সুন্দরবন
ঘূর্ণিঝড় মিধিলি: বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে কোটি টাকার মাছ
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে বৃষ্টিপাতের কারণে বাগেরহাটের সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের মাছ নষ্ট হয়ে গেছে। পচে যাওয়া ওই সব শুঁটকি মাছ থেকে এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
নষ্ট হয়ে যাওয়া মাছের পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার কুইন্টাল। এসব মাছ সাগরে ফেলে দিতে হবে বলে জানান দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন আহম্মেদ।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলি শুক্রবার দুপুরে খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। এর প্রভাবে বুধবার সন্ধ্যা থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সুন্দরবনের বিভিন্ন চড়ে বৃষ্টি ঝরতে থাকে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব এলাকায় ভারী বর্ষণ হয়। ঝড়ো বাতাস এবং বৃষ্টিপাতের কারণে সুন্দরবনের শেলার চর, নারিকেলবাড়িয়া, মাঝেরকেল্লা ও আলোরকোলে শুঁটকির জন্য শুকানো এবং কাচা অবস্থায় প্রায় ৬০ হাজার কুইন্টাল মাছ পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ওইসব মাছ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
বাগেরহাটের মোংলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদ জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। এ সময়ে সুন্দরবন উপকূল এবং সাগর মোহনায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেইসঙ্গে দমকা বাতাস বয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: শুঁটকির মৌসুম শুরু হওয়ায় দুবলার চরে জড়ো হতে পারেন ১০ হাজার জেলে
বাগেরহাটে লোকালয়ে বাঘের পায়ের ছাপে আতঙ্ক
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামে বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যাওয়ায় সেখানকার বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এলাকায় বাঘের উপস্থিতির ঘটনা বিরল হলেও মাঝে মাঝে খাবারের সন্ধানে গ্রামে ঢুকে পড়ে।
তারা উপজেলার আধা কিলোমিটার এলাকায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়ে স্থানীয় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমকে (ভিটিআরটি) খবর দেয়।
বন কর্মকর্তাদের অনুসারে, রবিবার সুন্দরবন থেকে ভোলা নদী পার হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
সোমবার সকালে বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পান স্থানীয়রা।
আরও পড়ুন: তিস্তায় ধরা পড়ল ৭২ কেজি ওজনের বাঘাইড়, ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি
ভিটিআরটি টিম, বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং কমিউনিটি টহল দল সোমবার সকাল থেকে স্থানীয়দের নিয়ে বাঘটিকে খুঁজছে, তবে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঘটিকে দেখা যায়নি।
স্থানীয় বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রামবাসীদের সতর্ক থাকতে বলেছেন।
গত ১৬ বছরে প্রায় ৫০টি বাঘ খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।
সম্প্রতি সোনাতলা গ্রামে গিয়ে ইউএনবির এই প্রতিবেদক দেখতে পান, ওই গ্রামে বাঘের বেশ কিছু পায়ের ছাপ দেখা গেছে।
শরণখোলা ওয়াইল্ড টিমের ফ্যাসিলিটেটর আলম হাওলাদার জানান, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা- বাঘটি ওই এলাকায় প্রবেশ করে সুন্দরবনে ফিরে এসেছে।
এরই মধ্যে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনা শুরু করেছেন বন কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে গত ৫ নভেম্বর সুন্দরবন পূর্ব জোনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের বিভিন্ন অংশে বেশ কিছু ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
বাঘ গণনার প্রতিবেদন জানা যাবে আগামী বছরের ২৯ জুলাইয়ের পর।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৪।
শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মাহামুদ হাসান জানান, ভিটিআরটির একটি দল এবং বন বিভাগের কর্মীরা এলাকায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখে সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন।
সুন্দরবন পূর্ব জোনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, ভিটিআরটি টিম ও বন কর্মকর্তারা গ্রামে অবস্থান করবেন।
চোরাশিকার তৎপরতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারণে এখানে এখন বাঘ হুমকির মুখে রয়েছে।
বন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব জোনে বিভিন্নভাবে ২৮টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুর্বৃত্তদের হাতে ১৪টি, গণপিটুনিতে ৫টি, স্বাভাবিকভাবে ৮টি এবং সাইক্লোন সিডরে ১টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন: সিলেটে ধরা পড়েছে ৭৯ কেজির বাঘাইড়
সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সমর্থন: মন্ত্রী
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি বাংলাদেশে পরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে কার্যকর সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সম্পদের সুরক্ষা বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, একই সঙ্গে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদের ৪৫তম বর্ধিত সভায় সুন্দরবন রক্ষায় এক দশকে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।
বুধবার (৪ অক্টোবর) সকালে সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আরও পড়ুন: শৈবাল: সুন্দরবন উপকূলে স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষকদের
পরিবেশমন্ত্রী বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে সুন্দরবনের সুরক্ষা ও উন্নয়নে বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উল্লেখযোগ্য সফলতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সরকার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবনের সুরক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করছে। এর ফলস্বরূপ সম্প্রতি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদের ৪৫তম বর্ধিত সভায় সুন্দরবন রক্ষায় এক দশকে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, সভায় পরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে কার্যকর সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সম্পদের সুরক্ষা বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানানো হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, সুন্দরবনের আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল টেকনোলজি ব্যবহার, সরকারের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান- ২০১০ সংশোধন ইত্যাদি পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনের অংশ হিসেবে ছয়টি কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়েছে।’
সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সরকার গাছ কাটা, ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবহার ও পরিবহন নিষিদ্ধ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৫৩ দশমিক ৫২ শতাংশ রক্ষিত এলাকা থেকে সকল ধরনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার বন্যপ্রাণীর প্রধান প্রজননকাল জুন, জুলাই ও আগস্ট এই ৩ মাস সুন্দরবন থেকে সকল ধরনের বনজদ্রব্য সংগ্রহ এবং পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২১ সাল থেকে রাস মেলা বন্ধ করায় সুন্দরবনে এসময় পূর্বের মতো হরিণ শিকারের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং সুন্দরবনের পরিবেশের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়েনি।
আরও পড়ুন: খুলনায় সুন্দরবন দিবস পালিত
সুন্দরবন থেকে জেলের কাটা মাথা উদ্ধার
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ থেকে ২৪ বছর বয়সী এক জেলের কাটা মাথা উদ্ধার করেছে বন বিভাগ।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, সকালে তুলাতলা এলাকা থেকে উপজেলার পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের ফারুক হাওলাদারের ছেলে শিপার হাওলাদারের মাথা উদ্ধার করা হয়।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে ট্রলারে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, ১১ জেলে দগ্ধ
বন কর্মকর্তা জানান, গত বুধবার অবৈধভাবে সুন্দরবনে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে নিখোঁজ হন শিপার। খবর পেয়ে বন বিভাগের কর্মীরা ও স্থানীয় লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করে তার মাথা উদ্ধার করে।
ঘটনাস্থলের কাছে বেশ কয়েকটি বাঘের পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। বন কর্মকর্তাদের সন্দেহ- বাঘটি জেলেকে আক্রমণ করেছিল এবং তার পুরো শরীর খেয়ে ফেলেছিল।
শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইকরাম হোসেন জানান, শিপারের মুখ বিকৃত ছিল এবং শনাক্ত করা কঠিন ছিল। তবে তার বাবা তার জামাকাপড় দেখে তার ছেলেকে শনাক্ত করেছিলেন। ছিন্নভিন্ন মাথাটি তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা (ইউডি) দায়ের করা হয়েছে বলে জানান ওসি।
আরও পড়ুন: গোয়ালন্দে সাড়ে ৫ লাখ টাকার চায়না জাল ধ্বংস, ৫ জেলেকে জরিমানা
কক্সবাজারে ট্রলারে বিস্ফোরণ: আরও ৩ জেলের মৃত্যু
সুন্দরবনে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন: ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি
সুন্দরবনের টেকসই উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের আরও গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি।
সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত ৪৫তম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশনের বর্ধিত অধিবেশনে এই সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা এবং ২০১৯ সালের যৌথ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতির প্রশংসাও করে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি।
মূল অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে- কৌশলগত পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, ডলফিন সংরক্ষণ পরিকল্পনা এবং জাতীয় তেল ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ কৌশল সম্পন্ন করা।
আরও পড়ুন: ৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়
এগুলো ম্যানগ্রোভ বনের অনন্য জীববৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য শক্তিশালী সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে।
সুন্দরবনের আরও টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকারের আরও গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহপরিকল্পনা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি। এটি কৌশলগত পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় (এসইএমপি) উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিটি আরও উল্লেখ করেছে, আগামী ২০ বছরে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উন্নয়ন থেকে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও সমষ্টিগত প্রভাব রোধ করতে অব্যাহত প্রচেষ্টা প্রযোজন। পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক এনভায়রনমেন্ট অ্যাসেসমেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ভবিষ্যতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যেন সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান ও সামুদ্রিক ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে তা নিশ্চিত করার জন্য প্রচেষ্টা রাখতে অব্যাহত রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: ৩ মাস পর পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হলো সুন্দরবন
সুন্দরবনের অরণ্যের অসামান্য সর্বজনীন মূল্যবোধের গবেষণা ও মনিটরিং সম্পর্কিত প্রতিবেদন যত দ্রুত সম্ভব পর্যালোচনার জন্য বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে জমা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশকে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে প্রভাব মূল্যায়নের জন্য গাইডেন্স ও টুলকিট ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলেছে ইউনেস্কো কমিটি। সাইটের দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এর নিকটবর্তী সমস্ত ভবিষ্যতের শিল্প বিকাশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এটি নিশ্চিত করতে হবে।
এসব পদক্ষেপ এ অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠকে কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অসামান্য সর্বজনীন মূল্যবোধকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সম্পর্কে বাংলাদেশকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারকে জানাতে হবে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় হবে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা
এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশকে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ২০২৫ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন এবং ২০২৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্টেট অব কনজারভেশন রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়
সুন্দরবনে এবার পর্যটন মওসুম শুরুর পর থেকে দেশি পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। এছাড়া ভরা মৌসুমে সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হচ্ছেন বিদেশি পর্যটকরাও।
একটানা ৩ মাস বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বনজীবী ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে সুন্দরবন।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে মাছ ধরা ও পর্যটনে ৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা ১ জুন থেকে
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে এখন পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। আগত পর্যটকদের মধ্যে বড় একটি অংশ বিদেশি।
সুন্দরী ইকো রিসোর্টের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের আতিথেয়তা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরাই আমাদের স্বপ্ন। ঢাংমারি এমন একটা গ্রাম যেখানে গড়ে উঠেছে কিছু ইকো রিসোর্ট যাদের মাধ্যমে এই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় হবে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা
সুন্দরবনের বাঘ রক্ষা ও বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বনবিভাগ। ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে “সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প” নামে প্রকল্পটি ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের জীবিত বাঘ ও মৃত বা শিকারীদের হাতে হত্যার শিকার বাঘের জরিপ, উঁচু টিলা ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। বাঘের ক্যানাইন ডিস্টেম্পার ভাইরাস নিয়ে হবে গবেষণা। সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ভিটিআরটি ও সিপিজি সদস্যদের।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মানুষের হাতে সুন্দরবনের বাঘ হত্যা কমবে এবং বাঘের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা বনবিভাগের।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে মাছ ধরা ও পর্যটনে ৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা ১ জুন থেকে
প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৫ সালের মার্চ মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের মূল কাজ হচ্ছে বাঘ ও মৃত বা শিকারীদের হাতে হত্যার শিকার বাঘের জরিপ করা।
ইতোমধ্যে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ, শিকার করা প্রাণী ও খাল জরিপ সম্পন্ন করা হয়েছে। নভেম্বর মাসে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে জরিপ শুরু হবে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যাতে বাঘগুলো আশ্রয় নিতে পারে এজন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ১২টি উঁচু টিলা তৈরি করা হবে। শরণখোলা রেঞ্জের ধানসাগর এলাকায় বাঘের আশ্রয়স্থলে দুর্বৃত্তের আগুন নিয়ন্ত্রণে একটি টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। এই টাওয়ার থেকে ওই এলাকায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে লাগা আগুন দেখে দ্রুত নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে পারবেন বনরক্ষী ও স্বেচ্ছাসেবকরা।
এ ছাড়া সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে যাতে বাঘ প্রবেশ না করতে পারে সেজন্য প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলোনের বেড়া (ফেন্সিং) দেওয়া হবে। এটি সফল হলে পরে ৬০ কিলোমিটার ফেন্সিং করা হবে।
প্রকল্পের আওতায় বাঘের ক্যানাইন (মুখে থাকা সামনের বড় দুটি দাঁত) ডিস্টেম্পার ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করা হবে। এজন্য সুন্দরবন থেকে বাঘের মল সংগ্রহ করা হবে। এই মলের মাধ্যমেই বাঘের দাঁতে সংক্রমিত ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করবেন দেশীয় গবেষকরা।
অন্যদিকে সুন্দরবনে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ার ফলে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রাণহানী নিরসনে ৩৪০ জন ভিটিআরটি (ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম) সদস্য ও ১৮৪ জন সিপিজি (কমিউনিটি পেট্রল গ্রুপ) সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
এর সঙ্গে লোকালয়ে আসা দুটি বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রাকার লাগানো হবে। বাঘের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য বনকর্মী-কর্মকর্তা সিপিজি ও ভিটিআরটি সদস্যদের দেওয়া অ্যাপস দেওয়া হবে।
তারা এই অ্যাপসের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে বাঘের গতিবিধি দেখতে পারবেন। এর ফলে লোকালয়ে বাঘ এলে তারা দ্রুত সুন্দরবনে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারবে।
সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: ৩ মাস পর পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হলো সুন্দরবন
এ ছাড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নে, ড্রোন ক্যামেরা, স্যাটেলাইট ট্রাকার, নাইলোনের বেড়া, জিপিএস, বাঘ অজ্ঞানের জন্য ট্রাংকুলাইজিং গান, ক্যামেরা, ভিটিআরটি ও সিপিজি সদস্যদের জন্য পোশাক ও প্রশিক্ষণ উপকরণসহ বেশকিছু আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে।
প্রকল্প শেষে প্রকল্পের সব কার্যক্রম নিয়ে ভিডিও ডকুমেন্টারি ফিল্ম করা হবে। যা পরে সুন্দরবন ও সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার দায়িত্বে আসা কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগবে।
তবে প্রকল্প প্রস্তাবে বাঘ না থাকা এলাকায় বাঘ স্থানান্তরের মাধ্যমে বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণের কথা ছিল। তবে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের সময় বাঘের উপস্থিতি পাওয়ায় বাঘ না থাকা এলাকায় বাঘ স্থানান্তরের বিষয়টি প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে “সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প”- এর আওতায় সুন্দরবন ও বাঘ নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। এই প্রশিক্ষণের ফলে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাঘ রক্ষায় কাজের আন্তরিকতা বাড়বে বলে জানিয়েছেন তারা।
সুন্দরবন সুরক্ষায় কাজ করা ভিটিআরটির সদস্য মোরেলগঞ্জ উপজেলার গুলিশাখালী এলাকার লাকি বেগম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাঘ ও সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় কাজ করি। আমাদের এ বিষয়ে একাডেমিক জ্ঞান খুবই কম। শুনেছি আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই প্রশিক্ষণ দিলে আমরা আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারব।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ খুব ভালোভাবে চলছে। সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের বাঘ জরিপের জন্য ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সিপিজি, ভিটিআরটি প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হবে। সর্বোপরি বাঘ সংরক্ষণ ও বাঘ বাড়ানোর জন্য বেশকিছু কাজ করা হবে।
এ ছাড়া পুরো প্রকল্পের কার্যক্রম ভিডিও করা হবে। যা দিয়ে ভিডিও ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করা হবে। এই ফিল্মটি পরবর্তীকালে সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষায় কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগবে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে গত ৫ বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে
৩ মাস পর পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হলো সুন্দরবন
একটানা তিন মাস বন্ধ থাকার পর শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে বনজীবী ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে সুন্দরবন।
ইতোমধ্যে জেলে, ট্যুর অপারেটর, লঞ্চ ও বোট চালকেরা সুন্দরবনের প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকার ইকো কটেজগুলোও প্রস্তুতি নিচ্ছে পর্যটক বরণের।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে মাছ ধরা ও পর্যটনে ৩ মাসের নিষেধাজ্ঞা ১ জুন থেকে
সুন্দরী ইকো রিসোর্টের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পর্যটকদের বরণে সব আয়োজন শেষ করেছি আমরা। রিসোর্টে বসে সুন্দরবনের পাখিদের ডাক, পায়ে হেঁটে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য উপভোগ, নিরাপত্তার সঙ্গে নিশিযাপন এবং মানসম্মত খাবারগ্রহণ প্রভৃতি আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার ডালি সাজিয়ে আমরা অপেক্ষায় আছি পর্যটকদের।’
মোংলা ঘাটের ট্রলার চালক রুবেল হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মোংলা থেকে করমজল পর্যন্ত ট্রলারে দর্শনার্থী বহন করেই আমরা জীবিকা নির্বাহ করতাম। সুন্দরবন বন্ধের তিন মাস মোটামুটি বেকার অবস্থায় ছিলাম। আশাকরি আবারও সেই কর্মজীবনে ফিরতে পারব। এজন্য ট্রলার পরিস্কার ও সাজ-গোজেরও কাজ করেছি।’
এদিকে, টানা তিন মাস বন্ধ থাকায় প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরে উঠেছে সুন্দরবন। দর্শনার্থী, মৎস্যজীবী ও বনজীবীদের প্রবেশ না করায় প্রাণিকূল তাদের নিজের ইচ্ছেমত বিচরণ করেছে। গাছগাছালিও শাখা মিলেছে নিজেদের মত করে।
এরআগে, বন্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম থাকায় ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে সকল প্রকার বনজীবী ও দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে গত ৫ বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে
সুন্দরবনে গত ৫ বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে গত ৫ বছরে বাঘের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে ১১৪ টিতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ৫ বছরে সুন্দরবনের বাঘ বেড়েছে অনেক।
সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ রয়েছে বলে ক্যামেরা ট্রাকিং জরিপে উঠে এসেছে।
সুন্দরবনে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা ও চোরা শিকারীদের দৌরাত্ম্য কমা এবং বনবিভাগ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনই হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসভূমি। তবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমিকে তাদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সুন্দরবনকে বন্যপ্রাণীদের জন্য নিরাপদ করা গেলে দ্রুত বাঘের সংখ্যা আরও বাড়বে।
বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ গণনার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে পশ্চিম বিভাগের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর থেকে পূর্ব বিভাগে গণনার কাজ শুরু করা হবে। তবে পশ্চিম বিভাগে ক্যমেরা ট্র্যাকিং শেষে বাঘ বৃদ্ধি পাওয়ার আশা করছে বন বিভাগ।
সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের অবাধ বিচরণ ও প্রতিনিয়ত বাঘের শাবকের দেখা মিলছে বলে জানিয়েছে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলে ও বাওয়ালীরা।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালে জরিপে ৪২৫টি এবং এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়।
১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানান।
২০০৪ সালে জরিপে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি।
১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনের বাঘের মুখ থেকে বেঁচে ফিরলেন আব্দুল ওয়াজেদ
সুন্দরবনে বন্ধ হচ্ছে না হরিণ শিকার
বন্যপ্রাণী শিকার আইন প্রণয়নের পরও বন্ধ হচ্ছে না সুন্দরবনের হরিণ শিকার। মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে অনেক শিকারি হরিণ শিকার করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এতে একদিকে যেমন সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ হরিণ অস্তিত্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ হওয়ায় বনের ইকো সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে হরিণের মাংস-গুলিসহ এক ‘শিকারি’ আটক
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের হরিণসহ সব বন্য সম্পদ রক্ষায় আরও কঠোরভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আবারও খুলনার কয়রা থেকে হরিণের ৫৩ কেজি মাংস উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (১৯ জুলাই) ভোরে উপজেলার ৪ নম্বর কয়রায় শাকবারিয়া খালের পাশে অভিজান চালিয়ে এ মাংস উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া খালে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায় পাচারকারী।
উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য সব চেয়ে বেশি।
গত ৩ মাসে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৩২ কেজি হরিণের মাংস, একটি গলাকাটা হরিণ, ৫টি চামড়া ও মাথা জব্দ করে প্রশাসন।
এ সময় মামলা হয়েছে ১০টি, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬ জন। এ ছাড়া গত এক বছরে এর সংখ্যা ৫০ জনের বেশি।
সম্প্রতি ৩ মণ হরিণের মাংসসহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল কয়রা উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নির্বিচারে হরিণ নিধনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পায়।
জানা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই চিত্রা হরিণ। কিন্তু দিনের পর দিন প্রশাসনের রেড এলার্টসহ বিভিন্ন অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হরিণ নিধন করে যাচ্ছে পাচারকারীরা।
আরও পড়ুন: ভোলায় ১৫ কেজি হরিণের মাংস জব্দ, গ্রেপ্তার ১
স্থানীয়রা বলছে, সুন্দরবনসংলগ্ন উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় দাম কম হওয়ায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে হরিণ শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেকেই অগ্রিম ‘দাদন’নিয়ে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে চোরা-শিকারিরা।
তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে ‘এজেন্ট ব্যবসায়ীদের’। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম, আবার কখনো মাংস এনেও বিক্রি করা হয়।
এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে হরিণ শিকার করছে একটি চক্র। এতে সুন্দরবনে দিন দিন কমে যাচ্ছে হরিণের সংখ্যা।
সম্প্রতি সময়ে হরিণ শিকার বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে বনদস্যু আটক হয়ে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হচ্ছে। সেখানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে।
এর পেছনে বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
এ ছাড়া যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া জব্দ হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার হয়।
অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির আরও বলেন মাঝেমধ্যে দুই-একটা অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা জব্দ হলেও মূল চোরাশিকারি ও পাচারকারীরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েক দিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলায়মান গাজী বলেন, সুন্দরবন প্রভাবিত কয়রার গ্রামগুলোতে বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষের বসবাস।
এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র নির্বিচারে সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মমিনুর রহমান বলেন, সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক অপরাধ প্রবণতার চিত্র তাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
তিনি আরও বলেন, বিশেষত হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগের।
তারপরও হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে। র্যাব, কোস্ট গার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে এখন বনে হরিণ শিকারের সুযোগ কম।
আরও পড়ুন: খুলনায় ১২০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ, আটক ১
মোহসিন বলেন, বনে জলদস্যুরাই বেশি হরিণ শিকার করে খেত। ২০১৮ সালে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় পর এবং গত কয়েক বছর রাসমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বনে হরিণ শিকার কমেছে।
তা ছাড়া সাম্প্রতিক বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণার ফলে চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য দিতে উৎসাহিত হয়েছে।
এখন মাংসসহ হরিণ শিকারি বেশি ধরা পড়ছে।