খুলনা, ২২ অক্টোবর (ইউএনবি) – একদিকে ভয়াবহ দূষণ, অন্যদিকে একের পর এক দখলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে খুলনা মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি নদী। নদীগুলো হলো- রূপসা, ভৈরব ও কাজীবাছা। এছাড়া ময়ূর নদী চলে গেছে খুলনা মহানগরীর বুক চিরে। নগরীতে এখন এই নদীটির অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে।
রূপসা ও ভৈরবের দুই তীরে রয়েছে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে মিশছে। ফলে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। রাসায়নিক বর্জ্য, মহানগরী থেকে নিসৃত বর্জ্যসহ মানব বর্জ্য বিষাক্ত করে তুলেছে নদীগুলো। পাশাপাশি চলছে দখলের মহোৎসব। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীগুলো দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভূমিদস্যু ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় নদীর পাড় গিলে খাচ্ছে এসব ভূমিদস্যুরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে রুপসা, ভৈরব নদীর পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা। অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় জলজ প্রাণিও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অবশ্য ময়ূর নদীর জলজ প্রাণি একেবারেই বিলুপ্তির পথে বলছেন পর্যবেক্ষকরা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম রাকিব উদ্দিন বলেন, খুলনা অঞ্চলের নদীগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প কারখানা। এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্জ্য এবং মহানগরীর পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতাই খুলনার নদীগুলোর দূষণের অন্যতম কারণ।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, শহরের মধ্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোল ঘেষে গড়ে ওঠা ময়ূর নদীকে তো এখন খালও বলা যায় না। নদীটির অস্তিত্ব পুরোপুরি বিপন্ন। যার প্রধান কারণ নগরীর ড্রেনগুলো থেকে বর্জ্য নিষ্কাশনসহ নদীপাড় অবৈধ দখলে চলে যাওয়া।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, খুলনা বিভাগীয় শহর হলেও এখানে নেই কোনো নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটও।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, প্রতিমাসে পরিবেশ অধিদপ্তরের কেমিস্ট শাখা থেকে খুলনা মহানগরী এলাকার নদীগুলোর পানি পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায় রূপসা, কাজিবাছা ও ভৈরব নদের পানির লবণাক্ততা ও অক্সিজেনের পরিমাণ কিছুটা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ময়ূর নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ অত্যধিক কম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট মো. কামরুজ্জামান সরকার বলেন, নদীর পানিতে সাড়ে ৪ মিলিগ্রামের ওপরে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা থাকতে হবে। খুলনার রূপসা, ভৈরব ও কাজীবাছা নদীতে খুব বেশি অস্বাভাবিক না থাকলেও ময়ূর নদীর দ্রবীভূত অক্সিজেনে মাত্রা অস্বাভাবিক হারে কম।
তিনি জানান, পানি প্রবাহের মাত্রা কমে গেলে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। গত আগস্ট মাসের গবেষণায় দেখা যায়, রূপসা নদীতে ৫.৩ মিলিগ্রাম, ভৈরব নদী ৫.৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত অক্সিজেনের মাত্রা থাকলেও ময়ূর নদী দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র ১.২।
সংশ্লিষ্ট একাদিক সূত্র জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়া কারখানার বর্জ্য শোধন করে রূপসা নদীতে ফেলার নিয়ম থাকলেও খরচ বাঁচাতে অনেক প্রতিষ্ঠানই সে নিয়ম মানছে না। ফলে মাছ ও জলজ প্রাণির স্বাভাবিক বেঁচে থাকার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি মৎস্য পোনার নার্সারি গ্রাউন্ড ধ্বংস হচ্ছে।
এছাড়া ভৈরব ও রূপসার দুই তীরে রয়েছে বেশ কয়েকটি পাটকল। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যও মিশে যাচ্ছে নদীর পানিতে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ম্যাচ ফ্যাক্টরির রাসায়নিক বর্জ্যও নদীতে ফেলার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, কেসিসির ২২টি খাল ও কয়েকশ’ ড্রেনের পানি কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি গড়িয়ে পড়ছে নদীতে। এছাড়া নদী তীরে রয়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত পায়খানা। এসব ঝুলন্ত পায়খানা থেকে নির্গত মানব বর্জ্য, শত শত ড্রেন ও নালা-নর্দমা থেকে বেয়ে আসা ময়লা-আবর্জনা বিষাক্ত করে তুলছে নদীর পানিকে।
অপরদিকে ময়ূর ও রূপসা, কাজিবাছা ও ভৈরব নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে ওঠেছে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইট ভাটাসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্তৃপক্ষ বারবার নদী দখলদারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলেও প্রভাবশালীদের চাপসহ নানা কারণে সফল হতে পারেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মো. হাবিবুল হক খান বলেন, ড্রেন ও নালা-নর্দমার ময়লা-আবর্জনা ও দূষিত পানি নদীতে গিয়ে পড়ায় নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সব স্তরের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে কিছুটা হলেও নদী দূষণ রোধ হবে।
নদীর পাশে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার ব্যাপারে তিনি বলেন, নদীর পাশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান।