।
রিদম প্রকাশনা সংস্থার মালিক গফুর হোসেন আরও জানান, দেশের প্রখ্যাত প্রকাশনীগুলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, জাপান, ভারত ও তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের বইমেলাতে অংশ নেয়। ‘গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বইমেলায় প্রায় ২০টি বাংলাদেশি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছিল। আমাদের প্রধান প্রকাশনীগুলো ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অনেক বইমেলাতেও অংশ নেয়।’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, এটা উৎসাহজনক যে দেশের পাঠক ও লেখকের সংখ্যা বাড়ছে। ‘প্রতি বছরই একুশে বইমেলায় বইপ্রেমীদের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে নিয়মিতভাবে বই বিক্রির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভালো সাড়া পাওয়ায় দেশে আরও অনেক বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ যে পাঠক ও লেখকের সংখ্যা বাড়ছে।’
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বইমেলাগুলো বইয়ের প্রচার-প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে, যা পাঠক তৈরির জন্য খুব প্রয়োজন। ‘এটা খুব ইতিবাচক যে বইমেলা দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। একই সাথে সব নগর ও জেলা শহরে আমাদের আরও বইয়ের দোকান ও লাইব্রেরি দরকার।’
এ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আরও বলেন, মানসম্পন্ন পাঠক তৈরির জন্য গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি বিস্তৃত বিভিন্ন বিষয় ও গবেষণা-ভিত্তিক বইয়ের প্রয়োজন। ‘এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে ভালো প্রকাশনা থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ব্যাপারে নজর দেয় না।’
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এটা ভালো লক্ষণ যে ফেসবুক ও টেলিভিশন চ্যানেলের বিপুল জনপ্রিয়তার মাঝেও মানুষ বিভিন্ন বইমেলায় যাচ্ছে এবং বই কিনছে।
‘বই মানুষকে ইতিবাচক চিন্তা করতে এবং চিন্তার পরিধি ও গভীরতা বাড়াতে সাহায্য করে। যেখানে টেলিভিশনে হাল্কা অনুষ্ঠান দেখা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিম্নমান ও বাজে বিষয়বস্তুর লেখা পড়ার মাধ্যমে মানুষের মাঝে অগভীর চিন্তা গড়ে উঠে,’ যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপকের মতে, শিশুদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস পড়ায় উৎসাহ দেয়া দরকার। ‘তাদের বই পড়ায় উৎসাহ দিতে জন্মদিনসহ বিভিন্ন উপলক্ষে উপহার হিসেবে বই দেয়া উচিত।’
এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, দেশে অনেক মানসম্পন্ন প্রকাশনী সংস্থা থাকলেও এবং মুদ্রণ ব্যবসা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও এ খাত এখনো শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ‘এটাকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এর উন্নয়নে সরকারকে আরও বেশি কিছু করা উচিত।’
হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, মুদ্রণ শিল্পের জন্য এটা ভালো সংবাদ যে বইমেলা দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ‘কিন্তু এখন আমাদের সময় এসেছে বইয়ের সংখ্যার চেয়ে মানের প্রতি নজর দেয়া। আমাদের অবশ্যই সঠিক তথ্য ও আদর্শ ভাষায় মানসম্পন্ন বই পাঠকদের দিতে হবে। শিক্ষিত জাতি গড়ার জন্য মানসম্পন্ন বই উৎপাদন জরুরি।’