কাউকে ফাঁসি দেয়ার আগে কম করে হলেও দশবার চিন্তা করা হয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। গোলাম রসুল ঝড়ু ও আব্দুল মকিমের নিয়মিত আপিলের শুনানিকালে বুধবার প্রধান বিচারপতি এই মন্তব্য করেন।
এই দুই আসামির জেল আপিল খারিজ হওয়ার পর তাদের ফাঁসি বহাল থাকায় আইনানুগভাবেই ফাঁসি কার্যকর করায় আদালত তাদের নিয়মিত আপিল দুটি অকার্যকর ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। একই সঙ্গে সুজন নামে এক আসামির নিয়মিত আপিলও এদিন খারিজ করা হয়। যিনি জেল আপিলের ভিত্তিতে খালাস পেলেও তার নিয়মিত আপিলটি বিচারাধীন ছিল। পরে আপিল বিভাগ নিয়মিত আপিল ও জেল আপিল একসঙ্গে শুনানির ব্যাপারে সমন্বয় সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করে দেবেন বলেও জানান।
এদিকে বুধবার শুনানিকালে আপিল বিভাগ ভার্চুয়াল আদালতের সুফল তুলে ধরে জানান, ভার্চুয়াল কোর্ট ছাড়া জুডিসিয়ারির কোনো গতি নেই। জজ সাহেবরা যদি বাসা থেকে কাজ করেন তাহলে দ্বিগুণ কাজ হবে। তবে আগামী ডিসেম্বর মাসে আপিল বিভাগ শারীরিক উপস্থিতিতে চলবে বলেও জানান প্রধান বিচারপতি।
আরও পড়ুন: গাজীপুরে ২০৬ হাসপাতাল-ক্লিনিক কেনো বন্ধ হবে না, জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট
জানা যায়, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুরের মনোয়ার হোসেন হত্যা মামলায় আপিল নিষ্পত্তির আগেই আসামি ঝড়ু ও মকিমের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এরপর জানা যায়, এই দুই আসামির জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করা জেল আপিল খারিজ হওয়ার পর ফাঁসি বহাল থাকায় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। তবে তাদের দায়ের করা নিয়মিত আপিল দুটি শুনানির জন্য সম্প্রতি আদালতের কার্যতালিকায় আসে। নিয়মিত আপিল বিচারাধীন থাকলেও জেল আপিল খারিজের ভিত্তিতে চার বছর আগে ফাঁসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে আদালত আপিলকারী পক্ষের আইনজীবীদের দায়ী করেন। আপিল বিভাগ বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উচিত ছিল নিয়মিত আপিল করার পর একটি আবেদন দিয়ে জেল আপিলের সঙ্গে তা যুক্ত করা।
অন্যদিকে আইনজীবীরাও আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট সেকশনের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন। তারা বলেন, সেকশন থেকে জেল আপিলের সাথে নিয়মিত আপিলটি যুক্ত করে একসাথে শুনানির জন্য লিস্টে দেয়া উচিত ছিল।
আরও পড়ুন: সন্তানের অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত সব মামলা ৬ মাসে নিষ্পত্তির নির্দেশ হাইকোর্টের
বুধবার ঝড়ু ও মকিমের নিয়মিত আপিলের ওপর দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি শুরু হলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আদালতে বলেন, তিন নম্বরের সাথে তালিকায় থাকা সাত নম্বর আইটেমের একসঙ্গে শুনানি করতে চাই। সাত নম্বর আইটেমে সুজন নামে একজনের রেগুলার (নিয়মিত) আপিল আছে। কিন্তু তারও একটি জেল পিটিশন ছিল। যেখানে তার কোনো আইনজীবীও ছিল না, কিন্তু শুনানি করে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দিয়েছেন।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ওই মামলায় তিন আসামির মধ্যে দুই জনের আপিল ছিল। আর সুজনের ছিল জেল পিটিশন। অথচ নিয়মিত আপিল যাদের, তাদের ফাঁসি হয়েছে আর জেল পিটিশন শুনানি করে আমরা ওই (সুজন) আসামিকে খালাস দিয়েছি। অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি দেখেন এই লোকের (সুজন) পক্ষে আইনজীবী একটা কথাও বলেনি। শুধু তার উপস্থিতি আছে। কারণ আমরা বাসায় ফাইল নিয়ে ভালো করে দেখে তারপর রায় দেই।
মোকিম ও ঝড়ুর ফাঁসি কার্যকর নিয়ে বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই কোর্টের উপর এমন একটি ব্লেইম (অভিযোগ) আসলে সেটি কোর্টের জন্য বিরাট বিব্রতকর। তখন অবশ্য আমি প্রধান বিচারপতি ছিলাম না। তারপরও আমাদের প্রত্যেকের জন্য বিব্রতকর। আমরা প্রত্যেকটি ফাঁসি দেয়ার আগে ভালো করে দেখি। ফাঁসি দেয়ার আগে আমরা কম করে হলেও ১০ বার চিন্তা করি।
আদালত ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের এখানে তো এখনও ডিজিটাল সিস্টেম হয়নি। ডিজিটাল করতে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ডিজিটাল হলে সাথে সাথে ডিটেক্ট (শনাক্ত) হয়ে যাবে, কোন মামলার কোনটি থেকে কোনটি আসছে। এখন এটাই বড় সমস্যা। ডিজিটাল না হলে ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়। কারণ এখন আর কেউ কনভার্সনের দরখাস্ত (জেল আপিলকে নিয়মিত আপিলে রূপান্তর করার আবেদন) দেয় না। এই যে দেখেন, সুজনের রেগুলার আপিল রয়ে গেছে, কিন্তু জেল আপিলে সে খালাস হয়ে গেছে।
মোকিম ও ঝড়ুর ২০১৩ সালের আপিল পড়ে থাকলেও তাদের আইনজীবী কেন আদালতে মেনশন (উপস্থাপন) করলেন না, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি বলেন, আমি সেকশনে নির্দেশ দিয়ে বলেছি, সব ফাঁসির মামলা পৃথক করো। বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে আমি এটা করেছি, যাতে মানুষের কষ্ট না হয়। তারপর সব বাছাই করা হয়েছে, আপিলে শুনানি হয়েছে।
আরও পড়ুন: ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকের জামিন প্রশ্নে বিভক্ত আদেশ হাইকোর্টের
প্রধান বিচারপতি বলেন, গরিব মানুষের মামলায় তারা এসে ধরাধরি না করলে আইনজীবীরা কোনো আবেদন দেন না। মামলা পড়ে থাকলে নোটিশও করেন না। এ সময় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, আমরা যেহেতু অন মেরিটে আপিলটি ডিসমিস করেছি। আমার কাছে মনে হয়, রেগুলার আপিলটি নট মেইনটেনেবল বলে ডিসমিস করে দিতে পারেন বা অকার্যকর করে দিতে পারেন।
ঝড়ু ও মকিমের আইনজীবী আসিফ হাসান এ সময় বলেন, আমরা কিন্তু কোর্টের উপর কোনো ব্লেইম দেইনি, হয় তো কিছু প্রভাব পড়ে গেছে। আমাদের এ ক্ষেত্রে ছোট একটু চাওয়া হলো, আমাদের হয়ত আরও সতর্ক হতে হবে। তবে সেকশনের আরও সমন্বয় করা উচিত। পাশাপাশি কারা কর্তৃপক্ষের জন্য একটা গাইডলাইন দিলে ভালো হয়।
বিচারপতি ইমান আলী বলেন, উচিত ছিল যখন ক্রিমিনাল আপিল দায়ের করে, তখন বলে দেয়া যে, অলরেডি একটি জেল আপিল ফাইল হয়ে গেছে। আসিফ হাসান বলেন, তালিকায় আসার আগ পর্যন্ত আমরা কিছুই জানি না। ফাঁসি হয়ে গেছে তাও কিছু জানায়নি। এখন আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই। একটু চাওয়া সকলের স্বার্থে একটি গাইড লাইন দিয়ে দেন। বিচারপতি ইমান আলী বলেন, এগুলো সব কম্পিউটারাইজড হয়ে গেলে এ সমস্যা হতো না। এটা আপনারা আইনজীবীরা হতে দেবেন না। কারণ আপনার আপনাদের পছন্দ অনুযায়ী কোর্টে গিয়ে শুনানি করবেন। সবশেষে আদালত ঝড়ু, মোকিম ও সুজনের ক্রিমিনাল আপিল অকার্যকর ঘোষণা করে খারিজ করে দেয়। এ বিষয়ে গাইড লাইন থাকবে বলে জানিয়ে দেন আদালত।
ভার্চুয়াল কোর্টে দ্বিগুণ কাজ হয়
ঝড়ু ও মকিমের আপিল শুনানিকালে ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি। শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়ালি শুনানির কারণে সম্প্রতি বেশ অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ম্যানুয়ালি মামলার শুনানির সময় আগে প্রতি রোববার কয়েক ঘণ্টা সময় যেত মামলা জরুরি উল্লেখ করে তালিকা করতে। আগে আপিল বিভাগে মামলা ছিল ২৩ হাজার। আর ভার্চুয়াল আদালতে শুনানি হয়ে মামলা কমে এখন আছে সাড়ে ১৫ হাজার। এই প্যানডেমিকের সময়ে দেশের সব আদালতে মামলা সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু আপিল বিভাগে মামলা কমেছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে ফিজিক্যাল কোর্ট খুলে দেব, তবে ভার্চুয়াল কোর্টে কাজ হয় ডাবল। ধরুন এখন আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রয়োজন। অথচ তিনি আছেন অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ে। তার আসতে ১৫ মিনিট সময় নষ্ট হলো। আর ভার্চুয়ালে হলে অ্যাটর্নি জেনারেল একই চেয়ারে বসে থাকেন, জাস্ট একটি টিপ দিয়ে দেন। তা ছাড়া আপিল বিভাগের সব আইনজীবী বয়স্ক, যাদের অধিকাংশের বয়স ৭০ এর বেশি। উনারা যখন বাসায় থাকেন তখন কোনো সময় নেন না। ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম নিজের বেডরুম থেকে শুনানি করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা সবাই ফিজিক্যাল কোর্টের ভক্ত, তবে ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট আপার হাউজে বলেছেন, কোর্ট ডাজ নট ইন এ পার্টিকুলার বিল্ডিং (কোর্ট একটি নির্দিষ্ট ভবনে আবদ্ধ নয়)। ভার্চুয়াল কোর্টে রোকন উদ্দিন মাহমুদ সুইজারল্যান্ড থেকে শুনানি করেছেন। আজমালুল হোসেন এখনও সিঙ্গাপুর থেকে শুনানি করেন। তানজিব উল আলম লন্ডন থেকে শুনানি করেছেন। এ রকম অনেকেই আছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলও দেশের বাইরে থেকে শুনানি করেছেন। এখানে তো ছুটির নেয়ার প্রয়োজন হবে না।
আরও পড়ুন: ঋণখেলাপির আইনি অধিকার থাকতে পারে না: হাইকোর্ট
তিনি বলেন, কোর্ট হচ্ছে মেডিকেল সেবার মতো সার্ভিস। আমার মনে হয় ২৪ ঘণ্টা কোর্ট খোলা থাকা উচিত। এটা তো সার্ভিস। ভারতের গুজরাটে তো ইভিনিং (সান্ধ্যকালীন) কোর্ট চালু আছে। এ সময় বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, তাহলে আমরা হলি ডে কোর্ট চালু করে দিই। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা হয়েছে মাই লর্ড। গতবার বন্ধের সময় এটা হয়েছে। আপনারা বন্ধের মধ্যে বসেছিলেন। ওই মামলায় আমিও ছিলাম। ওই বন্ধের সময় ২৫৬টি মামলার শুনানি হয়েছে।
বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, শনিবারও হলি ডে কোর্ট খোলা রাখা যায়। সাড়ে ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত কোর্ট খোলা রাখা যায়। আইনজীবীরা যেহেতু চায়, এটা করা যায়। সবাই তার বাসা থেকে শুনানি করবেন সমস্যা কী! এ সময় আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, এটা উচ্চ আদালতে করা যায়, কিন্তু নিম্ন আদালতে সমস্যা হবে।
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ওটা আরও সহজ। আমেরিকা বসে সাক্ষী সাক্ষ্য দেবে। সাক্ষীর অভাবে কত মামলা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের যেকোনো স্থানে বসে সাক্ষী তার সাক্ষ্য দিতে পারবে। আসামিদের জেলখানা থেকে আদালতে হাজির করাও দরকার নেই। ভার্চুয়াল কোর্টের ফলে সড়কে যানজটও কমে যাবে। হাজার হাজার আইনজীবীকে কোর্টে আসতে হবে না। জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে। ভার্চুয়াল ছাড়া মামলার জট কিছুই যাবে না। এতে জাজও অনেক বাড়ানো যায়। প্রধান বিচারপতি বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যেভাবে আগাচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিপ্লব হয়ে যাবে। এখন বাংলাতে কথা বললেই মোবাইলে লেখা হয়ে যায়। এটাতে জজ সাহেবদের কষ্ট কমে যাবে, তারা মুখে বলবেন আর লেখা হয়ে যাবে।