লালমনিরহাট, ২০ সেপ্টেম্বর (ইউএনবি)- দেশের অন্যতম বৃহৎ বিমানবন্দরটি লালমনিরহাটে। এই বিমানবন্দরটি পাঁচ যুগ ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এক হাজার ১৬৬ একরের বিশাল পরিধি ব্যাপ্তি সরকারের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এখন কৃষি ফার্মে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও পর্যব্ক্ষেকরা বলছেন, দেশের এই বৃহত্তম বিমানবন্দরটি চালু হলে রংপুর অঞ্চলে ঘটবে অর্থনৈতিক বিপ্লব। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রুটে উম্মোচন হবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানবন্দরটি চালু হলে নেপাল, ভুটান ও ভারতের অন্তত ১৩টি অঙ্গরাজ্যের সব শ্রেণির মানুষ অনায়াসে কম খরচে বাংলাদেশে আসতে পারবে। একইভাবে বাংলাদেশিরাও ওইসব দেশ ও রাজ্যে অল্প খরচে যাতায়াত করতে পারবে। এছাড়া বিমানবন্দরটি চালু হলে লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দর, কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সুত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় ইংরেজ সরকারকে রক্ষার একটি প্রধান ক্ষেত্র। এই ঘাঁটি না থাকলে ভারতবর্ষ এবং ইংরেজদের ভারতবর্ষ ছাড়ার ইতিহাস হতো অন্যরকম।
জাপানের সহযোগিতায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ চলে এসেছিল বার্মা অতিক্রম করে আসাম সীমান্তে। লালমনিরহাটের এই বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে ব্রিটিশরা ঠেকিয়ে দেয় আজাদ হিন্দ ফৌজের সেই অগ্রযাত্রাকে।
লালমনিরহাটকে তখন বলা হতো ‘গেটওয়ে টু নর্থ-ইস্ট' এবং 'মাউথ অব আসাম'। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তখনকার বিশাল প্রদেশ বৃহত্তম আসামে প্রবেশের একমাত্র পথ ছিল এই লালমনিরহাট। রেলপথের ‘লালমনিরহাট জংশন’ এবং বিমানপথে ‘লালমণিরহাট জাহাজ-ঘাঁটি’। ভারত ভাগ না হলে লানমনিরহাট তার এই যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বের জন্য আপন মহিমায় হয়ে ভাস্বর হয়ে থাকতো আর হয়ে উঠতো 'দ্বিতীয় কোলকাতা' রূপে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এক হাজার ১৬৬ একরের বিশাল পরিধি ব্যাপ্ত বৃহৎ বিমানবন্দরটি। যেটি এখন শুধু বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি 'কৃষি ফার্ম' মাত্র।
অবশ্য ১৯৫৮ সালে স্বল্প পরিসরে পুনরায় এই বন্দরে বিমান সার্ভিস চালু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণে চার কিলোমিটার রানওয়ে, বিশাল টারমাক, হ্যাংগার, ট্যাক্সিওয়ে এগুলো সবই এখন পরিত্যক্ত।
বিশাল এই ঐতিহাসিক বিমানবন্দরটি আজ জৌলুসহীন ও বিবর্ণতায় মলিন হয়ে পড়েছে। মুখ লুকিয়ে যেন কাঁদছে তার অতীত গৌরবের ইতিহাস স্মরণ করে।
‘মঙ্গা’র অলঙ্ঘনীয় অভিশাপ হতে মুক্ত হয়ে অবহেলিত উত্তরাঞ্চলে এখন লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। উন্নয়নের ফলে দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় লালমনিরহাটের জনগণেরও ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এই অবস্থায় লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি যাত্রী পরিবহনের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে যেমন সরকার পেত বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, তেমনি এলাকার জনগণও লাভবান হতো দ্রুততম সময়ে ঢাকা যাতায়াতের সুবিধা। সেই সাথে ঐতিহাসিক এই বিমানবন্দরটি একদিকে যেমন তার হারানো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফেরত পেত, গর্ব অনুভব করত লালমনিরহাটবাসীও।
অন্যদিকে যাতায়াত সুবিধায় বেঁচে যেত এলাকার জনগণের অনেক মূল্যবান কর্ম-ঘন্টাও। এ ছাড়াও বিমানবন্দরটি চালু হলে ভবিষ্যতে একদিন হয়ত এটি নেপাল, ভুটান, শিলিগুড়ি রুটে যাত্রী পরিবহন করার পথে অগ্রসর হয়ে অর্জন করতে পারত এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মর্যাদাও।
১৯৮৩ সালে বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ এখানে কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করে। সরকারি এই মূল্যবান স্থাপনাজুড়ে মিলিটারি ফার্মের তত্ত্বাবধায়নে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার এবং সংরক্ষিত ভূমিগুলিতে চলছে কৃষি কাজ। রাখালেরা ওই জমিগুলোতে পশু চারণ করে।
সূত্র জানায়, বিমানবন্দরটি ব্যবহারের উপযোগী হলেও শুধু ভারতীয় আকাশসীমা লঙ্ঘনের অজুহাতে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
লালমনিরহাট পৌরসভার মেয়র রিয়াজুল ইসলাম রিন্টু বলেন, ‘বিমানবন্দরটি চালু হলে এলাকার উন্নয়ন অনেকাংশে ত্বরান্বিত হবে।’
এফবিসিসিআইর পরিচালক সিরাজুল হকও মনে করেন বিমানবন্দরটি চালু হলে এলাকার ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। রংপুর অঞ্চলে ঘটবে অর্থনৈতিক বিপ্লব। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যোগাযোগেও ঘটতে পারে নতুন দ্বার।
লালমনিরহাট বিমান বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিটের একটি নিভর্রযোগ্য সূত্র জানায়, ভুটান সরকার লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি ব্যবহারের জন্য পছন্দের তালিকায় রাখলেও আকাশসীমা নিয়ে জটিলতা থাকায় তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
সূত্রটি আরও জানায়, ভারত, বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি চুক্তি হলে বন্দরটি ব্যবহার করা যাবে। তবে এব্যাপারে লালমনিরহাট বিমান বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে অপরগতা প্রকাশ করেন ।