বিধ্বস্ত বাগেরহাটের শরণখোলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিডর দুর্গত মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ধীরে ধীরে ঘরবাড়ি, গাছপালা এবং সহাসম্পদ গড়ে তুলেছে। এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত জনপথ স্বাভাবিক হয়ে এলেও স্বজনহারা দুর্গত মানুষের মনের ক্ষত শুকায়নি আজও। বেঁচে থাকা মানুষগুলো প্রিয়জন হারানোর কষ্ট ভুলতে পারছে না।
ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, ভাই-বোনসহ স্বজনহারানো দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন সুন্দরবনঘেষা শরণখোলা জনপদের মানুষ। আর যারা তাদের স্বজনদের মৃতদেহ আজও খুঁজে পায়নি তাদের কষ্ট আরও গভীর। আর তাই নিখোঁজদের স্বজনরা আজও বলেশ্বর নদীপাড়ে খুঁজে ফিরছে প্রিয়জনদের।
শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী গ্রামের বাসিন্দা আলেতুন নেছা (৭৫)। জলোচ্ছ্বাসে তার স্বামী, দুই নাতি-নাতনি এবং পুত্রবধূ ভেসে গেছে। সিডরের ১১ বছরেও প্রিয়জন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওই নারী। এখন রোগে-শোকে অনেকটা অচল হয়ে পড়েছেন তিনি।
আলেতুন নেছা জানান, সিডরের রাতে নাতনি শারমিন আক্তার, নাতি বাবু পঞ্চায়েত, পুত্রবধূ আসমা বেগম এবং স্বামী সেকেন্দার আলীকে সঙ্গে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের যাওয়ার পথে হঠাৎ করে বুক সমান পানি চলে আসে। পানিতে তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে একটি গাছ ধরে বেঁচে থাকে। আর স্বামী একটি গাছের ডাল ধরে বাঁচার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি। স্বজন হারানোর শোক তাকে অচল করে দিয়েছে।
প্রতিবেশী রুহুল আমিন পঞ্চায়েত (৫৫) তার দুই ছেলে-মেয়ে এবং বাবাকে হারিয়েছেন সিডরে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে তার বংশের দুই বছরের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২২ জন নারী-পুরুষ।
শুধু আলেতুন নেছা এবং রুহুল আমিন নয়, বলেশ্বর নদী পাড়ের অনেকেই তাদের স্বজনকে হারিয়েছে সিডরে। কোনো কোনো শিশু বাবা-মাকে হারিয়ে এতিমের খাতায় নাম লিখিয়েছে। রাজৈর গ্রামে খান বংশের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২৬ জন নারী-পুরুষ মারা গেছে সিডরের তাণ্ডবে।
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বলেশ্বর নদী পাড়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে দুই পাশে কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর। ওই ঘরে এখনো কয়েকটি পরিবার তাদের ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন।
সিডরের পর আশে পাশে কাঁচা-পাকা, সেমিপাকাসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। এমনকি সিডরের আগে যে ধরনের ঘরবাড়ি ছিল তার চেয়েও বেশি মজবুত ঘরবাড়ি দেখা গেছে অনেক এলাকায়। দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করা হয়েছে দুইতলা এবং তিনতলা বিশিষ্ট সাইক্লোন সেল্টার। নতুন করে গাছপালা জন্ম নিয়েছে সেখানে।
মাঠে আমন ধান বাতাসে দোল খাচ্ছে। সিডরের পর সরকারি-বেসরকারি এবং দাতাদের নানা সহযোগিতায় মানুষ যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা সাক্ষ্য দিচ্ছে ওই জনপথ।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে স্বরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন গ্রাম।
সিডর প্রথমে সুন্দরবনের পূর্বাংশ লণ্ডভণ্ড করে উপকূলে আচড়ে পড়ে। জলোচ্ছ্বাসে এক গ্রামের মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অন্য গ্রামে। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ মারা গেছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা, মৎস্যখামার ও গবাদিপশুসহ মানুষের সহায় সম্পদ ভেসে গেছে। দিনের পর দিন নদী-খালে গবাদিপশুর সঙ্গে মানুষের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে।
সিডরে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা। সরকারি হিসাবে সিডরে শুধুমাত্র শরণখোলা উপজেলায় ৬৯৫ জন মারা গেছে এবং এখনো পর্যন্ত ৭৬ জন নিখোঁজ আছে। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। কাছাকাছি সাইক্লোন সেল্টার না থাকার কারণে সিডরে এতবেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাগেরহাট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, উপকূল অঞ্চলের কথা বিবেচনা করে দুর্যোগকালীন সময়ে যাতে মানুষ আশ্রয় নিতে পারে এজন্য বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ৩৪টি উন্নতমানের সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো সাইক্লোন সেল্টার কাম স্কুল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মানুষ যাতে দুর্যোগকালীন সময়ে দ্রুত সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় নিতে পারে এজন্য কানেকটিং সড়কও নির্মাণ করা হয়েছে। দুই থেকে তিনতলা বিশিষ্ট এসব সাইক্লোন সেল্টারের ধারণক্ষমতা এক হাজার থেকে দেড় হাজার। সাইক্লোন সেল্টারে শুধু মানুষ নয় গবাদি পশুও রাখা যাবে বলে তিনি জানান।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস জানান, সিডরে জেলায় সরকারি হিসেবে ৯০৮ জন মারা গেছে। নিখোঁজ আছে ৭৬ জন। সিডরে বাগেরহাটের এক হাজার ৬২৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬৫ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির মুখে পড়ে চার লাখ মানুষ। সরকারি হিসেবে টাকার অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
তিনি আরো জানান, সিডরে দুর্গতদের সরকারি, বেসরকারি এবং দাতাসংস্থার মাধ্যমে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হয়েছে।
এদিকে সিডরে নিহতদের স্মরণে বৃহস্পতিবার বাগেরহাটের শরণখোলার সাউথখালীতে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।