‘সভ্য পৃথিবীকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে’ যোগ করে তিনি বলেন, ‘এটা বলাই যায়, রোহিঙ্গারা প্রচলিত অহংকারিক জাতীয়তাবাদ বা লোকরঞ্জনবাদের শিকার। অবশ্যই, আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবী কখনই জঙ্গলে পরিণত হতে পারে না।’
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাপানের রাষ্ট্রদূত তার বাসভবনে বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীও বক্তব্য রাখেন।
জাপানের রাষ্ট্রদূত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, এ দেশে নিযুক্ত হওয়ার তিন দিনের মাথায় একটি কূটনৈতিক সফরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল।
‘সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল ও রেহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রচুর কাদা ছিল এবং শিশুরা যেসকল চিত্রঙ্কন করেছিল তার বেশিরভাগ ছিল লাল, ধূসর এবং কালো রঙ্গের,’ বলেন দুই বছর দায়িত্বপালন শেষে আগামী বৃহস্পতিবার ঢাকা ছাঁড়তে যাওয়া জাপানি রাষ্ট্রদূত।
সেই থেকে এখন পর্যন্ত দশবারেরও বেশি সময় তিনি শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছেন এবং অনেক ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন দেখতে পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
রাষ্ট্রদূত বলেন, শিবিরটি এখনও পুরানো সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করছে এবং সেই সাথে নতুন করে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলো সমাধানের অপেক্ষায় আছে।
রেহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশের মানবিক আচরণের প্রশংসা করে জাপনি রাষ্ট্রদূত ইজুমি বলেন, ‘বেশ কিছু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শিশুদের চিত্রঙ্কনগুলো এখন রংধনুর রঙ্গে ভরপুর।’
‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে বাংলাদেশ কখনোই সীমান্তে বেড়া দেয়নি বা জোর করে রোহিঙ্গারা যে দেশ থেকে এসেছিল সে দেশে ফেরত পাঠায়নি। তার বিপরীতে, স্বেচ্ছায় তাদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করেছে এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে কঠিন এ পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছে,’ বলেন তিনি।
রোহিঙ্গা সঙ্কট পর্যবেক্ষণ করে, তিনি বিখ্যাত ব্রিটিশ কূটনীতিক এবং লেখক এডওয়ার্ড হ্যালেট কারের ‘দ্য টোয়েন্টি ইয়ারস ক্রাইসিস’ বইয়ের কথা উল্লেখ করেন। যেখানে লেখক প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন।
‘মোটকথা তিনি বলতে চেয়েছেন কূটনীতিকদের অবশ্যই বাস্তববাদ ও ভাববাদী (বা আদর্শবাদের) চিন্তার মাঝামাঝি অবস্থানে থাকতে হতে পারে। অন্য কথায়, বিশ্বের বাস্তবতা না বুঝে আদর্শবাদ, যা বিশ্বের আদর্শিক লক্ষ্য, ভুলে যাওয়াই ভালো কূটনৈতিক ভিত্তি হতে পারে,’ মনে করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত ইজুমি।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকিয়ে ইজুমি বলেন, দোদুল্যমান ইতিহাস বাস্তববাদী চিন্তার দিকে মারাত্মকভাবে পাল্টে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববাদ’ বা ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি মাঝে মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্ব ব্যবস্থার আদর্শিক লক্ষ্য কিছুটা মিলেমিশে যাচ্ছে। অনেক দেশের রাজনৈতিক নেতারা বলতে শুরু করেছেন ‘আমিই প্রথম! আমার দেশই সেরা!’ এমন একটি পৃথিবীতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তা ভেবে আমি আতঙ্কিত।’’
তিনি বলেন, শক্তিশালীরা সব সময় জিতে যায় এবং দুর্বলরা নিপীড়নের শিকার হন। ‘এই পৃথিবী কি জঙ্গল? বেলুম অলিয়ামিয়াম কনট্রাস্ট ওমনেস? (যার অর্থ সকলের বিরুদ্ধে সকলের লড়াই? এটি একটি ল্যাটিন বাক্য।)
জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, অন্য কিছু বাদ দিয়েও রোহিঙ্গা শিশুদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দিয়ে তাদের ভবিষ্যতের আশার আলো দেয়া জরুরি।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাদের মধ্যে কোনো হারানো প্রজন্ম তৈরি করা উচিত নয়। আমি বলব যে আমাদের সহানুভূতি এবং সমর্থন সর্বদা তাদের পাশে থাকবে।’
বর্তমানে বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগ ২৫ আগস্ট, ২০১৭ সালের সামরিক নির্যাতন থেকে বাচঁতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের এক অনুসন্ধান বলছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অবস্থান করা আরও ৬০,০০০ রোহিঙ্গা ‘মারত্মক গণহত্যা ঝুঁকির’ মুখোমুখি রয়েছে এবং সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সেদেশে প্রত্যাবাসনের সুযোগ ‘অসম্ভব’ বলে মনে হচ্ছে।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা আরও জানায়, মিয়ানমার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জমি বাজেয়াপ্ত করছে এবং সেখানে দালান নির্মাণ করছে।
আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্বেগজনক এই বিষয়গুলো বাংলাদেশে আরও রোহিঙ্গাদের প্রবেশের বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করবে।
প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং ঢাকায় অবস্থানরত হাই-কমিশনার, ব্যবসায়িক নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, প্রবীণ সাংবাদিক ও জাপানের নাগরিকরা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।