হাইকোর্ট আরও বলেছেন, ‘জবানবন্দিতে আসামিরা মেয়েটিকে হত্যা করার কথা তাহলে কি শখ করে বলেছে? এটা দুর্ভাগ্যজনক। অভাগা তো হলো এদেশের জনগণ।’
নারায়ণগঞ্জের ওই ঘটনায় বিচারিক অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর শুনানির এক পর্যায়ে বুধবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালত শুনানিকালে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের এই একটি ঘটনাকে পুরো পুলিশ বাহিনীর গায়ে মাখানোর দরকার নেই। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবেই তাদের দেখা উচিত। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে তা থেকে কিভাবে উত্তরণ করা যায়, সেটা পুলিশ বাহিনীকে ভেবে দেখা উচিত।
আদালত আরও বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যদি পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় যদি কোনো ব্যক্তিকে একটা কটু কথাও বলা হয় তাহলে সেটা অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আদালত আগামী বুধবার ফের শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
গত বছরের ২৪ আগস্ট ‘ধর্ষণের পর নদীতে মরদেহ ফেলে দেওয়া স্কুলছাত্রীর ৪৯ দিন পর জীবিত প্রত্যাবর্তনের’ খবর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়।
ঘটনার বিবরণী থেকে জানা যায়, গত ৪ জুলাই পঞ্চম শ্রেণির ওই ছাত্রী নিখোঁজ হয়। গত বছরের ৬ আগস্ট নিখোঁজ স্কুলছাত্রীর বাবা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলার পর পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব ও খলিল নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
স্বীকারোক্তিতে তারা বলেন, ওই ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। জবানবন্দি নেওয়ার পর আসামিদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু ২৩ আগস্ট ওই ছাত্রীকে খুঁজে পাওয়া যায়। এ অবস্থায় ছাত্রীর বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা মামলা এবং মামলা পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা, যৌক্তিকতা ও মামলার নথি তলব চেয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট পাঁচ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিভিশন আবেদন করেন।
পরে ২৭ আগস্ট ওই রিভিশন আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে ছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় সাবেক তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন হাইকোর্ট। মামলার নথিসহ হাজির হতে নির্দেশ দেন বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তাকে। সেই অনুসারে তারা হাজির হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাখ্যা দেন। এরপর আদালত গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন রাখেন। পরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিচারিক অনুসন্ধানে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী বিচারিক অনুসন্ধানের প্রতিবেদন গত ৫ জানুয়ারি আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়, ‘...তবে পুলিশ হেফাজতে (পুলিশ রিমান্ডে) থাকাকালীন সময়ে তদন্ত কর্মকর্তা মো. শামীম আল-মামুন, এসআই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা এর বিরুদ্ধে আসামিদের মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করার অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।’
বুধবার এই প্রতিবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে পুলিশের পক্ষে অংশ নেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, রিভিশন আবেদনের পক্ষে অ্যাডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী।
আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, বিচারিক তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পুলিশ বাহিনীর ওপর একটা দোষ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। তিনি তার আওতার মধ্যে থেকেই আসামি গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়েছেন। আসামিদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। কারণ আসামিরা জুডিসিয়াল কমিটির বাইরে আর কারো কাছে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেননি।
আদালত বলেন, তাহলে আমরা কি ধরে নেব জবানবন্দিতে আসামিরা যে বক্তব্য দিয়েছে সেটা সত্য নয়। ভিকটিমকে মেরে নদীতে ফেলার যে জবানবন্দি তাতে আসামিদের স্বার্থ কি?
বেঞ্চের জোষ্ঠ বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, দেশের মানুষ ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেখতে চেয়েছিল। এইজন্য কি সকলেই ফাঁসিতে যেতে চায়! এ বিষয়ে আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আদালত এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনবেন জানিয়ে আগামী বুধবার পরবর্তী দিন ধার্য করেন।