তারা বলছেন, দেশে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব ক্রমবর্ধমান থাকায় সম্প্রদায় সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) রোধে কারখানা, মার্কেট বা বাজার পুনরায় চালু করার পরিবর্তে অন্তত ঈদুল ফিতর পর্যন্ত লকডাউন কঠোরভাবে অব্যাহত রাখতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এখনই লকডাউন শিথিল করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরায় চালু করার অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত যথার্থ নয়, কারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তারা আরও বলছেন যে, জীবিকা ও অর্থনীতি সচল রাখার জন্য মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির সাথে আপস করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান শনিবার বলেন, অর্থনীতি বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে দেশের রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো অবশ্যই ধীরে ধীরে আবার চালু করতে হবে।
শনিবার এফবিসিসিআই আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা সুইডেন মডেল আমাদের সামনে রেখেছি, তারা লকডাউন প্রয়োগ করেনি। চীনের উহানে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ চলছে। জার্মানি ও ফ্রান্স এখনও ভুগছে, নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, তবে তারা এরইমধ্যে তাদের কারখানা চালু করছেন।’
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন খারাপের দিকে যাওয়ার সময় কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত যথার্থ নয়।’
‘আমরা এখনও লকডাউন যথাযথভাবে প্রয়োগ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মানুষজনকে বাধ্য করতে পারিনি। মানুষ এখনও এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, আমরা যদি কারখানাগুলো আবার চালু করি, আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে,’ সতর্ক করেন তিনি।
আরও পড়ুন: দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় ধাক্কা আসছে, বলছেন অর্থনীতিবিদরা
বিএসএমএমইউ উপাচার্য আরও বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর করোনাভাইরাসের হটস্পট (সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত এলাকা), যেখানে বেশিরভাগ কারখানা অবস্থিত। আমরা যদি এসব এলাকার শ্রমিকদের কারখানায় কাজ করার অনুমতি দেই, তবে ভাইরাসটি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়বে। করোনা আক্রান্ত কর্মীর মাধ্যমে অন্য সব সহকর্মীদের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে।
ড. কনক উল্লেখ করেন, ‘সম্প্রতি করোনার কোনো উপসর্গ ছাড়াই এ রোগে আক্রন্তের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি আমাদের অনেক ডাক্তার ও নার্স সতর্ক থাকা সত্ত্বেও এবং মাস্ক ও পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) পরেও করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন। সেজন্য আমরা যদি আমাদের কর্মীদের কারখানায় কাজ করার অনুমতি দেই, তাহলে আমরা দেশের জন্য একটি বিরাট বিপদ ডেকে আনব। করোনার সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে আমরা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, যদিও কারখানার মালিকরা বলছেন যে তারা তাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। তবে তারা তা পুরোপুরি করতে পারবে না।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) অধ্যক্ষ প্রফেসর খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় কারখানাগুলো আবার চালু হলে পুরো জাতি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সুইডেন মডেল নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু দুই দেশের পরিস্থিতি এক নয়। সুইডেনের মানুষ আইন মেনে চলে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে, অনেক ভালো জীবনযাপন করে এবং তাদের স্বাস্থ্যসেবা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত।
সুইডেন মডেল নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা এখানে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ঘিঞ্জি কক্ষে থাকেন। তারা স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে কম সচেতন। যখন তারা একসাথে কাজ করবে, তখন তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সম্ভাবনাও কম। দুই দেশের মানুষের সংস্কৃতি ও আচরণের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি সুইডেনের মডেল এখানে কাজে লাগবে না। আমাদের নিজেদের পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।’
‘বর্তমানে অনেক মানুষ তাদের করোনার উপসর্গ গোপন করে রাখছেন। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত রোগীর কোনো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে আমরা কারখানাগুলো পুনরায় চালু করা বা লকডাউন শিথিল করাতে সমর্থন জানাতে পারি না। বরং আমরা কঠোরভাবে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছি,’ যোগ করেন তিনি।
ঢামেক অধ্যক্ষ আরও বলেন, তারা দেশের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং শাটডাউনের ফলে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের উপার্জনের উপায় নিয়েও উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমরা অর্থনীতি রক্ষার জন্য মানুষকে মৃত্যু বা বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী যখন তাদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তখন কেন আমরা মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে এত মরিয়া হয়ে উঠছি? এটি অযৌক্তিক ও অনুচিত সিদ্ধান্ত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব এখনও ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে অনেক পোশাক কারখানা আবার চালু হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। আমি মনে করি এটি একটি ‘অপরিপক্ক’ সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং পোশাক কারখানার পরিবেশ অনুযায়ী, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি বা শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যদি কর্মীদের যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা না যায় তবে আমরা একটি গুরুতর সমস্যায় পড়ব। সুতরাং, আমি মনে করি কারখানাগুলো পুনরায় খোলার জন্য আমাদের আরও বেশি সময় নেয়া উচিত।
তিনি উল্লেখ করেন, লকডাউনের কারণে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মধ্যে রয়েছে। তবে অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য মানুষের জীবনের সাথে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা আরও এক মাস বন্ধ রাখলে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তবে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মির্জা আজিজুল বলেন, সরকার তখনই কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার অনুমতি দিতে পারে, যখন করোনাভাইরাস মহামারির প্রাদুর্ভাব হ্রাসের প্রবণতা দেখা যাবে।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত না পেয়ে কোনো প্রকার কলকারখানা আবার চালু করা বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত হবে না। কিছু দেশ কেবল তখনই লকডাউনটি শিথিল করছে, যখন ভাইরাসের সংক্রমণ হ্রাস পাচ্ছে। সুতরাং পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লকডাউন শিথিল করা উচিত নয়।
‘ভাইরাসের সংক্রমণ কমে যাওয়ার পরে, সরকারকে প্রথমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধিমালা তৈরি করতে হবে। এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার ও গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে কোন কারখানাগুলো প্রথমে চালু করা উচিত সে বিষয় নির্ধারণ করতে হবে,’ উল্লেখ করেন তিনি।
এই ধরনের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দেশ ও ব্যবসায়ীদের কত সময় পর্যন্ত বহন করতে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজ বলেন, ‘এটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা এবং প্রতিটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব সকলকেই বহন করতে হবে। এটি জীবন ও জীবিকার সাথে সাংঘর্ষিক। আমাদের জীবনকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। জীবন ছাড়া জীবিকার মূল্য কী?’
বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্ডার বাতিল করেছে এবং এখন সীমিত আকারে কারখানাগুলো পুনরায় চালু করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা কঠোর স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখছি। আমরা বিএসএমএমইউ উপাচার্যকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম যাতে ফলোআপ করার জন্য আমাদেরকে একজন বিশেষজ্ঞ দেন।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সোমবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫২ জনে। এছাড়া এ পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৯১৩ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সরকার।
চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনে (বিডিএফ) তথ্যমতে, রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার সময় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রবিবার পর্যন্ত ৩৭৩ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই ২৮৩ জন এবং অন্য ছয় বিভাগে ৯০ জন আক্রান্ত হয়েছেন।