তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমে ২-৩ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। আগের বছর যা ছিল ৮.১৫ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতির ধারাবাহিকতার ওপর প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে প্রবৃদ্ধি আরও নেতিবাচক হবে।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে সরকারের প্রধান কাজ হবে সরবরাহ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনা এবং কাঁচামাল ও মূলধন জাতীয় যন্ত্রপাতি আমদানির মাধ্যমে রপ্তানি কার্যক্রম বাড়ানো উল্লেখ করে এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অন্যথায় রপ্তানি বাজার পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসবে এবং এ পরিস্থিতি ঠিক রাখতে সরকারকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানির জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশে অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে পরিবহন ও বন্দর ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। অবিলম্বে এগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
কোভিড-১৯ এর পরে বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এ সংকটে বিপুল সংখ্যক মানুষকে তাদের আয় ও চাকরি হারাতে হয়েছে। সে জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
বিপুল সংখ্যক মানুষ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের ত্রাণের আওতায় আনার কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।
সরকারের চলমান অনেক উদ্যোগ রয়েছে এবং এগুলো যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হয় সেদিকে আরও নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশকে এখন স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও মানবিকতা– এ ত্রিমাত্রিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে এবং তিনটি ক্ষেত্রেই সমানভাবে নজর দেয়া দরকার।
তিনি বলেন, দেশে স্বাস্থ্য খাতের জন্য সবচেয়ে কম মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়। ‘বিশ্বব্যাপী যেখানে গড় বরাদ্দ ৩-৪ শতাংশ। আমরা স্বাস্থ্য খাতে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে পারিনি। স্বাস্থ্য খাতকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে যাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।’
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যথাযথ তহবিল বরাদ্দ দিতে হবে। অন্যদিকে, চিকিৎসকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম এখনই বিতরণ করতে হবে।
অর্থনীতির বিষয়ে বলতে গিয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো বলেন, অর্থনীতি এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং এগুলো আরও জোড়ালো করা উচিত যাতে শিগগিরই দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করা যায়। অন্যথায়, দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারের উচিত বিনিয়োগের পাশাপাশি আর্থিক নীতি আরও সম্প্রসারিত করা।
মানবিকতার বিষয়ে বলতে গিয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সুরক্ষা জাল কর্মসূচিগুলো আরও সম্প্রসারিত ও জোরদার করতে হবে।
খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সঠিকভাবে বোরো ধান সংগ্রহের ওপর জোর দেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ধানের এ মৌসুমটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত খাদ্য সুরক্ষার পরিস্থিতি ভালো, তবে এটি বোরো ধানের উৎপাদনের ওপর নির্ভর করবে। সরকার ইতোমধ্যে ১৭ লাখ মেট্রিক টন বোরো ফসল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে এবং এ জন্য সরকারের খুব ভালো প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
তিনি বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত নেপালে ১৮ শতাংশ ও ভারতে ১৭ শতাংশের মতো হলেও বাংলাদেশে এর অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। এ অনুপাত আরও বেশি হলে সরকারের পক্ষে অর্থ সরবরাহ করা সহজতর হতো।
তিনি বলেন, সরকারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কর ফাঁকিবাজ ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
কোভিড-১৯ এর পরিণতি মোকবিলায় সরকারকে বিদেশি সহায়তা জোগাড় করার তাগিদ দিয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘যদি আমরা এটি করতে পারি, তবে করোনাভাইরাসের মতো দুর্যোগ মোকাবিলার বিরুদ্ধে আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে সক্ষম হব।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব কেমন হবে তা এর স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় কম হলেও আমরা যদি মে মাসে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করতে পারি তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব।’
তবে, যদি এ পরিস্থিতি জুন অবধি অব্যাহত থাকে তবে বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দেয়া ভবিষ্যত বাণীই সত্য হবে, বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই দেশের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় ছিল। দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে, বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে এবং রপ্তানি আয়ও সঙ্কুচিত হচ্ছিল।
ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, কোভিড-১৯ আঘাত হানার আগেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। এখন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ প্রভাব অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিতে চলমান এ দুই ধাক্কা বিবেচনা করলে এর মাত্রা অনেক বেশি হবে।
অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, সরকারকে তিন বছরব্যাপী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী বছরের বাজেট পরিকল্পনা করতে হবে। পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবনচক্র ভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো, কৃষিক্ষেত্রে ঋণ নয় প্রণোদনা প্রদান করা, বহুমুখী কর্মসূচির পদক্ষেপ নেয়া এবং লক্ষ্যমুখী মূলধন সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
তহবিলের বিষয়ে তিনি বলেন, তথাকথিত পাঁচ শতাংশ বাজেট ঘাটতি এখানে কাজ করবে না। বরং ব্যয় বাড়ানোর জন্য এটি বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করতে হবে।
বৈদেশিক বাণিজ্য বজায় রাখা, মুদ্রার ওঠানামার কোনো সুযোগ না দেয়া এবং ঋণ ত্রাণ ও স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের জন্য দ্বিপক্ষীয় অংশীদারদের সাথে আলোচনা করার বিষয়ে জোর দেয়ার কথা বলে ড. তিতুমীর।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, এটা স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা লেগেছে।
তিনি বলেন, ‘রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে তেমন আশার কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফলে অর্থনীতিতে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।’
সরকারকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার ওপর জোর দেয়ার কথা বলেন ড. রায়হান।
এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য আর্থিক সহায়তা, আর্থিক নীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, বলেন তিনি।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজে মধ্যে এর অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ঘোষিত এ প্যাকেজগুলোর সাফল্য এর অর্থায়ন, বিতরণ এবং পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে। যা পরবর্তী দুই বা তিনটি বাজেটেই প্রতিফলিত হওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, এ সংকট পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দেশে একটি বড় ধরনের উত্থান প্রয়োজন এবং সেই সাথে সামাজিক সুরক্ষা জালের আওতাও সম্প্রসারণ করা দরকার।
তিনি বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থা পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার কাজটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সেজন্য ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা এবং দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনাকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।