দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের বিষয়টি আমলে নিয়ে তারা বলেন, গত কয়েক বছরে অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে কিন্তু আরো অনেক বেশি কিছু অর্জন বাকি রয়ে গেছে। ভারত অনেক কিছু করার ঘোষণা দিলেও অল্পই বাস্তবায়ন করেছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে কসমস ফাউন্ডেশন এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (আইএসএএস) যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: ভবিষ্যতের পূর্বাভাস’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে।
আইএসএএসের মুখ্য গবেষণা ফেলো এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইএসএএসের পরিচালক সি রাজা মোহন।
সিঙ্গাপুরের অ্যাম্বাসেডর অ্যাট-লার্জ এবং আইএসএএসের চেয়ারম্যান গোপিনাথ পিল্লাই, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত কৃষ্ণান শ্রীনিবাসন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান, কসমস গ্রুপের পরিচালক নাহার খান ও মাসুদ খান এবং সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সম্পাদকরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘তারা যদি দাবি করেন যে আমরা বন্ধু তাহলে আমরা সমান ও অকপট আচরণ চাই। আমাদের সমৃদ্ধি ভারতেরও সমৃদ্ধির কারণ হবে।’
তিনি জানান, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং তারা যদি ফিরে না যায় তাহলে বাংলাদেশ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সব ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে।
এই বিশেষজ্ঞের মতে, ভারতের নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ জড়িত থাকলেও তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে তেমন কোনো চাপ প্রয়োগ করেনি।
তিনি বলেন, একই পথ অনুসরণ করা ভারত ও চীন চায় বাংলাদেশ যাতে রোহিঙ্গা সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করে, কিন্তু তা সম্ভব নয়। এ জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন এবং উপমহাদেশের মানবিকতা রক্ষায় ভারতকে অবশ্যই উচ্চ নৈতিকতার জায়গা থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
অধ্যাপক দিলারা নিরাপত্তার দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে পানি ইস্যুটিকে চিহ্নিত করেন এবং এবিষয়ে ভারতের সুশীল সামাজের কোনো ভূমিকা না দেখতে পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো মরে যাওয়ার জন্য তিনি ভারত নির্মিত বাঁধগুলোকে দায়ী করেন।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারেনি।
‘প্রতিশ্রুতি থাকার পরও ভারতের মোট আমদানির মাত্র ১ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে যায়। যেখানে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কারও ভারতের সাথে বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে,’ জানিয়ে তিনি বলেন, আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা কেউ ভারতবিরোধী নয়, তারা শুধু পারস্পরিকভাবে লাভজনক একটি সম্পর্ক দেখতে চান।
অধ্যাপক দিলারার মতে, বাংলাদেশের নদীগুলো যদি শুকিয়ে যায় তাহলে যত বিনিয়োগই হোক না কেন দেশ সমৃদ্ধ হতে পারবে না।
তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনেক উত্থান-পতনের পর এখন ভালো পর্যায়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর অনেক উন্নতি হয়েছে। আজকের মতো ভালো অবস্থান অতীতের কোনো সময়ে ছিল না।
অনুষ্ঠানে রাজা মোহন বলেন, তারা নতুন ভূগোল গড়ে উঠা দেখতে যাচ্ছেন এবং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বাংলাদেশের নিজের উত্থান ও তার অর্থনৈতিক রূপান্তর।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেই সাথে তার মতে, বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মধ্যকার সেতুবন্ধন হতে পারে।
রাজনীতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘যাকে ইচ্ছা তাকে নির্বাচিত করার স্বাধীনতা আপনার রয়েছে। আজ আপনার দেশে আপনি যে কাউকে নির্বাচিত করতে পারেন। সরকারে যেই থাকুক না কেন তার সাথে কাজ করতে আমি ভারত সরকারকে সমর্থন দেই। আপনি আরেকজনের ঘরোয়া রাজনীতি ব্যবস্থাপনা করতে পারেন না।’
তার মতে, সীমান্তে ও বিশ্বব্যাপী যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন তার সাথে কাজ করা ছাড়া বড় দেশগুলোর কোনো উপায় নেই।
এসময় কৃষ্ণান শ্রীনিবাসন বলেন, ‘ভারত শিগগিরই বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে এবং বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের মর্যাদায় ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। উভয় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিই প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ।’
‘আমরা এক সাথে বিবিআইএন ও বিসমটেকে অতিশক্তিশালী। আমরা যেকোনো উপ-আঞ্চলিক গোষ্ঠীতে আধিপত্য দেখাতে পারি,’ যোগ করেন তিনি।
ভারতের এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সর্বক্ষেত্রে নিবিড় সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত একসাথে দুদেশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভূদৃশ্য পালটে দিতে পরে।
ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং বলেন, সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার জন্য সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ।
সিঙ্গাপুরের অ্যাম্বাসেডর অ্যাট-লার্জ এবং আইএসএএসের চেয়ারম্যান গোপিনাথ পিল্লাই নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোকপাত করেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কসমস ফাউন্ডেশনসহ বাংলাদেশের সাথে কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান বলেন, ভারত নিঃসন্দেহে এক উদীয়মান শক্তি এবং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত শক্তি হিসেবে দেশটির গুরুত্ব এই অঞ্চল ও বাইরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিপুল সম্ভাবনা থাকা বাংলাদেশও দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্ব দরবারে গুরুত্ব অর্জন করে নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের সাথে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত হবে তা তাদের জনগণের উন্নতি ও সমৃদ্ধি এবং এই অঞ্চল ও বাইরের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে বক্তাদের আলোচনায় ক্রমবর্ধমান ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এবং অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধের মতো কিছু অমীমাংসিত বিষয় উঠে আসে।
তাদের মতে, দুদেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক চমৎকার রয়েছে, যদিও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বহুলাংশে ভারতের অনুকূলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় ভারসম্য আনতে ভারত শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই সাহায্য করতে পারে।