সিলেট, ১৩ অক্টোবর (ইউএনবি)- সড়ক, বিশুদ্ধ পানি ও সরকারি বিভিন্ন সহায়তাবঞ্চিত সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার একটি গ্রামের নাম শ্রীমুখ। এর মোট জনসংখ্যা পাঁচজন। জনসংখ্যার তিনজনই নারী ও একজন শিশু কন্যা। আর কর্তা পুরুষ সদস্য- তিনি সৌদি প্রবাসী। সর্বশেষ চার বছর আগে বিদেশ থেকে এসে আবার ফিরে গেছেন ওই গ্রামের একমাত্র পুরুষ সদস্যটি।
প্রায় দুই একরের শ্রীমুখ গ্রামটি বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। সকল সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত গ্রামটি যেন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। গ্রামে প্রবেশের নেই কোনো রাস্তা। পাশ্ববর্তী গ্রামের একটি বাড়ির ওপর দিয়ে শ্রীমুখ গ্রামে প্রবেশ করতে হয়। যাতায়াতের জন্য লোকজনের এটিই একমাত্র পথ। শুকনা মৌসুমে গ্রামটিতে যাতায়াত করা গেলেও বর্ষা মৌসুমে শ্রীমুখ গ্রামে প্রবেশ করা খুবই কষ্টকর। তখন গ্রামটি যেন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়।
শ্রীমুখ গ্রামে আফতাব আলীর বাড়ির উঠানে একমাত্র নলকূপটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল। ওই গ্রামের নারীরা অন্য গ্রামের বাড়ি থেকে নলকূপের পানি এনে খেতে হয়। অথবা তাদের নিজ বাড়ির পুকুরের পানি পান করতে হয়। শ্রীমুখ গ্রামে মাত্র পাঁচজন সদস্য হওয়ায় তারা পার্শ্ববর্তী পশ্চিম নোয়াগাঁও গ্রামের পঞ্চায়েতের সাথে রয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার অমিতাভ পরাগ তালুকদার গত দু’বছর ওই উপজেলার প্রধান প্রশাসনিক পদে কর্মরত। অথচ তার প্রশাসনিক এলাকায় এ ধরনের একটি গ্রাম আছে তা জানা ছিল না বলে তিনি ইউএনবিকে জানান।
অমিতাভ পরাগ তালুকদার বলেন, পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি গ্রাম এই উপজেলায় রয়েছে শুনেছি সবেমাত্র। খোঁজ নিয়ে এ গ্রাম সম্পর্কে মন্তব্য করবেন বলে তিনি জানান। ওই বাড়ির বিকল নলকুপটি মেরামত করার আশ্বাসও দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
জানা গেছে, সরকারী গেজেটভূক্ত এই গ্রামটিতে স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বসবাস করে আসছেন একটিমাত্র পরিবার। পুরুষ কর্তাটি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় তিন নারী সদস্য ওই গ্রামের ভোটার।
এক সময়ে ওই গ্রামটি (শ্রীমুখ) একটি হিন্দু পরিবার বসবাস করতেন। ১৯৬৪ সালে রায়টের (দাঙ্গা) সময় সংখ্যালঘু পরিবার তাদের বাড়িটি বর্তমান বাসিন্দা আফতাব আলীর পূর্ব পুরুষের কাছে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান। এরপর থেকে টিনসেটের একটি মাটির ঘরে বসবাস করছেন আফতাফ আলীর পরিবার।
গ্রামটিতে বসবাসকারী নারীরা হলেন- রাহিমা বেগম (৩৫), দিলারা বেগম (৪০), আগুরা বেগম (৪৩) ও সুমাইয়া আক্তার তাহিনা (৮)।
গ্রামের একমাত্র পুরুষ আফতাব আলী সৌদি আরবে রয়েছেন। গত ৪ বছর পূর্বে তিনি দেশে এসেছিলেন বলে নারীরা জানান।
তবে আফতাব আলীর বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ হওয়ায় প্রবাসে তেমন কোনো কাজকর্ম করতে পারছেন না বলে তারা জানান।
গ্রামের বাসিন্দা রাহিমা বেগম বলেন, আমাদের বাড়ি থেকে বের হতে কোনো রাস্তা নেই। অন্যের জায়গার ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। রাস্তা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে আমার একমাত্র মেয়ে বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। আমরা অনেক কষ্টের মধ্যে জীবন-যাপন করছি। আমার স্বামী প্রবাসে থাকলেও সেখানে তিনি তেমন আয় করতে পারছেন না। অনেক সময় আমাদের অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হয়। বাড়িতে শুধু নারীরা বসবাস করি।
তিনি ইউএনবির এই প্রতিবেদককে বলেন, এর আগে কখনো তাদের গ্রামে কোনো সংবাদকর্মী আসেননি। খবরও কেউ নেননি। গ্রামে এই প্রথম আপনারা এসেছেন। আমাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য একটি রাস্তার খুবই প্রয়োজন। তাই একটি রাস্তার জন্য সরকারের প্রতি তিনি জোর দাবি জানান।
রহিমা আরও বলেন, সরকারি কোনো সহায়তা তারা পায় না। গ্রামে বিদ্যুৎ থাকলেও মিটার দেখে বিদ্যুৎ বিল দেয়া হয় না। কারণ বাড়িতে প্রবেশের কোনো রাস্তা না থাকায় বিদ্যুৎ অফিস কর্মীরা আসতে অনিহা প্রকাশ করেন। ফলে মনগড়া বিদ্যুৎ বিল দিয়ে যান বলে তারা অভিযোগ করেন।
খাজাঞ্চী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার গিয়াস উদ্দিন বলেন, ওই গ্রামের নিজস্ব কোনো জায়গা না থাকায় রাস্তা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অন্য গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে শ্রীমুখ গ্রামের বাসিন্দাদের রাস্তার বিষয়টি সুরাহ করবেন বলে জানান।