১৫ আগস্টের বিভীষিকাময় রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে যখন কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যরা আক্রমণ করে তখন জামিল আহমেদ কালবিলম্ব না করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই জাতির, শহীদ জামিলকে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে দেয়া হয়নি। তাকে জানানো হয় সামনে সেনা কনভয় রয়েছে। কিন্তু তারপরও তিনি এগিয়ে যেতে চাইলে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে ঘটনার সাথে যুক্ত সাবেক সেনাসদস্য তাকে গুলি করে হত্যা করে।
১৫ আগস্টের কালো রাতে অনেক কিছুই ঘটেছে যার সবকিছু হয়তো আমরা সবাই জানি না।
জাতীর এ বীর সন্তান সম্পর্কে জানা-অজানা সব তথ্য বলেছেন তার কন্যারা।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জামিল কন্যা তেহমিনা এনায়েত বলেন, ১৯৭৫ সালে আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। আমার বাবার সেন্স অব ন্যাশনালিজম ছিল খুবই তুখোর। একজন সেনা অফিসার হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই দক্ষ। তাকে ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। তখন থেকে আমরা গণভবনেই থাকতাম, যেখানে বঙ্গবন্ধু অফিস করতেন।
তিনি আরও বলেন, ‘১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান, রক্ষীবাহিনীর প্রধানসহ অনেককেই ফোন দিয়েছিলেন। তিনি আমার বাবা কর্নেল জামিলকে শেষবারের মতো কল দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কর্নেল জামিলকে বলেছিলেন, আমি ভীষণ বিপদে আছি, কারা বা কোথা থেকে অ্যাটাক করেছে, জামিল আমাকে সেভ কর। এরপর আমার বাবা সাথে সাথেই রেসপন্স করেছেন।’
জামিল কন্যা তেহমিনা বলেন, ‘আমি বলবো আমার বাবা যে শুধু মৃত্যুবরণ করেছেন তা নয়, তিনি একটার পর একটা দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ফোন রিসিভ করে বলেন, আমি আসছি, আপনি চিন্তা করবেন না।’
ওই রাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সে রাতে কর্নেল জামিল তার দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। তিনি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কল করেন এবং তাদের সেনা পাঠাতে বলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার নির্দেশ দেন এবং তৎক্ষণাৎ ৩২নং রোডের বাড়ির দিকে ছুটে চলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তখন আমার মা বলেন, তুমি কি সত্যিই যাচ্ছ, তখন বাবা বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বিপদ, আমি যাব না?’
‘তখন বাবা আমাকে বললেন মা এক গ্লাস পানি দে, তখন আমি ফ্রিজ থেকে একদম ঠান্ডা এক গ্লাস পানি এনে বাবাকে দিলাম। তিনি তৃপ্তি নিয়ে এটা খেলেন। যাওয়ার আগে আমাদের মাকে বললেন ‘আমার কন্যাদের খেয়াল রেখো,' বলছিলেন তেহমিনা এনায়েত।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবা এবং মা কেউই জানত না যে আমাদের এক ছোট বোন তখন আমার মায়ের পেটে ছিল। তার নাম কারিশমা জামিল।
তেহমিনা এনায়েত বলেন, ‘সব মেয়েরাই তার বাবাকে ভালোবাসে, বাবারাও মেয়েদের ভালোবাসে। আমি বলবো ১৯৭৫ সালে দেশ জাতির পিতা হারিয়েছে, আমরা আমাদের পিতা হারিয়েছি।’
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দ্বিতীয় কন্যা আফরোজা জামিল কঙ্কা শুরুতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
এরপরেই তিনি বলেন, ‘আমরা ভীষণভাবে গর্বিত যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বীরের জন্য আমার বাবা জীবন দান করেছেন। আমাদের মা আমাদের শিক্ষা দিতেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে কীভাবে বড় হতে হয় এবং বাবার আদর্শে। বাবার যে কর্তব্যপরায়ণতা, দেশাত্ববোধ, জাতীয়তাবাদ, এগুলো নিয়েই আমরা বড় হয়েছি।’
বঙ্গবন্ধুর সাথে জামিল আহমেদের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে আফরোজা জামিল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। একদিন বঙ্গবন্ধু বাবাকে বললেন, জামিল তোকে দেশে খুব দরকার, কারণ তুই এতো দক্ষ একজন অফিসার ডিজিএফআইয়ে তোকে দরকার, আমাকে না হয় তুই রোজ এসে দেখে যাবি, তুই তো আমার নয়নের মনি। তুই আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবি?’
‘আমি মনে করি ১৯৭৫ সালে আমরা চার বোন দুজন পিতা হারিয়েছি। একজন জাতির পিতা, একজন নিজের পিতা,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার মা অনেক কষ্ট করেছেন। অসম্ভব সাংঘাতিক দুরূহ পথ আমরা অতিক্রম করেছি। দেশের রাজনৈতক পটপরিবর্তনে অনেককেই আমাদের অন্যভাবে দেখতেন, যে বঙ্গবন্ধুর জন্য তাদের বাবা জীবন দিয়েছেন। তবে আবার অনেকেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।’
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আফরোজা জামিল বলেন, ‘আপা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ২০০৯ সালে আমার বাবার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০০৯ সালে তাকে বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করেন। এটার জন্য আমরা তার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।’
নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তৃতীয় কন্যা স্যাম জামিল বলেন, ‘আমরা কর্নেল জামিলের মেয়ে হয়ে খুবই গর্ববোধ করি। প্রবাসে যাদের সাথেই দেখা হয় আমাদের পরিচয় দিলে সবাই অনেক সম্মান করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭৫ সালে আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। একদিন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর অফিসে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন। তখন আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম আমি প্রতিদিন বিকালে এখানে আসতে চাই। তিনি বললেন আমার বোটটা প্রতিদিন তুমি ও্ই ঘাটে নিয়ে যাও? আমি বললাম না, আমার বোনেরা নিয়ে যায়। আমিও তাদের সাথে থাকি, তবে ভুল করে সেখানে রেখে আসে।’
পরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আচ্ছা তুমি প্রতিদিন এখানে আসতে পারবা, যদি বোটটা নেয়ার পর আবার এখানে রেখে যাও।’
১৫ আগস্ট শোক দিবস উপলক্ষে গ্যালারি কসমস এই সাক্ষাৎকারধর্মী বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে কর্নেল জামিলের ৪ কন্যার মধ্যে তিনজন অংশ নেন।
উল্লেখ্য, কর্নেল জামিলের সহধর্মিণী সাবেক সংসদ সদস্য আঞ্জুমান আরা জামিল ২০১২ সালে পরলোকগমন করেন।