তারা বলেন, নির্মাণ কাজ, নির্মাণাধীন সড়ক এবং অন্যান্য অনেক উৎস থেকে অবারিত ধুলা নির্গমনের ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এটি এখন পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং প্রধান জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে পরিণত হয়েছে।
শহরজুড়ে ধুলা দূষণ কমাতে কার্যকর কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ইউএনবি প্রতিবেদকরা দেখতে পান, মনিটরিং ও আইন প্রয়োগের অভাব এবং অপরিকল্পিতভাবে ভবন, রাস্তাঘাট এবং ফুটপাতের নির্মাণের কারণে সর্বত্র ধুলা উড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সমন্বিত প্রচেষ্টার সাথে ধুলো দূষণ কমাতে তারা শিগগিরই সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং সংস্থার সাথে বৈঠক করবে।
চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দূষণের দিক দিয়ে ঢাকার বাতাসের মান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম।
এর আগে ২০১৬ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণজনিত রোগের কারণে বছরে ৩৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি মারা যায়।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এমেরিটাস আইনুন নিশাত বলেন, এখানে ধুলা দূষণ ক্রমেই বাড়ছে। শুষ্ক মৌসুমের আগমনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে যাচ্ছে। অবিলম্বে ধুলা দূষণ কমানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হলে তা জনস্বাস্থ্যে গুরুতর প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের সমন্বিত ভূমিকা পালন করলে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, বিশেষ করে ধুলার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বলেন, ইট ভাটা, যানবাহন এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণে দূষণ বন্ধে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইনুন নিশাত মনে করেন, ধুলা দূষণ কমানোর জন্য প্রতিদিন বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে রাজধানীর রাস্তায় পানি ছিটানো প্রয়োজন। আপনি যদি শহরের বাড়িতে বা অফিসের কক্ষগুলোর দিকে তাকান, তবে ধুলোর স্তর দেখতে পাবেন। যা পরে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে।
এছাড়াও তিনি বলেন, সড়ক ও ভবন নির্মাণের সময় নির্মাতা ও ঠিকাদারদের ওপর কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা উচিত যাতে তারা আইনকানুন মেনে চলে এবং নির্মাণ স্থানগুলোর ওপর আচ্ছাদন (কভার) দিয়ে রাখে এবং ধুলা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি ছিটায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক এম এ মতিন বলেন, সুশাসন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, কর্ম পরিকল্পনা, উদ্যোগ এবং আইন প্রয়োগের অভাবের কারণে ধুলা দূষণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি মনে করি সরকার এবং তার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ধুলা দূষণ মোকাবেলার ব্যাপারে আন্তরিক নয়।
তিনি বলেন, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে মধ্য অক্টোবরে থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
‘সরকারের উন্নয়নের কার্যক্রমগুলো দ্রুতগতিতে বেড়েছে, দূষণও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা উন্নয়নের বিপক্ষে নই, তবে পরিবেশকে রক্ষা করে এটি করতে হবে,’ বলেন মতিন।
তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই সঠিকভাবে রাস্তা পরিষ্কার করতে পারে না এবং যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারে না, ফলে ধুলা দূষণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বিভিন্ন শিল্প কারখানা, যানবাহন, জাহাজ এবং নিকটবর্তী ইট ভাটা থেকে দূষণ ও কালো ধোয়া নির্গমন বন্ধ করারও কোনো ব্যবস্থা নেই।
শহরের রাস্তাগুলো পরিষ্কার করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নির্মাণ কাজ চলাকালে পানি ছিটানো, নির্মাণ সামগ্রী ও স্থানগুলো আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে রাখা এবং আইন প্রয়োগ ও যথাযথ মনিটরিংয়ের পরামর্শ দেন বাপার সাধারণ সম্পাদক।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, বায়ু দূষণের পেছনে পাঁচটি প্রধান কারণ হচ্ছে- ইট ভাটা, নির্মাণকাজ, রাস্তা খনন, ভবন নির্মাণ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং বর্জ্য ও সিমেন্ট।
তিনি বলেন, রাজউক, দুই সিটি করপোরেশন, এলজিইডি, পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট, হাউজিং কর্তৃপক্ষ, তিতাস গ্যাস, রিয়েল এস্টেট এন্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (রিহাব) বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। যাতে ভবন, সড়ক নির্মাণ এবং অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধুলা দূষণ প্রতিরোধের জন্য নির্মাতা ও ঠিকাদারদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বলা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আরও বলেন, ধুলা দূষণ কমাতে যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তাদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ ও সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক।
এ বিষয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে ভবন ও সড়ক নির্মাণের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণ বন্ধে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কাজ করছে।
মন্ত্রী বলেন, নির্মাণ কাজের সময় পরিবেশ রক্ষার জন্য বিল্ডিং কোড ও নিয়ম থাকলেও সেসব মেনে চলা হয় না। ধুলা দূষণ বন্ধের জন্য আমরা মনিটরিং ব্যবস্থা বৃদ্ধি করব।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ধুলা দূষণ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। মানুষ এখন ধুলা দূষণের কারণে ফুসফুস সমস্যা, ক্যানসার, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার মতো গুরুতর রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইএনটি (নাক, কান, গলা) বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ ইমরুল হক জানান, ক্রমবর্ধমান ধুলা দূষণের কারণে শহরে হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের রোগ, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুস ক্যানসার এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের রোগীদের সংখ্যা বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।