বুধবার ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোরের এক খোলা চিঠিতে এ কথা বলা হয়।
ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বিশ্বের সর্বাধিক প্রশংসিত মানবাধিকার চুক্তি শিশু অধিকার সনদের ৩০তম বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে এ চিঠি প্রকাশ করা হয়। এতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ, দারিদ্র্য, অসাম্য ও বৈষম্যের মতো বিদ্যমান হুমকিগুলোর বাইরে নতুন হুমকির কথা উল্লেখ করে তা নিরসনে প্রচেষ্টা জোরদার করার উপায়ের রূপরেখা দেয়া হয়।
ফোর লেখেন, ‘আপনাদের প্রজন্ম, আজকের শিশুরা নতুন এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে, যা আপনাদের বাবা-মায়েদের কাছে অকল্পনীয় ছিল। জলবায়ু আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি বদলে যাচ্ছে। বৈষম্য আরও বাড়ছে। বিশ্ব নিয়ে আমাদের উপলব্ধি বদলে দিচ্ছে প্রযুক্তি। আর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সংখ্যক পরিবার অভিবাসন করছে। শৈশব বদলে গেছে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।’
চিঠিতে বিশ্বব্যাপী শিশুদের জন্য আটটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত, দূষণ ও জলবায়ু সংকট, মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি, গণ অভিবাসন ও জনসংখ্যার স্থানান্তর, রাষ্ট্রহীনতা, ভবিষ্যতের কাজের জন্য দক্ষতা, তথ্য অধিকার ও অনলাইনে গোপনীয়তা এবং অনলাইনে ভুল তথ্য।
সংঘাত বিষয়ে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময়েই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বর্তমানে প্রতি চারজন শিশুর মধ্যে একজন সহিংস লড়াই বা দুর্যোগে আক্রান্ত দেশগুলোতে বসবাস করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সতর্ক করে চিঠিতে বলা হয়, শিশুদের ইতিমধ্যে এ গ্রহে যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে তার পাশাপাশি একটি বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিশুদের বেঁচে থাকার ও বিকাশের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ অর্জনকেই ক্ষুণ্ন করে দিতে পারে। চরম আবহাওয়াগত পরিস্থিতি ও বাতাসে বিষাক্ততা বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী খরা ও আকস্মিক বন্যা- সবকিছুই এ সংকটের অংশ এবং অসামঞ্জস্যহীনভাবে দরিদ্রতম, সবচেয়ে অরক্ষিত শিশুরাই এসবে আক্রান্ত হচ্ছে।
ইউনিসেফ বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকটের প্রভাব কমিয়ে আনতে কাজ করছে। তারা ইথিওপিয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি সন্ধানে নতুন প্রযুক্তির প্রবর্তন ঘটিয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদে পানির সংকটে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য সমাধান বের করছে। মালাবিতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ পানি প্রাপ্তির সুবিধা উন্নত করতে সংস্থাটি সৌর শক্তি ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী, পরিবেশবান্ধব একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের গতি কমিয়ে আনতে সবাইকে একসঙ্গে আরও অনেক কিছু করতে হবে বলে চিঠিতে জানানো হয়।
ফোর লেখেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে, আরও পরিবেশবান্ধব কৃষি, শিল্প ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস বাড়ানোর পেছনে বিনিয়োগ করতে সরকার ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে হাতে হাত রেখে কাজ করতে হবে।’
চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যে শিশুদের বেশিরভাগই বেড়ে উঠবে ভুল তথ্য মিশ্রিত ডিজিটাল পরিবেশের বাসিন্দা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, তথাকথিত ‘ডিপ ফেইক’ প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে সহজেই অডিও ও ভিডিও কনটেন্টের বিশ্বাসযোগ্য নকল তৈরি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৌশল ব্যবহার করে।
চিঠিতে সতর্ক করে বলা হয়, একটি অনলাইন পরিবেশ যেখানে প্রকৃত সত্যকে ধারণাগত তথ্য থেকে আলাদা করা যায় না, সেখানে প্রতিষ্ঠান ও তথ্যের উৎসের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এটা গণতান্ত্রিক আলোচনা, ভোটারদের উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে এবং অন্যান্য নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় বা সামাজিক গোষ্ঠী সম্পর্কে সন্দেহের বীজ বপন করে।
এতে আরও বলা হয়, অনলাইনে ভুল তথ্য ইতিমধ্যে শিশুদের যৌন হয়রানি, অমর্যাদা ও অন্যান্য ধরনের নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলছে। গণতান্ত্রিক আলোচনাকে বিতর্কিত করে তুলছে। অনলাইনে ভুল তথ্য দ্বারা চালিত হয়ে টিকার প্রতি অবিশ্বাসের কারণে কিছু জনগোষ্ঠীতে এমনকি প্রাণঘাতী রোগগুলোর পুনরুত্থানের পথ তৈরি হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ নাগরিকদের এমন একটি পুরো প্রজন্ম তৈরি হতে পারে যারা কোনো কিছুই বিশ্বাস করবে না।
এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইউনিসেফ পরীক্ষামূলকভাবে মিডিয়া স্বাক্ষরতা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মন্টিনিগ্রোতে রয়েছে ইয়াং রিপোর্টার্স প্রকল্প, যার লক্ষ্য তরুণ জনগোষ্ঠীকে অনলাইনে ভুল তথ্য চিহ্নিতকরণ, বিশেষ করে কীভাবে অনলাইনে বিষয়বস্তু পরীক্ষা করা যায় তা শেখানো এবং পাশাপাশি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ভূমিকা ও কৌশলগুলো শেখানো।
ফোর বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য সহজাতভাবেই এগিয়ে থাকবে- আমরা আর এ সরল আশ্বাসের ওপর ভর করে থাকতে পারি না এবং এ কারণে সমাজ হিসেবে আমাদের অবশ্যই অনলাইনে যে মিথ্যাচারের ধারা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তরুণ জনগোষ্ঠী যাতে বুঝতে পারে যে অনলাইনে তারা কাকে এবং কোন বিষয়টিকে বিশ্বাস করতে পারে, সে জন্য আমাদের উচিত তাদের যথাযথ দক্ষতায় গড়ে তুলতে শুরু করা, যাতে তারা সক্রিয় ও সম্পৃক্ত নাগরিকে পরিণত হতে পারে।’
মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সতর্ক করে চিঠিতে বলা হয়, সিআরসি গ্রহণের পর থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে কিশোর বয়সীদের মাঝে মানসিক অসুস্থতা বাড়তির দিকে এবং তরুণদের শারীরিকভাবে অসামর্থ্যবান হয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ এখন হতাশা।
চিঠিতে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যথাযথ প্রচারণা, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, মানসিক অসুস্থতা ঘিরে যত কলঙ্ক বা কুসংস্কার রয়েছে এগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, যাতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় এবং সহায়তা প্রদান করা যায়।
পরিশেষে, চিঠিতে স্বীকার করা হয়েছে যে শিশু এবং তরুণ জনগোষ্ঠী এবং তাদের সঙ্গীরা যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সমাধান খুঁজে বের করতে তারা ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন তৈরি করেছে এবং তাদের নেতৃত্ব অনুসরণ করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ফোর লেখেন, ‘আজকের শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী জরুরি পদক্ষেপের দাবিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করছে এবং আপনার চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে শিখতে ও আকৃতি দিতে আপনাকে ক্ষমতায়িত করছে। তারা এখন একটি অবস্থান নিচ্ছে এবং আমরা শুনছি।’