%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD%EF%BF%BD
গণতন্ত্রের মোহমুক্তি
কিছুক্ষণ আগে কাঠমান্ডু থেকে আমার একজন প্রিয় জুনিয়র একটা মজার টেক্সট পাঠিয়েছে। যার মর্মার্থ দাঁড়ায় রাশিয়া যখন জর্জিয়া বা ইউক্রেন দখল করে নেয় তখন তা হয় আগ্রাসন। যখন ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান অভিযান পরিচালিত হয় তখন তা হয় গণতন্ত্র ও মুক্তির জন্য যুদ্ধ। সবই যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত মিডিয়ার কারসাজি।
কিয়েভে রাশিয়ান সৈন্যরা প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ ইউক্রেন রাশিয়ান আগ্রাসন ঠেকাতে মিত্রদের সাহায্য পায়নি যার উপরে অনেক ভরসা ছিল।
ইউক্রেন আসলে কাকে চায়? রাশিয়া কিংবা আমেরিকা? ইউক্রেন ছিল সমাজতান্ত্রিক ঘরানার দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের রিপাবলিক গুলোর মাঝে ইউক্রেন ছিল ধনী ও শক্তিশালী যে রাশিয়ান বলয়ের বাইরে যায়নি। ন্যাটোতেও যোগ দেয়নি। ওরা মিলেমিশে ছিল। এতে রাশিয়ান সীমান্ত হয় নিরাপদ। এত বছর পর আমেরিকা ও মিত্ররা চাইছে ইউক্রেন রাশিয়া মুক্ত হোক। রাশিয়ান নিরাপদ সীমান্ত ভেঙে যাক। ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করলে আমেরিকার চির প্রতিদ্বন্দ্বীকে নুতন অবস্থান থেকে হেনস্তা করা সহজ হবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে রিপাবলিকগুলো স্বাধীন হয়ে যায় এবং কিছু কিছু দেশ ন্যাটোতে যোগ দেয়। তখন আমেরিকা ইউক্রেনকে ন্যাটোতে গ্রহণ না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপেক্ষিত হওয়াটা বর্তমান ক্রাইসিসের কারণ।
ধনতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থায় বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুখ স্বাচ্ছন্দের প্রাচুর্যের সংবাদ সমাজতান্ত্রিক শিবিরে মাঝে মাঝেই নাড়া দিতো। ফলে কমিউনিজমের বেড়াজাল ভেঙে কবে মুক্ত হতে পারবে তা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বাসীদের আকাঙ্ক্ষা। এক সময় সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। রিপাবলিক গুলো স্বাধীন হয়ে পড়ে। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলো প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ান বলয়ে থেকে যায়। কট্টর কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রধানগণ খোলাখুলিভাবে রাশিয়ার সাহায্যে ক্ষমতায় রয়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু হয়।
রিপাবলিকগুলো স্বাধীন হলেও একের ওপর অন্যের নির্ভরতা রয়ে যায়। সোভিয়েত প্রথায় কোন রিপাবলিক এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ একটা টেলিফোন সেটের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভিন্ন ভিন্ন দেশে তৈরি হয়। একক প্রয়োজনে কেউ কিছু উৎপাদন করতে পারে না। স্বাধীনতার পর এসব সমস্যা প্রকট হয়ে পড়ে।
রাশিয়ান ভাষা হয়ে পড়ে সার্বজনীন। এছাড়া ব্যক্তি যোগাযোগ হয়ে পড়ে কঠিন। জনসংখ্যাকে কোনো গোত্র, এলাকা ভিত্তিক পরিচয়ে যাতে না রাখা হয় সে জন্যে সারা ইউনিয়নে বিভিন্ন দল বা গোত্রকে জোরপূর্বক ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়াটা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়।
এবার আসি বিলুপ্ত সোভিয়েতের গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রাপ্তি কতটুকু।
পৃথিবী যখন দুই মেরুতে অবস্থান করছিল তখন আমেরিকা ও ধনবাদীরা কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নকে উচ্চ মূল্যায়ন করতো। তখন ডলার ও রুবল সমমানের ছিল। ক্ষেপণাস্ত্র, মহাকাশ গবেষণা ইত্যাদিতে উচচ মানের ছাপ রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা বার বার স্বাধীনতা ও মুক্তির পানে তাকিয়ে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর দেখা গেল এতদিন রাশিয়াকে উচ্চ মূল্যায়ন করা হয়েছিল।
ধনবাদীদের ব্যবসা বাণিজ্যের দরজা খুলে গেল। গ্রামে গঞ্জে, পাহাড় জঙ্গলে চুইং গাম, পেপসি, কোকাকোলা পৌঁছে গেল। বিখ্যাত রাশিয়ান ভদকার পরিবর্তে ডেনিশ, ফিনিশ, আইরিশ আরো অনেক ব্র্যান্ডের ভদকা বাজার দখল করে নিল। নব্য গণতন্ত্রে জনগণ দিশাহারা। চারিদিকে অস্ত্রের ঝনঝননি। মাফিয়া চক্রের সন্ত্রাস। অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দেশ সমাজ কোন নিয়মে চলবে সবাই দ্বিধান্বিত। গণতন্ত্র কোথায়? অনেকেই ফিরছেন নিজ রিপাবলিকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতই খারাপ যে তারা আদৌ পৌঁছাতে পারবে কি না অনিশ্চিত।
রাশিয়ান আর্মি বিভিন্ন দেশে মোতায়েন রয়েছে। সদস্যগণ ও ভিন্ন ভিন্ন জাতির।
কমিউনিস্ট দেশগুলো এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে অনুমতি লাগে। সবার পাসপোর্ট আছে। কিন্তু পাবলিকের বিড়ম্বনা। হারিয়ে যাওয়া বা গুম হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
একটা সিস্টেমের ভেতর দিয়ে আসা একটা জাতি হঠাৎ করে নুতন নিয়ম মেনে চলতে পারে না। তাই জনগণের মনে প্রশ্ন, গণতন্ত্র কোথায়? মুক্তি কোথায়? সমৃদ্ধি কোথায়? তাহলে পশ্চিমারা কি ধোঁকা দিয়েছে? কায়দা করে প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দেয়া হয়েছে?
সাবেক সোভিয়েত ব্লকের কিছু কিছু দেশ ন্যাটো তে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ড নয় বলে যথাযথ মূল্য দেয়া হয়নি। ইচ্ছা থাকলেও কূটনৈতিক কারণে সেসব দেশ এখন ন্যাটো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সাধারণ জনগণের ও গণতন্ত্রের মোহ মুক্তি ঘটেছে। সাবেক কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় ফিরে না গেলেও নুতন কোনো ব্যবস্থায় তারা রাশিয়ান নৈকট্যে স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা শক্তি প্রয়োগে যোগ দিতে পারে। এ কারণেই পুতিন বাহুতে শক্তি খুঁজে পাচ্ছেন। কৌশলগত কারণে চীন রাশিয়ানদের পক্ষ নেয়ায় ন্যাটো জোটের নুতন করে হোম ওয়ার্ক করতে হচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: সমস্যা কি শুধুই ইউক্রেনের?
পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে উচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ পুতিনের, বাড়ছে উত্তেজনা
বেলারুশ সীমান্তে হবে ইউক্রেন ও রাশিয়ার বৈঠক
সমস্যা কি শুধুই ইউক্রেনের?
ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থা দৃশ্যতঃ রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করা, স্বাধীনভাবে চলার শক্তি অর্জন করা বোঝায়। ইউক্রেন সে চেষ্টাই করছে। সুখে দুঃখে আপনজনের মত আমেরিকা এগিয়ে এসেছে। ওরা বোঝাতে চাচ্ছে কূটনীতি, সামরিক হুমকি সব কিছু দিয়ে রাশিয়াকে ইউক্রেনের কাছে ঘেঁষতে দেবে না। আধুনিক অস্ত্র এবং সৈন্য ও ন্যাটো (উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট) মিত্ররা সাথে থাকবে। তারপরও ইউক্রেন কি রাশিয়াকে ঠেকাতে পারবে?
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া অস্ত্র ও সেনা মোতায়েন করেছে। চীন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কমিউনিস্ট পন্থী। দেশের জনগণ ও বিভক্ত। শতকরা ৮০ ভাগ লোক ইউক্রেনিয়ান ভাষায় কথা বললেও রাশিয়ান ভাষা সবার জানা যা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কালচার ছিল। এখন যেকোনো মুহূর্তে বিমান হামলার মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে বলে মিডিয়া জানাচ্ছে । অপর দিকে বাইডেন ও পুতিন সংলাপের পথে এগোচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিজয়ী মিত্র শক্তি দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো ন্যাটো নামীয় সামরিক জোট গঠন করে। উদ্দেশ্য জোটের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখা তথা সমাজতান্ত্রিক আগ্রাসন থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা।
অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে নিয়ে ওয়ারশ প্যাক্ট নামীয় সামরিক জোট আত্মপ্রকাশ করে। দুই সামরিক জোটের শক্তির টানাপোড়েনে বিশ্ব বার বার অস্থির হয়েছে, শান্তির বার্তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেকে নিরাপদ রেখে অন্যের দুর্গে হানা দেয়ায় ব্যস্ত। এদিক দিয়ে আমেরিকা তার সীমান্ত নিরাপদ করেছে। একদিকে মেক্সিকো অন্য দিকে কানাডা।
রুশ বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিবেশী দেশগুলোকে সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত করে একটি নিরাপদ সীমান্ত বলয় সৃষ্টি করে। ভাষা, সংস্কৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আধিপত্যবাদের সৃষ্টি হয়।
১৯৯১ এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে এর রিপাবলিক দেশগুলো স্বাধীন হয়ে যায়। কমিউনিস্ট ঐক্যমত ধরে রাখার জন্য সিআইএস (কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্টে স্টেট) নামীয় সংস্থার সৃষ্টি হয়। গুরুত্বপূর্ণ রিপাবলিক সমূহকে নিয়ন্ত্রণে রাখে রাশিয়ান ফেডারেশন। তার মধ্যে ইউক্রেন ছিল অন্যতম। সোভিয়েত ইউনিয়নের রিপাবলিক সমূহের মাঝে ইউক্রেন ছিল সমৃদ্ধশালী। পারমাণবিক সাইলো ও অন্যান্য স্থাপনাগুলো এখানেই অবস্থিত। সে জন্যে নিরাপদ সীমান্তের জন্য ইউক্রেনকে হাতে রাখা রাশিয়ার অতি প্রয়োজন।
অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফল ভোগ করতে থাকে ইউরোপ ও ন্যাটো দেশগুলো। মার্কিন পণ্য বিশাল কমিউনিস্ট অঞ্চলে প্রবেশ করে। আমেরিকা বিশ্ব নেতৃত্বের একক কর্তৃত্ব লাভ করে।
ওয়ারশ জোট ভেঙে গেলে আমেরিকা এই জোট থেকে কিছু রাষ্ট্রকে ন্যাটো সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেয়। অনেক দেশ নুতন জীবনের আশায় পশ্চিমা সুখ ও সমৃদ্ধির লোভে জোটে যোগ দেয়। নব্য যোগ দেয়া সশস্ত্র বাহিনীর বেশির ভাগই ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এসব দেশগুলোর যুদ্ধকালীন মোতায়েন কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে করা হয়। রাশিয়ান বলয় খর্ব করাই পূর্ব ইউরোপের সাবেক কমিউনিস্ট দেশগুলোকে আমেরিকা সাহায্য সহায়তা করে আসছে। ইউক্রেন সুকৌশলে ন্যাটো যোগদান এড়িয়ে যায়। এখন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব, নিরাপদ সীমান্ত, রাশিয়ান আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি ও বিবিধ কর্মকাণ্ডে আমেরিকা তার মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে।
রাশিয়ান ফেডারেশন নিজ সীমান্তে আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের ঘেঁষতে দেবে না। রাশিয়ার ভূখণ্ডে লড়তে এসে অনেক দেশ পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে।
দুটি বৃহৎ শক্তি পরস্পরের সাথে লড়বে না। তারা লড়াইটা অন্যের মাঠে লড়তে ভালো বাসেন। সম্পদ লুটের সম্ভাবনা থাকলে হয়তো আমেরিকা মিত্রদেরকে দিয়ে এ কাজটা করাবে। এর মাঝে বাইডেন পুতিনের সাথে সংলাপ বন্ধ দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সাথে শলা পরামর্শ করছেন। রুশ বাহিনীও সীমান্তে দহরম মহরম দেখিয়ে পেছনে সরে গেছে।
দেখা যাক, সমস্যাটা কার? আমেরিকা, রাশিয়া নাকি ইউক্রেনের।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-১
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি- ২
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-৩
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-৩
লাশের স্তূপ
ডিসেম্বর মাসের চূড়ান্ত যুদ্ধের আগেই মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের কার্যত বিভিন্ন সুরক্ষিত ক্যাম্পে কোণঠাসা করে রাখে। যৌথবাহিনী সীমান্ত পোস্টগুলো এড়িয়ে গভীরে আঘাত করার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। চৌদ্দগ্রামের থানা ক্যাম্প এড়িয়ে ভারতীয় বাহিনী এবং ১০ ইস্ট বেঙ্গলের যৌথ বাহিনী রাধানগর (ভারতীয় থানা) দিয়ে লাকসাম অভিমুখে যেতে থাকে। যুদ্ধকালীন সম্পূর্ণ সময় চৌদ্দগ্রামের আশপাশ এলাকার গ্রামগুলো জনমানব শুন্য ছিল।
ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের পূর্ব দিকের লোকেরা ভারতে শরণার্থী হয়। সম্ভাব্য যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে সবাই আরও পশ্চিমে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। রাতের বেলায় ভয়াবহ গোলাগুলি। কোথায় কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারলাম না। সকাল হল। আলো হওয়ার পর দেখি আমরা চৌদ্দগ্রাম ছেড়ে পরিকুট (লাকসাম চৌদ্দগ্রাম থানার সীমা রেখা) এর কাছাকাছি। দেড়কোটা ও ছাতিয়ানি গ্রাম আমার পরিচিত। আমার খালার বাড়ি। ছোটবেলায় কত দূর মনে হতো। এটাই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র।
পাকিস্তানি সেনাদের লাশের ছড়াছড়ি একের উপরে অনেকগুলো। এভাবে মারা গেলো কিভাবে? অনেকের গায়ে কাপড় নেই। কারো গায়ে সিভিল পোশাক। তারা কি সিভিল পোশাক পরে আপাতত জান বাচাতে ব্যস্ত ছিল? কারও মুখ ও চোয়াল ভাঙা, হাত পা নেই । গ্রামের দু’একজন লোকের দেখা পেলাম। বাকিরা কোথায় গেছে কেউ জানেনা। স্থানীয় লোকেরা লাশ দেখছে আর মন্তব্য করছে। এক জটলায় দেখলাম কয়েকটি উলঙ্গ লাশ নিয়ে কথা বার্তা হচ্ছে। একজন মন্তব্য করলো দেখ দেখ কয়েকটা লাশের পুরুষাঙ্গে গুলি লেগেছে। হারামির পুত মনে হয় মেয়েদের উপর বেশি অত্যাচার করেছে। এ কথা বলেই একটা বাঁশ দিয়ে লাশগুলোকে পেটাতে শুরু করলো। জানিনা তার হয়তো ক্ষোভ আছে। আমাদের কমান্ডার সামনে এগিয়ে যেতে বললেন। আবার শুরু হল চলা।
যুদ্ধবন্দী ১৯৭১
একে একে সীমান্ত শহরগুলো শত্রু মুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে কুমিল্লা ও লাকসামে জয় বাংলার পতাকা উড়ছে। পথে ঘাটে লাশ ছড়িয়ে আছে। রাস্তাঘাট ভারতীয় সেনাদের তদারকিতে মেরামত চলছে। পাবলিককে ধরে ধরে এনে বাধ্যতামূলক শ্রমে লাগানো হচ্ছে। যুদ্ধের সাপ্লাই রুট ঠিক রাখতে রাস্তা, সেতু মেরামত জরুরি। গ্রামে গঞ্জের জঙ্গলে যে সব পাকিস্তানি সেনারা লুকিয়ে ছিল তারা বের হয়ে আসছে। জনতা ধরে এদের লাঠি পেটা করছে। যাহোক সচেতন জনগণের সহায়তায় তাদেরকে ভারতীয় সেনাদের হাতে তুলে দেয়া হল। কোন যুদ্ধবন্দী ক্যাম্প নেই। এদেরকে স্কুলের মাঠে বা কোন খোলা যায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। শীতের সকালের রোদ পোহাচ্ছে। পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। পালালে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জীবন দিতে হবে।
প্রশিক্ষণকালে আমাদেরকে শেখানো হয়েছিল যুদ্ধবন্দী কিভাবে হ্যানডলিং করতে হয়। তারা জেনেভা কনভেনশনের কি কি সুযোগ সুবিধা পাবে ইত্যাদি। তাদেরকে কিভাবে নিরাপত্তা দিতে হবে। এক ঘরে কতজন থাকবে, তাদের খাবার কি হবে তারা দৈনন্দিন কি কি কাজ করবে ইত্যাদি। যুদ্ধবন্দীদের দ্বারা অনেক দেশে অনেক বড় বড় স্থাপনা তৈরি হয়েছিল। আমাদের খুব কাছেই থাইল্যান্ডে ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’ ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দীদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মস্কোর রেড স্কয়ারে যে দর্শনীয় গির্জা আছে সেগুলোও যুদ্ধবন্দীদের দ্বারা নির্মিত। এরূপ আরও অনেক আছে।
যুদ্ধবন্দীদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাওয়ারও নিয়ম আছে। বিশেষ করে নিরাপত্তার বিবেচনায়। গাড়ী, ট্রেন, জাহাজ ও পদব্রজে যাওয়ার ভিন্ন ভিন্ন নিরাপত্তা নির্দেশ আছে। পদব্রজে গমনকাররীরা দলবদ্ধ হয়ে মার্চ করে এগোতে থাকে। কয়েকজন অস্ত্র হাতে চারিদিকে নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে। এরূপ একটি দলের সাথে আমরা যাচ্ছিলাম। পাকিস্তানি সেনারা ক্লান্ত ও পরাজয়ের গ্লানিতে মৌন। এদের সাথে সাথে উৎসুক জনতাও চলছে। কয়েকজন যুবক এসে তাদের মারধর করতে চাইছে। এক বুড়ো বটি নিয়ে এগিয়ে আসছে আর বলছে, এই বেটা আমার সব ডাব মুরগি খেয়ে শেষ করেছে। আমার মুরগির টাকা দে, ছাগলের টাকা দে। ভারতীয় সেনারা ওদেরকে সরিয়ে দিচ্ছে। যুদ্ধবন্দীরা মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনের গ্রামের লোকেরা সরে যাচ্ছে। আবার নতুন গ্রামের লোকেরা যোগ দিচ্ছে। কিছু উৎসাহী যুবকেরা দৌড়ে এসে যুদ্ধবন্দীদের কাছে এসে জোর গলায় জয় বাংলা বলে সুর তুলছে আর দূর থেকে থুথু দিচ্ছে। এমন সময় যুদ্ধবন্দীদের মাঝে থেকে এক সেনা বলে উঠলো, ‘কেয়া জয় বাংলা? ইয়েতো হিন্দুস্তান হো গিয়া’।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-১
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি- ২
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি- ২
কাঁঠালিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে অম্পিনগর
২৪ এপ্রিল ১৯৭১। কাঁকড়ি নদীর পশ্চিম তীরে বাজার সংলগ্ন বি এস এফ ক্যাম্প। পূর্ব তীরের জঙ্গলে আমাদের ক্যাম্প। উঁচু পাহাড়ের উপরিভাগ সমতল। এখানেই তাবু ফেলে থাকার জায়গা করা হয়েছে। থাকা বলতে একটা তাবুতে গাদাগাদি করে কোনোমতে শোয়ার ব্যবস্থা। অনেকে এক কাপড়ে এসেছে। বেশিরভাগ যুবকদের হাতে টাকা পয়সা নেই। সহায় সম্বলহীন ভাবে ঘর বাড়ি ছেড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ক্যাম্পে উঠে এসেছে। পরিবার পরিজনরা হয়তো শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নিয়েছে।
ক্যাম্পটি পরিচালিত হয় বিএসএফ এর তত্ত্বাবধানে। তদারকি করেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা। ক্যাম্পে রিপোর্ট করার পর আমাদের নাম ঠিকানা লেখা হল। যেহেতু আমার কিছুটা লেফট রাইট জানা ছিল, সেহেতু আমাকেই আমাদের দলনেতা বানিয়ে দেয়া হল। মোস্তফা ভাই এবং অন্য বড় ভাইরা থাকতে আমাকে দল নেতা হতে হল। আগা মাথা কিছু বুঝি না। কেউ আমার কথাও শোনে না। নাম ঠিকানার তালিকা বানিয়ে নিয়ে বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে অফিসারকে দিতে হবে।
কাঁকড়ি নদীর হাটু পানি ডিঙ্গিয়ে বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে অপেক্ষা করছি। এই নদীর পানি আমাদের খাওয়া গোসল এবং সকল কাজের সাথী। পরিস্কার পানি। কিছুক্ষণ পর অফিসার মেসে ডেকে নেয়া হল। মেসের বাইরে নদীর পার ঘেঁষে লনে ইজি চেয়ারে অফিসার বসে আছে। সাদা হাফ প্যান্ট জঙ্গল বুট সাদা টি শার্ট পরা স্মার্ট অফিসারকে সালাম দিলাম। মনে মনে ভাবছি হিন্দুকে নাকি মুসলমানের সালাম দেয়া যায় না। গুনাহ হলো না তো? ভদ্র লোকের মার্জিত ব্যবহার। আমার সমস্যা হলো হিন্দি ও ইংরেজি বুঝি। কিন্তু বলতে গেলে আটকে যায়। ভালো বলতে পারি না। অফিসার তার সুন্দর কথা বার্তায় মুগ্ধ করলো। জড়তা কেটে গেলো।
ক্যাম্পে ফেরত এলাম। একশটা অভিযোগ। এটা নেই, ওটা নেই, কিছু পাইনি, খাবার পাইনি। সকলের কিছু নাইয়ের মাঝেও এটা ওটা হারানোর অভিযোগ। সামাল দিতে পারছি না। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ‘পাগল ধরে বউ বানানো’। আমার মত জুনিয়র গোবেচারাকে টিম লিডার বানিয়ে শাস্তি দেয়া হচ্ছে কেন বুঝলাম না।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-১
বিকেলে আমাদের বাঙালি অফিসাররা ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন। তিনজন। একজনের হাতে ব্যান্ডেজ । আমাদের দলে ফিসফিসানি শব্দ। ব্যান্ডেজ হাতে অফিসার হলেন ক্যাপ্টেন হায়দার। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর চৌকশ কমান্ডো। অত্যন্ত উঁচু মানের পেশাগত সৈনিক। কমান্ডোরা এত দুর্ধর্ষ যে তারা আকাশে ওড়া থেকে পাতাল ফুড়ে নিচে নামতে পারে। ভীষণ ব্যাপার। সবাই কমান্ডো হতে পারে না। এই কমান্ডোর নেতৃত্বে আমরা গেরিলা ট্রেনিং নেবো ভাবতে ভালো লাগছিল। এই মুহূর্তে আমাদের গেরিলা ট্রেনিং দরকার। অপর একজন অফিসারের কথা মনে পড়ে যায়। ফরসা চেহারা, গাল দুটো গোলাপি আপেলের মত। দেখলে পাঞ্জাবি পাঞ্জাবি মনে হয়। তিনি ক্যাপ্টেন আকবর। ( প্রয়াত কর্নেল আকবর, এক সময়ের মন্ত্রি) কুমিল্লার লোক। নানুয়ার দিঘির পারে বাসা। নাম শুনেছি এবার দেখলাম। ক্যাপ্টেন হায়দারসহ অন্যরা হাবিলদার সুবেদারদের কিছু আদেশ নির্দেশ দিয়ে পাহাড়ের চুড়ায় আরও উঁচুতে তাদের ক্যাম্পে চলে গেলেন। তবে তারা যখন আদেশ নির্দেশ দিচ্ছিলেন তখন তা বাংলা ও উর্দুতেই বলছিলেন। হতাশ হলাম, উর্দু এখনও আমাদের ছাড়তে পারেনি।
খাবারের সমস্যা প্রকট। তিন বেলা তো দুরের কথা এক বেলাও পূর্ণ আহার জোটে না। যদিও পাওয়া যায় তা হলো জাউ ভাত। রিফুজি ক্যাম্প থেকে আনা আতপ চাউল ও ডাল। ডাল বলতে হলুদ রঙের পানি। লবণ কখনই হয়না। থালা বাসন নেই। কিভাবে খাবে? গ্রেনেডের গোলাকার কন্টেইনার কেটে কি এক অদ্ভুত প্লেট বানানো হল। সারা ক্যাম্পে নাই নাই দাও দাও রব। কেউ কারো কথা শুনতে চাচ্ছে না। হাবিলদার সুবেদার সাহেবরা উর্দুতে গালাগাল দিয়েই যাচ্ছেন ‘শালা, আমরা তো আর্মিতে ভালই ছিলাম। বেতন রেশন কাপড় চোপড় সবই পেতাম। তোমরা শালারা আন্দোলন করে সমস্যা লাগিয়ে রেখেছ বলেই আজ আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছি’।
ক্যাম্পের অযুত সমস্যা সমাধানের রাস্তা কই? একদল ছাত্র যুবক স্লোগান দিচ্ছে ‘ভাত কাপড় চাইনা, অস্ত্র চাই, গ্রেনেড চাই, আমরা থাকতে খেতে আসিনি, আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি’।
এটা কে দেবে? ভারত? কেন দেবে। কোন চুক্তি আছে? দিলেও দেয়ার একটা পদ্ধতি তো থাকবে। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারে সরকারে কোন সমঝোতা হয়েছে? এখানে সরকারের প্রতিনিধি কে? সেনা ইউনিট থেকে পালিয়ে আসা সেনা অফিসার ও সদস্যরা কোথা থেকে অস্ত্র ও অর্থ দেবে। সম্পদ কোথায়? দিক নির্দেশনা কি? নেতারা এখনও দেখা দেননি। শুনেছি ছাত্র জনতার রোষ এড়াতে তারা এদিকে আসছেন না। ব্যাংক লুটের টাকাগুলো কি এখন খরচ করা যায় না? ছাত্র জনতা কোন কোথা শুনতে রাজি নয়। শুধু চাই, আর চাই।
হাবিলদার সুবেদাররা উত্তেজিত ছাত্র জনতাকে শান্ত করতে পারলেন না। ফেইল। ক্যাপ্টেন হায়দারসহ অফিসাররা উপর থেকে নেমে এলেন। ফরসা গোলাপি গায়ের রঙয়ের ক্যাপ্টেন সাহেব সবাইকে শান্ত হতে বললেন। না কোন কোথা কেউ শুনছে না। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সাহেব এমন গালি দিয়ে বকা শুরু করলেন যা আমরা জীবনেও শুনিনি। কল্পনায়ও না। বাংলা উর্দু ইংরেজির সব গালি মেশিন গানের গুলির মত বর্ষিত হল। ক্যাপ্টেন আকবরের মুখ আরও লাল হয়ে গেছে। ছাত্র যুবকরা বুঝতে পারল চাওয়ারও তো একটা সীমা আছে।
আরও পড়ুন: ঢাকায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
সবাই তাবুতে ঢুকে গেলো। বড় ভাইয়েরা রসিয়ে রসিয়ে অন্যদের বোঝালেন, ‘বুঝেছ? এটা হল মিলিটারি গালি। কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে সবাই। ডান্ডা না হলে বাঙালি ঠাণ্ডা হয় না’।
প্রশিক্ষণ শুরু হল। এটেনশন, স্ট্যান্ড অ্যাট ইজি, রাইফেলের লোডিং আনলোডিং ইত্যাদি। হায়দার ভাই কালো সানগ্লাস লাগিয়ে দূর থেকে দেখে যান।
প্রশাসন ব্যবস্থার কিছু উন্নতি হল। একদিন জানিয়ে দেয়া হল কাল গরু জবাই হবে। অন্তত একদিন হলেও গোশত খাওয়া যাবে। হায় খোদা। গরু জবাই হলো। কিন্তু মাংসের টিকিটি ও পাওয়া গেল না। শুধু আঁশ পাওয়া গেলো। বলতে গেলে এটা হয়েছে মাংসের ডাল। জাউ ভাতের সঙ্গে মাংসের মিলন হলো না।
ভরসা থাকলো ত্রিপুরার অফুরন্ত কাঁঠাল ও আনারস। দাম খুবই কম। বেশির ভাগ ছেলেদের পকেটেই টাকা নেই। দু একজনের টাকা আছে। ওরা বাজারে গিয়ে ভারতীয় আর্মির মত অলিভ গ্রিন কাপড় দিয়ে প্যান্ট বানাচ্ছে, জঙ্গল বুট কিনছে আর শিখদের মত হাতে খাড়ু পড়ে ‘রাম রামজি’ খেলছে। (ভারতীয় সৈনিকরা একের সঙ্গে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে রাম রামজি বলে)।
ক্যাম্পে প্রতিদিনই ছাত্র যুবকরা আসছে। প্রশিক্ষণ চাই, অস্ত্র চাই। ক্যাম্পে ঠাঁই নেই। এত লোক কোথায় জায়গা দেয়া হবে। এরই মধ্যে সবার বিশ্বাস জমে গেলো যে এ যুদ্ধ দু’ এক মাসে শেষ হবে না। পাক বাহিনী শহর ছেড়ে গ্রামে গঞ্জে হামলা শুরু করেছে। যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করে মাটি চাপা দিচ্ছে। এখন কিছু কিছু পাকিস্তানি সাপোর্টার টুপি লাগিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদে মাতোয়ারা।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক বিহারিকে হত্যা করা হয়েছে। আজ বিহারিরা উঁচু গলায় কথা বলছে। স্কুল কলেজ বন্ধ। তাই যুবকদের ভারতমুখী হওয়ার বিকল্প নেই। ভারতে যাদের আত্মীয় স্বজন আছে তাদের আশ্রয় জুটেছে। অন্যরা কোথায় যাবে? শরণার্থী শিবির এখনও তৈরি হয়নি। থাকা, রান্না বাড়া, খাওয়া সব কিছু খোলা আকাশের নিচে চলছে। ট্রাকে করে আতপ চাউল, ডাল তেল এনে বিতরণ করা হচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
রও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-১
চাহিদা মতো প্রশিক্ষণ শিবির চালু না হওয়াতে যুব শিবির নামে কিছু ট্রানজিট ক্যাম্প চালু হয়েছে। তাছাড়া পরিবারের সাথে ক্ষুদ্র কুড়েঘর শেয়ার করে থাকার চাইতে প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেয়া উত্তম। কেউ দেশের গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আবার কেউ শহরে ঘরের কোনে লুকিয়ে আছে। ছাত্র শিক্ষক, শ্রমিক বিভিন্ন পেশার লোক, এমনকি জেল ভেঙে পালিয়ে যাওয়া দাগি আসামিরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করেছে। বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ করা সেনা বাহিনী, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ সদস্যরা ক্লান্ত। যুদ্ধ করার সাপোর্ট পাচ্ছে না। অগত্যা তারাও ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে যোগ দেয়া শুরু করলো। যুদ্ধে যেতে হবে কি হবে না তা কাউকে বলে দিতে হচ্ছে না। দেশের এই ক্রান্তিকালে কেউ বসে নেই আদেশ-নির্দেশের অপেক্ষায়।
কাঠালিয়া ক্যাম্পে জনস্ফীতি, অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার কারণে এখান থেকে ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হবে বলে জানানো হলো। শত্রুর কামানের গোলার রেঞ্জের মধ্যে এরূপ ক্যাম্প থাকা বিপদজনক। গোলাগুলির শুরুতেই অনেক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হবে। ক্যাম্প কোথায় যাবে জল্পনা কল্পনা চলল। হাবিলদার মেজর নির্দেশ দিল সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিতে। কে কি গোছাবে। আছেইবা কি? কারো পকেটে টাকা পয়সা নেই। একজন সেনা সদস্য জানালেন সরকার গঠন করা হয়েছে। এখন টাকশাল বসে যাবে। টাকা ছাপানো শুরু হলেই বেতন ও পকেট খরচ দেয়া হবে। সহজেই বিশ্বাস করলাম। তখন এত বুদ্ধি হয়নি যে সরকার কিভাবে কাজ করে আর টাকা ছাপাতে কি কি লাগে। মনোবল উঁচু রাখার জন্য যেভাবে বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে আছেন আর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে টাকা ছাপানোর গল্পটাও তাই।
তবু রেশন ও অন্যান্য সামগ্রী ট্রাকে তুলে দিয়ে আমরা হেটে রওনা দিলাম সোনামুড়া অভিমুখে। ত্রিপুরার জেলা শহর সোনামুড়া গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত। সীমান্তের এক দিকে কুমিল্লা বিবির বাজার অপরদিকে সোনামুড়া। পূর্বে সবাই ত্রিপুরার অধিবাসী ছিল।
ঘাটে মালপত্র নামিয়ে সারা রাত ফেরিতে করে মালামাল পারাপার করা হলো। ক্লান্ত নির্ঘুম জনযোদ্ধারা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। বিএসএফ এর নন কমিশন অফিসাররা পারাপার তদারকি করছেন। ফেরি বলতে দুটি কাঠের নৌকা জোড়া দিয়ে লাগানো, খরস্রোতা গোমতীর সাথে তামাশায় লিপ্ত।
আমাদের ক্যাম্প ত্রিপুরা রাজ্যের অম্পিনগরে স্থানান্তরিত হল বিএসএফ এর তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং পরিচালনার জন্য। মাঝে বিশালগরে একদিনের যাত্রা বিরতি হয়েছিল। সেই মিলিটারি ক্যান্টিনের গরম পাকুরা ও জিলাপি পেয়ে সবাই আত্মহারা। কত যুগ পর এরকম খাবারের দেখা মিললো।
অম্পিনগরে আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। অম্পিনগর ছিল ত্রিপুরায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সুসংগঠিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।
কাঠালিয়ার প্রকৃত অবস্থান
কুমিল্লা থেকে ফেনী যাওয়ার পথে মিয়াবাজার নামে একটা ছোট বাজার কাঁকড়ি নদীর পাড়ে অবস্থিত। মিয়াবাজার এর পূর্ব দিকে কাঁকড়ি নদীর ধারে বিএসএফ ক্যাম্প। এর পাশেই কাঠালিয়া বাজার। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে কাঠালিয়া থেকে আরেকটু ভেতরে নির্ভয় পুর এ মুক্তিযোদ্ধাদের নুতন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মেহবুব বীর উত্তম (প্রয়াত)।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: সমীরুদ্দী ও মুনিয়ারা-একই সমতলে
বীরের খেতাব হরণ
বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারের বিদায়
বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারের বিদায়
১৯৭৫ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে কেনো জানি কুমিল্লা চলে এলাম। মাসিক হাত খরচের ১৫০ টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই হল থেকে বাড়ি চলে আসি। কিছু সঞ্চয় আর নুতন মাসের টাকা নিতে মাঝে মাঝেই বাড়ি যাওয়াটা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঢাকা কুমিল্লার বাস ভাড়া ছিল চার টাকা, চারটি ফেরি। সময় চার ঘণ্টা।
এবার ঢাকা ছেড়ে এসে ৭ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট অনেক কিছু মিস করেছি। এ বছরের রাজনীতি ও সরকারের মাঝে অনেক পরিবর্তন, অনেক গুঞ্জন, গুজব, নানা কাহিনী সবার মুখে মুখে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী মুশতাক গংদের সামরিক শাসনের বিষয় ছিল উল্লেখযোগ্য।
৩ নভেম্বর ঘটে গেল চার নেতার জেল হত্যার হৃদয় বিদারক ঘটনা। অবিশ্বাস্য, যারা ত্যাগ ও বিশ্বস্ততার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাদের এই হত্যাকাণ্ড জনগণ সমর্থন করেনি। এর সাথে ঘটেছিল খন্দকার মুশতাকের বঙ্গভবন ত্যাগ ও ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিদেশে পলায়ন।
এরপর মেজর জেনারেল জিয়াকে (তৎকালীন সেনাপ্রধান) অন্তরীণ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ) স্বঘোষিত মেজর জেনারেল পদবি ধারণ করে সেনাপ্রধানের পদ গ্রহণ করেন যা তার উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কোন আদেশের বলে তিনি পদ ও পদবি নিজেই গ্রহণ করেছিলেন তা আজও অজানা। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে খালেদের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফ এমপি মিছিল বের করে যা ভারতীয়দের প্রতি সমর্থন বলে প্রচার পায়। জনগণের ধারণা আবার বুঝি বাকশাল ঘুরে এলো।
সামরিক বেসামরিক মহলে জিয়াউর রহমান একজন জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার অপসারণ ও অন্তরীণ কেউ মেনে নিতে পারছিলনা। এর সুযোগ নিয়ে কর্নেল তাহের বীর উত্তম (অবসরপ্রাপ্ত) সেনা অফিসারদের ও সৈনিকদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত করেন। তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে চাকরিরত সৈনিকদের মাঝে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হন। কর্নেল তাহের সেনা সদস্যদের উস্কিয়ে অফিসার হত্যার মত ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হন। বহু সেনা অফিসার সৈনিকের হাতে নিহত হন। এই ধারাবাহিকতায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার নিহত হন। কর্নেল তাহের তথাকথিত সিপাহী জনতার বিপ্লব নামে রাজনীতির জল ঘোলা করে নিজের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টায় জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাকে মুক্ত করা হয়। জেনারেল জিয়ার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষী জিয়াকে তাহেরের নীল নকশার ফাঁদে পা দিতে দেন নি। ফলে কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। জেনারেল জিয়া পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কর্নেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয় ও সামরিক আদালতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টর ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সেক্টরের বীর যোদ্ধা খালেদ মোশাররফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারের এই করুণ পরিণতি ঢাকা, কুমিল্লা ফরিদপুর, নোয়াখালী অঞ্চলের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। হানাদারের গুলি যাদেরকে স্তব্ধ করতে পারেনি তারা নিজ অফিসার ও সৈনিকদের হাতে নিহত হলেন। দু: সময়ের দিনগুলিতে যারা প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধ করা শিখিয়েছিলেন, যারা নিজের বর্ণিল ক্যারিয়ার ত্যাগ করে পাকিস্তান রক্ষার শপথ ভেঙেছেন তারা আজ নিহত।
মুক্তিযুদ্ধকালে ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও কে ফোর্স অধিনায়ক ছিলেন মেজর খালেদ। সেক্টরের গেরিলা কার্যক্রম পরিচালনায় ছিলেন মেজর হায়দার। নিয়মিত ও গেরিলা অপারেশনের সমন্বয়ে এই সেক্টর অভিযান পরিচালনা করতো। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, জনতা গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতো মেজর হায়দারের তত্ত্বাবধানে। তাই সর্বস্তরের যোদ্ধারা মেজর হায়দারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অসম্ভব স্নেহ বৎসল, প্রয়োজনে কঠোর, অমায়িক, দুর্ধর্ষ কমান্ডো এই সেনা অফিসার খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। রাজধানী ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধ তারই পরিকল্পনায় পরিচালিত হতো। তাই আত্মসমর্পণের পরও ঢাকা অপারেশন ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব মেজর হায়দারের উপর ন্যস্ত ছিল। আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষররিত হলে ঢাকা শহরের বিশৃঙ্খলা ব্যাপক হয়ে ওঠে। তখন মেজর হায়দার টিভি ও বেতারে বার বার শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার জন্য নাগরিকদেরকে সতর্ক করেন। লুটপাট, খুন শক্ত হাতে দমনের জন্য গেরিলা ইউনিট সমূহকে নির্দেশ দেন।
দেশ স্বাধীনের পর সবাই যার যার কর্মে ফেরত যায়। তেমনি মিলিটারি ও তাদের কর্তব্যে নিয়োজিত হয়। অনেক দিন হায়দার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি। জানতাম না কে কোথায় আছে।
১৬ ডিসেম্বর ৭১ এর বিজয়ের পর সবাই ভারত ছেড়ে স্বাধীন দেশে ফেরা শুরু করে। আমি আমার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ছিলাম। একদিন কুমিল্লায় মা বাবার সাথে দেখা করতে বাড়ি এলাম। বাসার প্রবেশ পথে দেখলাম একজন মুরুব্বী বসে আছেন। এ সময় সাধারণত আমার বাবা এখানে বসতেন। উনাকে চিনলাম না। সালাম দিয়ে বাসার ভেতরে দেখলাম একজন অতিথি ভদ্র মহিলাও বাসায় আছেন। জানতে পারলাম উনারা মেজর হায়দারের পিতা মাতা। ভারত থেকে এসেছেন। কিশোরগঞ্জ যাওয়ার যাত্রাপথ ঠিক হলেই কুমিল্লা থেকে রওনা দেবেন। আমার বাবা মা ও উনারা ভালোই সময় কাটাচ্ছেন।
৩ নভেম্বর জেল হত্যা ও অন্যান্য ঘটনা অলিতে গলিতে আলোচনার বিষয়। নানান জনের নানা মত। নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না।
বাহার উদ্দিন রেজা বীর প্রতীক ও জামাল উদ্দিন বীর প্রতীক থেকে জানা গেল যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারের সাথে তাদের দেখা হয়েছে কুমিল্লার চৌয়ারাতে। বাহার ও জামাল কুমিল্লা থেকে একটা বাইকে চৌদ্দগ্রাম যাচ্ছিলেন। পথে আরেকটি বাইক চট্টগ্রামের দিকে থেকে কুমিল্লা যাচ্ছে। দুটি বাইক একে অপরকে অতিক্রম করতেই জামাল ও বাহার অপরদিক থেকে আসা আরোহীকে চিনে ফেললো। তিনি হায়দার ভাই। জামাল ও বাহার ছিল কুমিল্লা গেরিলা ব্যাচের বিশ্বস্ত যোদ্ধা। তাই তারা ছিল কর্নেল হায়দারের একান্ত আপনজন।
মোটর বাইক আরোহীরা বাইক ঘুরিয়ে একে অপরের সাথে কথা বললেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দার বান্দরবান জেলার রুমা গ্যারিসন এ ৮ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটিতে ঢাকা যাচ্ছেন। ট্রেনের অপেক্ষা না করে মোটর বাইকে ঢাকা রওয়ানা হয়েছেন। তিনি খালেদ মোশারফ ও জেনারেল জিয়ার মাঝের ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে কাজ করে যাবেন বলে হায়দার ভাই জানালেন।
কথা শেষে কর্নেল হায়দার ঢাকা অভিমুখে রওনা দিলেন।
সারাদেশ নভেম্বরের শুরু থেকেই হতাশ। কেউ জানেনা কি হবে, কি হচ্ছে। জেল হত্যা, খন্দকার মুশতাক এর প্রস্থান, সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের অন্তরীণ, খালেদ মোশাররফের জেনারেল পদে পদোন্নতি ও সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংগঠন এর সেনাবাহিনী ধ্বংসের চেষ্টা ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা এবং কর্নেল হায়দারের হত্যাকাণ্ড আরও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঢাকার বাইরে আমরা নানাবিধ সংবাদ পাচ্ছিলাম। ৭ নভেম্বর রেডিও টিভি থেকে সংবাদ পরিবেশিত হলো যে সিপাহী জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করেছে। প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠীকে ধ্বংস করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার শের ই বাংলা নগরে ১০ ই বেঙ্গলের সেনা সদস্যরা হত্যা করেছে। গুলির পর বেয়নেট চার্জ করতেও ছাড়েনি।
রাস্তায় রাস্তায় বিজয় উৎসব চলছে। ট্যাঙ্ক এর লম্বা ব্যারেল এ ফুলের মালা ঝুলছে। সেনাদেরকে জনতা অভিনন্দন জানাচ্ছে। এক উৎসব মুখর ঢাকা নগরী।
কর্নেল হায়দারের মৃত্যু সংবাদ আমাদেরকে খুব বিচলিত করে। কে রাজা হলো, কে ক্ষমতায় গেল তা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। আমাদের প্রিয় গেরিলা কমান্ডার হায়দার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে আমরা মেনে নিতে পারছি না। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও আমাদের কমান্ডার ছিলেন। তবে জনযোদ্ধারা কর্নেল হায়দারের সাথেই সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল বলেই তিনি অধিক পরিচিত।
আমরা কয়েকজন ঢাকা গিয়ে কর্নেল হায়দারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সিদ্ধান্ত নিলাম। বাহার, জামাল ও আমি ঢাকা চলে এলাম। সূর্যসেন হলের আমার ৪২৬ নম্বর কক্ষে আরও কয়েকজন এলো, সবার নাম এখন মনে পড়ছে না। কর্নেল হায়দারের লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার দাফনের কি ব্যবস্থা হচ্ছে কেউ জানে না। চলাচলও সীমিত। সন্ধ্যার পর কারফিউ। সেনানিবাসে প্রবেশে কড়াকড়ি।
সন্ধ্যার আগেই মতিঝিল কলোনিতে পৌঁছে গেলাম। খুঁজে বের করলাম কর্নেল হায়দারের বড় বোনের বাসা। শোকাহত পরিবেশ। হায়দার ভাইয়ের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি এখনো। চেষ্টা চলছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এই তিন জন বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের মর্গে আছে। ৭ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত লাশের কোনো সন্ধান কেউ পায়নি। তবে এর মাঝে কর্নেল হায়দার হায়দারের লাশ ব্যতীত বাকিদের লাশ আত্মীয় স্বজনরা আগেই নিয়ে গেছে।
লাশ সংগ্রহ করে গোসল করিয়ে মতিঝিলের বাসায় আনা হলো। এরপর লাশের ট্রাকে করে আমরা কিশোরগঞ্জ রওনা হলাম। তাকে তার নিজ বাড়িতে দাফন করা হবে।
কর্নেল হায়দার ছুটি কাটাতে এসে তার মুক্তিযুদ্ধ কালীন কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা করতে গিয়ে নির্দোষ প্রাণটি হারালেন।
১২ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে কর্নেল এটিএম হায়দার নিজ বাড়ির আঙিনায় সমাহিত হলেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, মুক্তিযোদ্ধা ও গুণগ্রাহীদের ভালোবাসা নিয়ে চিরবিদায় নিলেন।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: সমীরুদ্দী ও মুনিয়ারা-একই সমতলে
বীরের খেতাব হরণ
আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রসঙ্গ কথা
সমীরুদ্দী ও মুনিয়ারা-একই সমতলে
ছোট বেলায় শুনতাম অমুক গ্রামের তমুকে জাহাজে চাকরি নিয়েছে। শিগগিরই যোগ দেবে। সইন দিয়েছে। সইন জিনিসটা কি অনেকদিন বুঝিনি। তবে এটা কর্মক্ষেত্রে যোগদানের কোনো শর্তনামা বলে ধরে নিয়েছিলাম।
জাহাজে চাকরি থেকে যারা ছুটিতে আসেন তারা বিস্কুট, শুকনা ফল, কাপড়-চোপড় নিয়ে আসেন। পকেট ভর্তি টাকাতো আছেই। কাছাকাছি আত্মীয়, অনাত্মীয় হলে কিছু ভাগও দেয়া হতো। তখনকার চাকরি ও নগদ টাকা খুব লোভনীয় ব্যাপার ছিল। ওই সময়ে আর্মি নেভিতে যোগ দিলেও বলা হতো সইন দিয়েছে। জাহাজ ভর্তি করে তারা নীল দরিয়া দিয়ে করাচি পাড়ি দেয়। আঙ্গুরের দেশ।
সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প নোনাজল পড়তে গিয়ে সইন সম্পর্কে জানলাম। এটা ছিল (sign) এই সাইনকেই সইন বলা হতো।
নোনাজলের মূল চরিত্র ছিল সমীরুদ্দী নামের এক খালাসির। ৬ ফুটের অধিক দৈর্ঘ্য, পেটানো শরীর, বাঘের থাবার ন্যায় হাতের শক্তি এবং আরও অনেক বিশেষণের অধিকারী এই সমীরুদ্দী। বাড়ি সিলেট।
সইন দিয়ে যারা এসব চাকরি নেয় তারা জানে কাজটা কত কঠিন, কত মানবেতর। টাকা পয়সা ও গিফট যারা আশা করেন তারা কখনোই জানে না এই নরক পরিবেশের কথা। সমীরুদ্দী নিজ দায়িত্বে একনিষ্ঠ। বাহুল্য খরচ করে না, জাহাজ ভিড়লে গনিকালয়ে দৌড়ায় না। এমনকি ভেগে যাওয়ার সুযোগ এলেও যায় না।
চাকরি পাওয়া ছেলেগুলো জাহাজের বয়লারে কয়লা নিক্ষেপ করে। গনগনে কয়লার উত্তাপ, চারিদিকে অন্ধকার, কি এক কঠিন জীবন। মাঝে মাঝে তারা পাগল হয়ে যায় এবং এক দৌড়ে বয়লার রুম ছেড়ে ওপরে উঠে যায়, সাগরে ঝাঁপ দেয়ার জন্য। কেউ পথ আগলালে তাকে খুন করতেও দ্বিধা করেনা। তখন সবাই তাকে ধরে পানিতে চুবিয়ে রাখে। এটাকে এমখ (Amuck) বলে। সমীরুদ্দী কখনো এ কাজ করেনি। শক্ত মনোবলের পরিচয় দিয়ে সে সবখানে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে।
কোনো কোনো পোর্টে জাহাজ থামলে নামতে দেয় আবার কোনো পোর্টে কড়াকড়ি। আমেরিকার কোনো পোর্টে কাউকে নামতে দেয়া হয় না যাতে কেউ পালাতে না পারে। নিউইয়র্ক পোর্টে একবার জাহাজ থামলো মূল বন্দর থেকে একটু দূরে।
সমীরুদ্দী সিদ্ধান্ত নিল সে পালাবে। বহু আগে থেকেই সে স্বদেশিদের সাথে পত্রালাপ করে পরিকল্পনা করে রেখেছিল যা দ্বিতীয় কেউ জানে না। আজ সুযোগ কাজে লাগাবে।
একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীকে ব্যাপারটা জানাল। সাহায্য হিসেবে একটা বড় ডেকচি চেয়ে নিল। সন্ধ্যার পর সমীরুদ্দী কলকাতা চোরা মার্কেট থেকে কেনা সুট টাই জুতা ডেকচিতে রেখে ঝুপ করে পানিতে ফেলে দিল। পরে নিজে ঝাঁপ দিল। প্রায় আধা ঘণ্টা সাতরিয়ে পাড়ে উঠল। সুট বুট পরে ডাঙায় নেমে গেল। ডেকচি পানিতে ডুবিয়ে দিল।
সমীরুদ্দী টাকা কামানোর জন্য আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল। অনেক টাকা কামালো। সময়ে সময়ে টাকা বাড়ি পাঠালো ছোট ভাইয়ের কাছে। থাকার জন্য একটা দালান, বাড়ির সামনে লন, পুকুর পাড়ে একটি মসজিদ যার উঁচু মিনার গ্রামের দিগন্ত ছুঁয়ে যাবে। নকশাও পাঠিয়ে দিয়েছে। এসব নির্মাণ হয়ে গেছে ভাইয়ের চিঠি পেয়ে দেশে রওনা দিল।
স্টেশনে নেমে সমীরুদ্দী গ্রামের পথে হাটা দিল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে তাকায়, মসজিদের মিনার যদি দেখা যায়? বাড়ির কাছে এসে গেছে। কোনো ইমারত নজরে আসছে না। মসজিদ মিনার কিছুই নেই। অজানা শংকা তাহলে কি তার পাঠানো টাকায় কিছুই নির্মিত হয়নি? ছোট ভাই স্টেশনেও আসেনি। গ্রামের মসজিদে ফজরের নামাজে দু একজন মুসল্লি এসেছেন। তাদের কাছে জানা গেল তার ছোট ভাই সমীরুদ্দীর পাঠানো টাকায় আনন্দ ফূর্তি করেছে।
মন খারাপ করে সমীরুদ্দী আবার আমেরিকা পাড়ি জমায়। বেশিদিন থাকতে পারেনি। বয়স হয়েছে। দেশ টানছে। ফেরার পথে জাহাজে প্রাণ ত্যাগ করে। পকেটে ২১ হাজার টাকা ছিল। উত্তরাধিকার হিসেবে ছোট ভাই এ টাকাটাও পেল।
আমাদের দেশের রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরও একই পরিণতি। মরুভূমির উত্তাপে দগ্ধ হয়ে দেশে ফিরে আসার পর অনেকেই স্ত্রী, মা বাবাকে হারিয়ে ফেলেন। কামাই করা টাকার কোনো হদিস নেই। ফ্ল্যাট জমিজমা যা কেনা হয়েছে বলা হয়েছিল তার কোনো চিহ্ন নেই। প্রবাসী মহিলা কর্মীরা নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে লাশ হয়ে কিংবা শূন্য হাতে ফিরে আসেন । সংসারের অভাব ঘুচাতে কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কিশোরীরা পথে নামে। স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছাতে গিয়ে সিরির প্রতি ধাপেই ওরা নির্যাতিত হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের কাফনের কাপড়ও কেনার অর্থ থাকে না। সমিরুদ্দী, মুনিয়া, রেমিটেন্স যোদ্ধাদের চূড়ান্ত পরিণতি একই সমতলে।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: বীরের খেতাব হরণ
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ
আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রসঙ্গ কথা
বীরের খেতাব হরণ
আমাদের বন্ধুদেশ শ্রীলঙ্কা দীর্ঘদিন তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল। অনেক প্রাণহানি হয়। প্রেসিডেন্ট থেকে অনেক নাগরিক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। অবশেষে তামিল টাইগারদের সমূলে উৎখাত করা সম্ভব হয় সে দেশের আর্মি কমান্ডার জেনারেল সারাথ ফনসেকার নেতৃত্বে।
অসাধ্যকে সাধন করায় সারাথের (শরৎ) জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। চারিদিকে জয় জয়কার। শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে বিদ্রোহ নির্মূল করা যায় না এ থিওরি ভুল প্রমাণিত হলো। তখন দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজাপাকসে। তিনি বীরের মর্যাদা দিলেন। চার তারকা জেনারেল, মেডেল, সম্মান সবই।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট নিজের ভবিষ্যত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সারাথকে চিহ্নিত করলেন। এত জনপ্রিয় ব্যক্তির প্রতি নজর পড়া স্বাভাবিক।
প্রেসিডেন্ট আর্মি কমান্ডার পদ থেকে ফনসেকাকে সরিয়ে দিয়ে জয়েন্ট ডিফেন্স স্টাফ পদে নিয়োগ দিলেন। জেনারেল সারাথ এটাকে তার ক্ষমতা খর্ব করার ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনায় নিলেন। তিনি তার ক্ষমতা খর্ব আদেশ মানতে রাজি হলেন না। পদত্যাগ করলেন ও পরবর্তী নির্বাচনে রাজাপাকসের বিপক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। নির্বাচনী কৌশলে তিনি হেরে গেলেন।
রাজাপাকসের প্রতিহিংসা পুন:নির্বাচনের পর হিংস্রতায় রূপ নিল। তিনি জাতীয় বীরের সকল পদ পদবী হরণ করার পর তাকে জেলে প্রেরণ করলেন।
জেনারেল সারাথ ফনসেকা তার কর্তব্য পালনকালে সকল পদবীতে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আঘাতে যুদ্ধাহত হয়ে জীবন ফেরত পেয়েছেন। কোম্পানি, ব্যাটেলিয়ন, ব্রিগেড কমান্ডার ছাড়াও তিনি সেনাপ্রধান পদে থাকাকালে তামিলদের বোমা হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। তার সেসব কৃতিত্বও মুছে দেয়া হয়েছে।
যাইহোক, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা এই বীরের সকল উপাধি মেডেল ফিরিয়ে দিলেন। পূর্ণ মর্যাদায় তিনি ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হলেন। মন্ত্রীও হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি বিরোধী দলের দলনেতা।
ফিল্ড মার্শাল ফোনসেকা বাংলাদেশের মিরপুর সেনানিবাসে সামরিক বাহিনী কমান্ড ও স্টাফ কলেজের ১৯৮৭ ব্যাচের একজন গ্রাজুয়েট। এ ব্যাচের চারজন ছাত্র অফিসার পরবর্তীতে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ পান। তারা হলেন জেনারেল মুবিন ও জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, বাংলাদেশ, ফিল্ড মার্শাল সারাথ ফনসেকা, শ্রীলঙ্কা, জেনারেল হেনরি কইটু-জাম্বিয়া।
বীরদের নাম মুছে ফেলার উদ্যোগ সফল হয়নি। জনগণের সমর্থনে ফিল্ড মার্শাল সারাথ ফনসেকার সকল পদ পদবী বহাল রয়েছে।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: কুমিল্লা শহরে গ্রেনেড হামলা-১৯৭১
আফগানিস্তান দেখা হলো না
মুর্তজা বশীর ভাই, কেমন আছেন আজকাল?
আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রসঙ্গ কথা
দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩৩২টি স্কুলকে সরকারিকরণ এবং বেশ ক’টি নতুন সরকারি স্কুল নির্মাণের পরও ২০১৯ সালের নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী দেশে মাধ্যমিক স্তরের সরকারি স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৬৬৫টি। ১৯৯০ সালের পর গত তিন দশকে ছাত্রীদের শিক্ষার হার আনুমানিক ৫ গুন বেড়েছে। ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ বালিকা। বর্তমানে দেশে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নামমাত্র বাধ্যতামূলক এবং কেবলমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবৈতনিক। তবে ভর্তি ফি, পুনঃভর্তি ফি’র চাপমুক্ত নয়।
স্বাধীনতার পর দেশে প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজারের বেশি, মাধ্যমিক ৬ হাজারের কম। বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রাইমারি পাশ করার পর এখন প্রায় ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে হাইস্কুলে ভর্তি হচ্ছে যা আশাব্যাঞ্জক। যেখানেই পড়ুক, সব শিশু যেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে সেটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে আরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ না করলে কাঙ্খিত ভিত্তি নির্মিত হবে না। সেই লক্ষ্যে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে সৃদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রবেশদ্বারকে সুগম করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য/কলা/বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভাজন উচ্চমাধ্যমিক খেকে কার্যকর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এর বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক ভাবনা চিন্তা আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাত্র ৬৩ শতাংশ সরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারি স্কুলের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের অভিভাবক। ভর্তিতে অনিয়ম, যথেচ্ছ মাসিক বেতন, ভর্তি ফি, পুনভর্তি ফি সহ নানাবিধ অনৈতিকতার চর্চা শিক্ষার কাঙ্খিত সুন্দর পরিবেশকে ব্যাহত করছে, আহত করছে। নানাবিধ কোটার আবর্তে ভর্তি প্রক্রিয়া বাণিজ্যমুখীতার চোখ রাঙাচ্ছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মানও প্রশ্নবিদ্ধ।
শিখন সংকট:
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে শেখার চাইতে পরীক্ষায় পাশ এবং উচ্চতর গ্রেড অর্জন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র মাথায় রেখেই স্কুলের পড়াশোনা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। হাত বাড়ালেই নোটবই আর পা বাড়ালেই কোচিং সেন্টারের খাঁড়াতো আছেই। শঙ্কা ও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই জিপিএ-এর মানে জানে না! ক্লাস সেভেনে পড়া শিক্ষার্থী ‘আমি ৭ম শ্রেণিতে পড়ি’ এই বাক্যের ইংরেজি অনুবাদ জানে না। আবার অনেকে অনুবাদ শব্দের অর্থই জানে না! যোগ্য শিক্ষকের অভাবই এর অবশ্যম্ভাবী কারণ।
চারপাশে নিম্নমানের কিন্ডারগার্টেন নামের প্রাথমিক স্কুল ছড়িয়ে রয়েছে। মুনাফা অর্জনই এসব প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের মূল লক্ষ্য। টেনে টুনে গ্র্যাজুয়েট এবং উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক (অধিকাংশ শিক্ষিকা) দিয়েই এসব স্কুলের পাঠক্রম পরিচালিত হয়। শিক্ষকদের বেতন ১৫০০-২০০০ টাকা! শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে ওনারা কোনভাবে পুষিয়ে নেন। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য।
ইংরেজি না জানলে কিছুতেই আর চলবেনা এই স্লোগানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমরা ছুটছি ভার্সন নামের আকর্ষণে। আর সেই সুযোগে সহজে মুনাফা অর্জনের বাণিজ্যে ঝটপট নেমে পড়েছেন চতুর বেনিয়া সম্প্রদায়। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে আমরা পতঙ্গসম ঝাঁপিয়ে পড়েছি সন্তানকে ইংরেজির আলোয় আলোকিত করবো আশায়, যে মানের শিক্ষক বাংলা ভাষাই ঠিকমতো জানেন না, তিনি কি ইংরেজি শেখাবেন? ভুল উচ্চারণের ভুলভাল ইংরেজি শিখতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষা বাংলাও ভুলে যায়। ওরা এখন বাংরাজী ভাষায় কথা বলে!
কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ ভার্সন স্কুলের ডামাডোলে একটু একটু করে গুছিয়ে নিতে থাকা বাংলা মাধ্যম স্কুল শিক্ষার্থী সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ে। অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে মানসম্মত বাংলা মাধ্যম স্কুলের সংকট দেখা দেয়। সরকারি স্কুলেও শিক্ষার্থী সংকুলান হয় না।
শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে শুরু হয় সৃজনশীল পাঠদানের। চমৎকার সংযোজন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সামর্থ্য যাচাই করার সুযোগ পায়। কিন্তু এই পদ্ধতির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অপ্রতুলতার কারণে এর সুফললাভ ব্যাহত হচ্ছে।
এবার মূল বিষয়ে আসা যাক। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা যার জন্য ১৯৫২ সালে প্রাণ দিয়েছেন ভাষা শহীদেরা। একাত্তরে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে ত্রিশ লাখ শহীদ। অথচ সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন নীরবে চোখের জল ফেলছে।
এমনটা হলে পরে:
চর্চার ক্ষেত্রে বাংলাভাষাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে দেশজুড়ে মানসম্মত বাংলা মাধ্যম স্কুল স্থাপন এখন সময়ের দাবি। বানান এবং উচ্চারণের প্রতি যত্নশীল হওয়ার বিকল্প নেই। নির্দিষ্ট সংখ্যক বানানের জন্য নম্বর কর্তনের বিষয় বিবেচনা করলে কেমন হয়? উচ্চারণ, বানান, শিক্ষাদান পদ্ধতি ইত্যাদি সকল বিষয়ে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণদান নিশ্চিত সুফল বয়ে আনবে।
লেখক: কবি ও শিশু সাহিত্যিক গোলাম কুদ্দুস চঞ্চল
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: শিক্ষা কাঠামো আধুনিক হচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী
নতুন শিক্ষাক্রমে ছেলে-মেয়েরা আনন্দের মধ্যে পড়াশোনা শিখবে: দীপু মনি
ডেঙ্গু বান্ধব অসহায় ঢাকা!
কেমন হবে আমাদের মেট্রোরেল?
দেশ আজ উন্নতির হাইওয়েতে। অনেক স্বপ্নিল প্রকল্পের মাঝে মেট্রো রেলও একটি। কাজ শুরু হয়ে গেছে। ধুলাবালি, কাদা, রাস্তা কাটাকাটির দুঃসহ ট্রাফিক জ্যামের মাঝে ও আশায় বুক বেঁধে আছি কবে এক নিমেষে ফার্মগেট,মতিঝিল চলে যাবো। পরিপাটি পরিচ্ছন, ধুমপান ও খাওয়া দাওয়া বিহীন ট্রেনের কামরায় বসে গন্তব্যে যাচ্ছি। মিষ্টি সুরে বলবে “পরবর্তী ষ্টেশন আগারগাঁও, দরজা বাম দিকে খুলবে, দরজা বন্ধ হচ্ছে ইত্যাদি”। স্মার্ট কার্ড, স্মার্ট টিকেট সিস্টেম কত কিছুই না দেখবে এদেশের জনগন। আহ সেদিন আসিবে কবে?
সুদিন আসছে। রেল গাড়ির ট্রায়াল রান শুরু হয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ চালু হতে বছর দুয়েক সময় লাগবে।
দুই দশকের ও কম সময়ের আগে যখন দিল্লি যাই তখন দেখি মেট্রো রেলের কাজ চলছে। দিল্লির লোকদের স্বপ্ন পর্ব চলছিলো। কিন্তু কলকাতা এদিকে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। কলকাতায় পুরোদমে মেট্রো রেল চালু ছিল। লক্ষ্য করলাম কলকাতার কোচ গুলো চেন্নাই এর তৈরি আর দিল্লির জন্য জাপানি কোচের অর্ডার দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় রাজধানী ও প্রাদেশিক রাজধানীর একটা পার্থক্য থাকবেনা? যাক তা দেখা আমার বিষয় নয়।
২০১৭ সালে দিল্লি গিয়েছিলাম। বিমান বন্দর থেকে নিউ দিল্লি ষ্টেশন পর্যন্ত যথাযথ সুন্দর পরিপাটি মেট্রো রেলের দেখা পেলাম। পরবর্তী গন্তব্য গুলোতে যেতে টের পেলাম এটা কোন রেল। লোকজনের ভিড়, ধাক্কা ধাক্কি, মাথায় মালপত্র নিয়ে গায়ের উপর পড়ে যাওয়া কি এক বিচ্ছিরি কারবার। নাভিশ্বাস উঠার অবস্থা। যাত্রীদের পোশাক আশাক, ঘামের গন্ধ, পান ও জর্দার সুবাস সব মিলিয়ে মেট্রো রেলের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। এতো লোক সংখ্যার শহরে আদর্শ মেট্রো রেল কিভাবে কাজ করবে। কোচ গুলির অনেক সিস্টেম কাজ করে না। মিষ্টি গলায় যাত্রীদের জন্য ঘোষণা আসে না।
কর্তৃপক্ষকে দোষ দেবার সুযোগ কই? মেট্রো রেলের সব কিছুই তারা ঠিক মত করেছে। কিন্তু পরিকল্পনাবিদরা ভাবেননি যে ভবিষ্যতে লোক সংখ্যা কি দাড়াবে? অশিক্ষিত জনগনের জন্য আধুনিক সিস্টেম নির্ভর মেট্রো রেল কতটুকু সুবিধাজনক ভাবে কাজ করবে। দিল্লি পৃথিবীর এক নম্বর নোংরা শহর। পরিচ্ছন্ন মেট্রো রেল এর সাথে সাথে এর আরোহীদের সাফ সুতরা করার কোন পরিকল্পনা ছিল কি? নিরাপত্তার নামে ষ্টেশন গুলোতে চেকিং ও মালপত্র স্ক্যানিং এর দীর্ঘ লাইন বিরক্তিকর ও বিব্রতকর। অনেক লাগেজের সাইজ এতো বড় যে স্ক্যানিং মেশিনে ঢোকে না। কলকাতা যাওয়া হয়নি। সেখানকার মেট্রো রেল দিল্লির মত কিনা জানি না।
আমরা সব কিছুতেই বিশ্বের এক নম্বর। আমাদের পরিকল্পনাবিদরা নিশ্চয় এসব দিক বিবেচনায় রেখেছেন যে আগামী দিনের জনসংখা ও আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের কি রকম মেট্রো রেল হওয়া উচিৎ। এটা কি সিঙ্গাপুর জাপানের আদলে আদর্শিক কিছু নাকি মস্কোর মেট্রো রেলের ন্যায় শক্তিশালী ও কার্যকর একটা মেট্রো রেল হবে তা দেখার অপেক্ষায় আছি। তবে নির্মাণকালীন সময়ের দুর্ভোগ (যা শুরু হয়ে গেছে) কাটিয়ে যদি বেঁচে থাকি তাহলেই মেট্রো রেল দেখতে পাবো। অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক: কলামিস্ট ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ
নয়া তালেবান, পুরান তালেবান: তফাৎ কী?