ফরিদপুর, ২৪ মার্চ (ইউএনবি)- গত একযুগে ফরিদপুর অঞ্চলের নদ-নদীগুলো দিন দিন শুকিয়ে খালে পরিণত হচ্ছে। নদীগুলোর মাঝে চর জেগে উঠায় নৌ-যান চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি করছে। এতে নদীকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহকারীদেরও পড়তে হচ্ছে দুঃখ-কষ্টে।
বলা হয় 'নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে' অথচ ফরিদপুর ও রাজবাড়ীতে যে কয়েকটি নদী রয়েছে তার কোনটিরই যৌবন নেই। নদীগুলোর নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে, চর জাগছে। বর্ষা ছাড়া আগের মতো নদীভরা পানি দেখা যায় না। শীতের শুরুতে নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ থাকলেও শীতের শেষ দিকে বসন্তেই নদীগুলো শুকিয়ে যায়।
বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষের নদীর সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন এসব নদীকে ঘিরেই। কৃষিকাজ ও মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে নদীপাড়ের মানুষগুলো। অথচ প্রতি বছর বন্যা ও ভাঙনের ফলে নদীগুলোয় এখন আর আগের মতো প্রাণ নেই। বন্যা ও ভাঙনে প্রচুর পলি পড়ে পদ্মা, মধুমতি ও গড়াইসহ অন্যান্য নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে।
ফলে আগে যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যেত এখন আর পাওয়া যায় না। তাছাড়া নদীতে পানির অভাবে এ অঞ্চলে সেচ সংকটও দেখা দিচ্ছে। তাই এ অঞ্চলের জেলেরা যেমন কষ্টে দিন পার করছেন। তেমনি কৃষিকাজে নির্ভরশীল মানুষরাও এখন ফসল উৎপাদনে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাই নদীকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর একটাই দাবি, নদী খনন করে এ অঞ্চলের নদ-নদীর ঐতিহ্যও ফিরে আনা হোক।
ফরিদপুর নদী গবেষণা ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অরুন চন্দ্র মহোত্তম জানান, এ জেলাগুলোর অন্যতম নদ-নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই, চন্দনা, কুমার। এ ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি ছোট নদী। এসব নদীর মধ্যে পদ্মা, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ ও গড়াই নদীতে স্বল্প পরিমাণ পানি থাকে। প্রতিবছর বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে প্রচুর পরিমাণ পলি ও বালিমাটিতে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে পানিপ্রবাহ ও নৌযান চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে ফরিদপুর ও রাজবাড়ি জেলায় পদ্মা নদীরই ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা রয়েছে। এ নদীরগুলোর আয়তন এখন প্রায় ১৬ হাজার ৬৫৪ হেক্টর। অথচ এখন আর আগের সেই জৌলুস নেই। কোনো রকমে চলছে এর প্রবাহ।
শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীতে কিছুটা পানি থাকলেও বাকিগুলো পরিণত হয়েছে চরাঞ্চলে।
ফরিদপুরের নিস্বর্গবিদ অধ্যাপক আলতাফ হোসেন বলেন, একসময় এসব নদী অনেক গভীর ছিল, প্রচুর পানি থাকত, বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যেত। এখন পলি পড়ে নদী ভরাট হওয়ায় আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে বন্যায় ও নদী ভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
ফরিদপুরবাসীর দাবি, নদী খনন করা হলে পানি ও মাছ পেতে কোনো সমস্যা হবে না। শুকনো মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে চৌচিড় হয়ে যায়। তবে সরকার নদীকে বাঁচাতে চাইলে মেগা পরিকল্পনা করে প্রতিবছর ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আর দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে নদীশাসন অতি জরুরি এবং নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে বলেও মনে করেন তারা।
ফরিদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, 'নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে পলি পড়ে প্রচুর ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মাছ উৎপাদন কমে গেছে। তবে মাছের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হলে পলি পড়া জলাশয়গুলোকে পুনঃখনন করতে হবে। পানি থাকায় মাছের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে, চাপ সৃষ্টি হচ্ছে মাছ উৎপাদনে। তবে ইলিশ মাছের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হলে ব্যাপক আকারে প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে নদী খনন করতে হবে।'
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া ফরিদপুর অঞ্চলের নদ-নদীর বিষয়ে বলেন, 'এ অঞ্চল পদ্মা, মধুমতি ও গড়াই নদীবেষ্টিত। এ জেলার এক পাশ দিয়ে পদ্মা ও অন্য পাশে মধুমতি গড়াই নদী প্রবাহমান। প্রতিবছরই নদীভাঙনের কবলে পড়ে বাড়িঘর ও ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে। বন্যায় এ দুইটি নদী প্রচুর পলি মাটি বয়ে আনে। এতে জমি উর্বর হয় এবং ফসলের আবাদ ও উৎপাদন ভালো হয়।'
তবে সমস্যার কথাও বলেন জেলা প্রশাসক, 'উজান থেকে প্রচুর পরিমাণ পলি মাটি ও বালি এসে নদীগর্ভে স্তুপ আকারে এসে প্রতিনিয়ত চর পড়ে যাচ্ছে এবং নদীর ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি নদীতে থাকার কথা তা থাকছে না। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই কূল ছাপিয়ে বন্যা ও নদীভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে।'
ফরিদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহি প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, 'নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রতিবছর ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন। এর ফলে নদীর ধারণ ক্ষমতা বাড়বে নদীর পানি প্রবাহ সঠিকভাবে থাকবে এবং বর্ষা মৌসুমে আমরা বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাব। আর শুষ্ক মৌসুমে নদীতে যে পানি থাকবে তা দিয়ে সেচকার্যসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যাবে। তবে প্রমত্তা পদ্মা নদী খনন করা প্রয়োজন। একইভাবে মধুমতি ও গড়াই নদীও চর পড়ে এর ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে, সেটাও দেখা দরকার।' এভাবে পদ্মা ও গড়াই নদীকে রক্ষার মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করার মাধ্যমে এর সুফল সারা দেশ পাবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমে নদী বাঁচাতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে এর কাজ শুরু হয়েছে। আমরা হতাশ নই অচিরের আমরা এর সুফল ভোগ করবো।
ফরিদপুরে চেম্বার অব কর্মাসের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যমে নদী পথ। ফরিদপুরে নৌ-বন্দরকে কেন্দ্র করে ১০ হাজার অধিক পরিবার বেঁচে থাকে,পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজনী পণ্য আনা নেয়ার কাজ করে এই বন্দর দিয়ে। অথচ নদীতে পানি ঠিকমতো না থাকায় এখন আগের মতো নদী পথে পণ্য আনা নেয়ার কাজ করা যাচ্ছে না।
তিনি বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া আহ্বান জানান।