বাচ্চু শেখ বলেন, ‘পানির ধারে মাচান বাঁধছি। এরপর উপরেত্যা সমানে ঝড়তিছে বৃষ্টির পানি।’
পলিথিন আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা তার অস্থায়ী ছাউনি যে কখন বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় সে ভাবনায় তার ঘুম আসে না।
বাচ্চু শেখ বলেন, ‘চাইরদিকে পানি, কাজকাম পাইতেছি না। পরিবারের বাল-বাচ্চা নিয়্যা নিদারুন কষ্টে দিন কাটাইতে হইতেছে। চাইল আর শুকন্যা খাবারে কয়দিন চলবে? এহন আমরা আর এই চাইল চাই ন্যা, আমাগেরে কাজ দেন।’ এভাবেই জীবন জীবিকার উপায় পাওয়ার আশায় সাংবাদিকদের নিকট আকুতি জানান তিনি।
বাচ্চু শেখ জানান, স্ত্রী ও তিন সন্তানের সাথে পালের গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি নিয়ে এখানে বসত গড়েছেন। এখানে আসার পর একবার এলাকার চেয়ারম্যান কিছু চাল আর শুকনো খাবার দিয়ে গেছে। তাতে তো আর সকলের পেট বাঁচে না বলে তার আক্ষেপ।
শহরের আলিয়াবাদ ইউনিয়নের বর্ধিত পৌরসভার ২৫ নং ওয়ার্ডের হরিসভার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব নারী নুরজাহান বেগম বলেন, ‘হঠাৎ কইর্যা বানের পানিতে বাঁধ ভাইঙ্গ্যা ঘরবাড়ি তলায় গেছে। ঘরের মাল-ছামানাও কিছু বাইর করতি পারি নাই। পাঁচজন ছাওয়াল-মাইয়ার সাথে গরু-বাছুর নিয়্যা রাস্তার ওপর পলিথিন আর বাঁশের বেড়া দিয়্যা ঘর তুইল্যা রইছি। এখন কয়ডা টিন পাইলে ঘরডা তুলতি পারতাম।’
হাফিজা খাতুন নামে ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘পরিবারের হগলতিরে নিয়্যা আইজ প্রায় একসপ্তাহ রাস্তায় পইর্যা রইছি। আমাগের অবস্থা যেমন তেমন, গরু ছাগলের খাবারও জুটাইতি পারতেছি না। অবলা প্রাণির খিদের অভাবে চিৎকার করে। সহ্য করা যায় না।’
শহরের টিবি হাসপাতাল মোড় থেকে পূর্বদিকে চলে গেছে গুচ্ছ গ্রামের সড়ক। যেখানে শুধুই হতদিরদ্র পরিবারের বাস। এই বন্যায় ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় এসব পরিবার এসে আশ্রয় নিয়েছে উঁচু সড়কে। সেখানকার মানুষের দুর্ভোগ যেন আরও বেশি।
পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সড়কে আশ্রয় নেয়া এক পরিবারের গৃহিণী আছিয়া বেগম বলেন, ‘গত পাঁচদিন হইলো এহেনে (রাস্তায়) উঠছি। একবার চিড়্যা আর মুড়ি দিছিল। তারপর আর কেউর দেখা নাই। এহন কি কইর্যা দিন চলবি আমাগের।’
চলমান বন্যায় বানভাসি মানুষের মাঝে এখন শুধু এমনই হাহাকারের চিত্র। গত দুই সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানিতে ফরিদপুরের সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলার চরাঞ্চলে প্রথমে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করে। এরপর গত চার পাঁচদিনে বিভিন্ন স্থানে পানি বেড়ে যাওয়ায় ও বাঁধ ভেঙে পড়ায় প্লাবিত হয়েছে এসব উপজেলার আরও বিস্তীর্ণএলাকা। এছাড়া আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পানি বেড়ে বিভিন্ন খালনালা দিয়ে পানি প্রবেশ করেছে পার্শ্ববর্তী ভাঙ্গা ও নগরকান্দা উপজেলাতেও।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় এক লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বন্যার্তদের মাঝে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা দেয়া হচ্ছে দাবি করে বলেন, বানভাসি মানুষদের জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫৫০ মেট্রিক টক চাল, সাত হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও নগদ ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসব সামগ্রী সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।
‘ত্রাণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে,’ দাবি করেন জেলা প্রশাসক।