সংশ্লিষ্টরা জানায়, জেলার বুকচিরে প্রবাহিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র-ধরলা-তিস্তা-দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদী। প্রতিটিই স্রোতস্বিনী। ফলে প্রতি বছর ভাঙনে নদী গর্ভে চলে যায় হাজার হেক্টর আবাদি জমি, বসত ভিটাসহ গাছপালা, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার ৯টি উপজেলায় তিনটি পৌরসভা ও ৭৩টি ইউনিয়নের মধ্যে একটি পৌরসভা এবং ৫৫টি ইউনিয়নের সিংহভাগ ভূ-খণ্ড নদীগর্ভে। শতভাগ ভাঙনের খাতায় রয়েছে চিলমারী এবং রাজিবপুর উপজেলা। জেলার এসব নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ ৩১৬ কিলোমিটার। এবারে বন্যায় নদী তীরবর্তী বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোট ১৩৮ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে ২১ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার এবং আংশিক ক্ষতি হয়েছে ১১৬ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন যথাক্রমে পৌরসভা, কাঁঠালবাড়ী, হলোখানা, পাঁচগাছি, যাত্রাপুর, মোগলবাসা, ঘোগাদহ, ভোগডাঙ্গা ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কবলে। নাগেশ্বরী উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার মধ্যে ভাঙন কবলিত ১১টি ইউনিয়ন। দুধকুমার, গংগাধর ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কবলে আছে উপজেলার রায়গঞ্জ, বামনডাঙ্গা, কেদার, বল্লভেরখাষ, কচাকাটা, নারায়ণপুর, কালিগঞ্জ, বেরুবাড়ি, নুনখাওয়া ইউনিয়নগুলো।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে শিলখুড়ি, তিলাই, চরভূরুঙ্গামারী, পাইকার ছড়া, বঙ্গসোনাহাট, বলদিয়া, আন্ধারীঝাড় এই ৭টি ইউনিয়ন দুধকুমার নদের ভাঙনের কবলে। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের কবলে উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার মধ্যে হাতিয়া, বুড়াবুড়ি, তবকপুর, বজরা, থেতরাই, গুনাইগাছ, বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা এই ৮টি ইউনিয়ন।
ফুলবাড়ি উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নের একই অবস্থা। ধরলার করাল গ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে নাওডাঙ্গা, শিমুলবাড়ী, ফুলবাড়ী সদর, বড়ভিটা, ভাঙ্গামোড় ইউনিয়ন। রৌমারী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও সোনাভরী নদীর ভাঙনে বন্দবের, রৌমারী সদর, যাদুরচর, চর শৌলমারী এই ৪টি ইউনিয়ন। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি, মোহনগঞ্জ ও রাজিবপুর সদর ৩টি ইউনিয়নের মধ্যে সবকটি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত। রাজারহাট উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন ভাঙন কবলিত। ধরলা ও তিস্তার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলো হলো ঘড়িয়ালডাঙা, ছিনাই, বিদ্যানন্দ ও নাজিম খাঁ। চিলমারী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে সবকটি ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর চরপার্বতীপুরের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য সাদের আলী জানান, এক সময়ের শতবিঘা জমির মালিক ছিলেন তিনি। নদীর ভাঙনে সব জমিজমা বিলিন হয়ে এখন নিঃস্ব। কোনোরকমে নদীর তীরবর্তী এলাকায় পরিবার নিয়ে মাত্র ১২ শতক জমিতে টিনের চালা করে দিন কাটছে তার।
তার মতো জব্বার আলীরও একই অবস্থা। মাত্র কয়েকবছর আগে বাপ-দাদার ভিটে-মাটি শত বিঘার ওপর সম্পত্তি প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র নদের পেটে চলে গেছে। অথচ এক সময়ের স্বচ্ছল আর সম্পদশালী থাকলেও এখন অভাব অনটনে দিন কাটছে তার। এরকম হাজারো পরিবারের ভিটে-মাটি চলে গেছে নদীগর্ভে।
নদীর ভাঙনের শিকার হয়ে বহু ঘরবাড়ি আর সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে প্রতিবছরই। অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়ায় অভাবের সংসারে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারের কাছে। বৃদ্ধ বয়সেও অনেকে কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছুটে চলছেন।
স্থানীয়দের দাবি, প্রতিবছর ত্রাণ নয় নদী শাসন এবং স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা ও ভাঙন থেকে দারিদ্রপীড়িত জেলার মানুষকে রক্ষা করার।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, নদী ভিত্তিক পরিকল্পনা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে আগামী কয়েকবছরের মধ্যে জেলাকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
তিনি জানান, তিস্তা নদীর ১৬০ কিলোমিটার সংস্কার ও বাঁধ নির্মাণে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং দুধকুমার নদীর ২৫ কিলোমিটার সংস্কার ও বাঁধ নির্মাণে ৭১৪ কোটি টাকার প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানান, চলতি বছরের বন্যা আর নদী ভাঙনে প্রায় সহস্রাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙনকবলিত ৩২টি পয়েন্ট চিহ্নিত করে মেরামত করা হচ্ছে।