করোনভাইরাসের কারণে সব ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হলেও, অবিরাম অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে নিরাময় হচ্ছে প্রকৃতির। এর ফলে ঢাকা শহরে ফিরে এসেছে ‘প্রায় হারিয়ে যাওয়া’ শ্রুতিমধুর পাখির সুর।
পাখিবিদদের মতে, বন্ধুসুলভ প্রাণীগুলোর মধ্যে পাখি অন্যতম। পাখি লালন পালনের জন্য বাংলাদেশ অন্যতম আদর্শ একটি স্থান। শীতকালে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোর পাখিরা এ জন্যই বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজে নেয়। দেশে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় শিল্পায়নের ব্যাপক যান্ত্রিকতার সাথে চরম পরিবেশ ও শব্দ দূষণের কারণে পাখির সংখ্যা এবং তাদের চিরচেনা কলকাকলি একরকম হারিয়েই গিয়েছিল।
চলমান করোনভাইরাস মহামারির কারণে লকডাউন অবস্থা বিরাজমান হওয়াতে অনেকটাই কমেছে ঢাকার দূষণ। এর ফলে স্বল্প দূষিত অবস্থায় নিয়মিত পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করেছেন শহরের অনেক বাসিন্দা। ঢাকায় বসেই পাখির এমন সুর শোনা যাবে এমনটা অনেকে কল্পনাও করেননি।
বনশ্রীতে বসবাসরত নাফিস নামে এক প্রকৌশলী নিজের ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘আমার ৫ বছরের ছেলে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে সকাল বেলা এত পাখির কলকাকলি আগে কখনও শোনেনি। সত্যি বলতে আমিও শুনিনি। কিন্তু সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে এবং লকডাউনের কারণে সবাই যখন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে শুরু করেছে, তখন থেকেই আমরা আগের চেয়েও অনেক বেশি পাখির গান শুনতে পারছি।’
কারণটি যাচাই করার জন্য এ প্রতিবেদক ইকরামুল শাকিলের সাথে কথা বলেন, যিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রশংসিত পর্বতারোহী, পরিবেশবিদ, নাট্যকর্মী এবং লেখক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি একজন পাখিপ্রেমী এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য।
শকিল বলেন, ‘বাংলাদেশ বিস্ময়করভাবে সুন্দর বৈচিত্র্যময় সব পাখির দেশে। কাক থেকে শুরু করে কোকিল, কবুতর থেকে তোতা পর্যন্ত প্রতিটি পাখি প্রকৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের দেখভাল প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরের পরিবেশ দুঃখজনকভাবে সেই প্রয়োজনের পক্ষে অনুকূল ছিল না।’
‘কোভিড-১৯ মহামারি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার পর যখন তা মানুষের জীবনেকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই ঢাকার প্রকৃতি থেকে সামগ্রিকভাবে পরিবেশ দূষণ কমতে শুরু করেছে। শিল্প এবং নির্মাণকাজ বন্ধ থাকার পাশাপাশি যানবাহনও বন্ধ থাকায় ঢাকায় বিষাক্ত ধোঁয়া নেই এখন। এ জন্যই পাখিরা মুক্তভাবে আকাশে উড়ছে যা এর আগে খুব বেশি দেখা যায়নি। শব্দ দূষণ না থাকায় পাখিদের কলকাকলি আরও বেশি শুনতে পাচ্ছে নগরবাসী,’ যোগ করেন শাকিল।
তবে প্রতিটি ভালো জিনিসের কিছু খারাপ দিকও থাকে অনেক সময়। কোভিড-১৯ দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশের এ পরিবর্তিত দিকগুলোর কারণে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
শাকিল বলেন, ‘মানুষ আজকাল যেহেতু কিছুটা সচেতন, তাই তারা আগে যেভাবে ঢাকাকে প্রতিদিন দূষিত করত, এখন আর সেভাবে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলছে না। যদিও এটি একটি সুসংবাদ, কিন্তু এর খারাপ দিক হলো খাদ্যের অভাবে দুর্দশায় পড়েছে কাকগুলো। কবুতর ও তোতার মতো পোষা পাখি ছাড়া ময়না, চড়ুই বা শালিকের মতো অন্য পাখিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পাচ্ছে না। পাখি যেহেতু কুকুর এবং বিড়ালের মতো পোষা প্রাণী নয়, তাই তারা এমন পরিস্থিতিতে তুলনামূলকভাবে অসহায়।’
বিরল পাখি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আজকাল ঢাকায় পেঁচার সংখ্যা খুব কম। আমরা আজকাল খুব কমই পেঁচার ডাক শুনতে পাই। আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল বা উড়ন্ত ঈগলও সাম্প্রতিক সময়ে খুব বিরল হয়ে উঠছে। পাখিরা যদি স্থানীয়ভাবে তাদের খাবারগুলো সংগ্রহ করতে না পারে তবে আমাদের চারপাশে কেবল শকুন থাকবে। সুতরাং আমাদের অবশ্যই এ পাখিগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’
শুধুমাত্র প্রকৃতির জন্য নয়, যারা সম্প্রতি পাখির মনোমুগ্ধকর কলকাকলি শুনে আনন্দ প্রকাশ করছেন তাদের জন্যও এসব পাখিকে রক্ষা করা প্রয়োজন।