দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা বলছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্প আগে কখনও এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি কর্মী হারায়নি বা এত কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। সাংবাদিকদের জীবন ও জীবিকার ওপর করোনার হানা অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে তৈরি পোশাক খাত ও দেশের অন্যদের মতো এ খাতেও সরকারের উচিত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা বা একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা যাতে এ খারাপ সময়ে গণমাধ্যমগুলো তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক সাংবাদিক গোষ্ঠী ‘আওয়ার মিডিয়া, আওয়ার রাইটস’ এর মতে, গত ৫ আগস্টের মধ্যে দেশের কমপক্ষে ১৬ জন গণমাধ্যম কর্মী করোনাভাইরাসের কারণে মারা গেছেন। এছাড়াও করোনার লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন আরও ১০ জন। আর গত ১৩ জুলাই কোভিড-১৯-এর কাছে হার মেনে পরপারে চলে যান জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভির মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল।
এ সময়ের মধ্যে সারা দেশে ১৬২টি জাতীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠোনের ৬৯৭ জন কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৩৯১ জন এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সেরে উঠেছেন।
গত ২৮ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাংলা দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবির খোকন (৪৬)। সাংবাদিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বাকি ১৫ জন হলেন- প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, এনটিভির প্রোগ্রাম হেড মোস্তফা কামাল সৈয়দ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বার্তা সম্পাদক আব্দুল্লাহ এম হাসান, পত্রিকাটির কক্সবাজার প্রতিনিধি আব্দুল মোনায়েম খান, বগুড়ার দৈনিক উত্তরকোণ পত্রিকার সম্পাদক মোজাম্মেল হক, দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার চান্দিনা (কুমিল্লা) প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফা, যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক নওয়াপাড়া পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক বেলাল হোসেন, বগুড়ার আঞ্চলিক সাপ্তাহিক হাতিয়ারের নির্বাহী সম্পাদক সাইদুজ্জামান, সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সম্পাদক খন্দকার মোজাম্মেল হোসেন, সপ্তাহিক উত্তমাশার সম্পাদক খন্দকার ইকরামুল হক, গোপলগঞ্জের স্থানীয় পাক্ষিক মকসুদপুর পত্রিকার সংবাদকর্মী এম ওমর আলী, ঝিনাইদাহ প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান, মংয়মসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাহান পত্রিকার সম্পাদক রেবেকা ইয়াসমীন, এটিএন বাংলার অর্থ ও হিসাব বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহসান হাবীব ও দৈনিক জবাবদিহির সহকারী সার্কুলেশনে ম্যানেজার শেখ বারিউজ্জামান।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মইনুল আলম জানান, বিভিন্ন রোগে ১০ মার্চ থেকে ২৯ জুলাইয়ের মধ্যে প্রেস ক্লাবের ১৪ জন সদস্য মারা গেছেন।
তারা হলেন- কাজী শামসুল হুদা (২৯ জুলাই), ফজলুন নাজিমা খান (২৮ জুলাই), আবদুল্লাহ এম হাসান (১৭ জুলাই), একেএম রশিদ উন নবী বাবু (৯ জুলাই), ডিপি বড়ুয়া (৮ জুলাই), ফারুক কাজী (৩ জুলাই), খন্দকার মোজাম্মেল হক (২৯ জুন), মাসুক চৌধুরী (২৪ জুন), সহযোগী সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন (৬ জুন), আসলাম রহমান (৭ মে), সাংবাদিক খন্দকার মহিতুল ইসলাম (২৯ এপ্রিল), আবু জাফর পান্না (১৭ এপ্রিল), রওশনুজ্জামান (৮ এপ্রিল) এবং সহযোগী সদস্য আহসান হামিদ (১০ মার্চ)।
আওয়ার মিডিয়া, আওয়ার রাইটসের সমন্বয়কারী আহমেদ ফয়েজের সাথে কথা হলে তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘করোনায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রাণহানি ও সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেশি। সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। তাদের দেয়া তথ্যানুসারে, করোনায় হতাহত সাংবাদিকদের সংখ্যা শুধুমাত্র পেরুতেই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।’
তিনি বলেন, দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরে ছয় শতাধিক সাংবাদিক তাদের চাকরি হারিয়েছেন এবং এ সময়ের মধ্যে কমপক্ষে চার হাজার সাংবাদিক বিভিন্নভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকর্মী ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর মতো প্রথম সারির পেশাদারদের থেকে সাংবাদিকরা কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই।
তিনি বলেন, ‘মহামারির এ সংকটময় সময়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য গণ্যমাধ্যম থেকে মানুষ যেন সঠিক তথ্য এবং বার্তা পায়। সঠিক তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি, গণমাধ্যম মানুষকে শিক্ষিত করছে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করছে। তবে, দুর্ভাগ্যক্রমে, গণমাধ্যমে রাষ্ট্রের যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছে না। চিকিৎসক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সংক্রামিত হলে চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা ও অর্থ পাচ্ছেন। সেবা দিতে গিয়ে তারা মারা গেলে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। তবে, সাংবাদিকরা এ ক্ষেত্রে অবহেলিত।’
ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান বলেন, করোনায় মারা যাওয়া সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্র থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে শুধু সাংবাদিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনহানিই ঘটছে না, তাদের জীবিকার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে। অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে ও কিছু কিছু বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতির কারণে আমাদের অনেক সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েছেন।’
ইকবাল সোবহান বলেন, আয় কমে যাওয়ায় প্রায় সব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানই লড়াই করে টিকে আছে। মহামারির মারাত্মক প্রভাবে গণমাধ্যম শিল্প বিশাল সংকটে পড়েছে এবং বিলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছে। এমনকি, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কছে পাওনা বিজ্ঞাপনের বিলও পাচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে এ বিলগুলো পরিশোধ করে দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘কিছু সহায়তা পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে বাঁচতে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। তৈরি পোশাক খাতের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য মাত্র দুই শতাংশ সুদ হার ঋণ পাচ্ছেন। মূলধারার গণমাধ্যমের মালিকরা কেন তাদের সাংবাদিকদের বেতন দেয়ার জন্য এ সুবিধা পাবেন না? দেশ ও সমাজে আমাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে গণমাধ্যমকে সহায়তা করার জন্য একটি বিশেষ তহবিল তৈরি করা যেতে পারে।’
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, ‘সংবাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা সংক্রামিত হচ্ছেন এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে মারাও গেছেন।’
এছাড়াও তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব এ শিল্পে মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে। সার্কুলেশন এবং বিজ্ঞাপন উভয়ই মারত্মকভাবে কমে এসেছে। কিছু কিছু গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে, আবার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ছাঁটাই করেছে এবং কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন দেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। কেউ কেউ সংবাদপত্র ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছেন এবং অনেকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পত্রিকার পাতার সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছেন।
দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘গণমাধ্যম শিল্পের জন্য এ অত্যন্ত কঠিন সময়, অতীতে কখনও এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি। কখন ও কীভাবে আমরা এ সমস্যা পেরিয়ে যাব তা কারোই জানা নেই।’
তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে সরকার বিভিন্ন খাতের জন্য উদ্দীপনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তবে গণমাধ্যম খাত এ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকার কয়েকজন সাংবাদিককে কিছু সহায়তা দিলেও গণমাধ্যম খাতের অস্তিত্ব রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি বলেন, সরকারের উচিত অবিলম্বে গণমাধ্যম শিল্পের জন্য একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা। গণমাধ্যম মালিকদের তাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থাও করতে পারে।
সাইফুল আলম আরও বলেন, ‘গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখতে এবং সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন দেয়ার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া দরকার। আমি মনে করি, তথ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক, সাংবাদিক প্রতিনিধি, বিএফইউজে ও ডিইউজেসহ একটি ফ্রেমওর্য়াক তৈরির কাজ করা, যাতে দেশ ও সমাজের স্বার্থে সংগ্রামী গণমাধ্যম শিল্পকে বাঁচানো যায়।’