দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। ১৯৯৬ সালে অতি দরিদ্র (নাকি বঞ্চিত?) পিতা যখন মারা যান তখন রেখে যান স্ত্রী, ৪ কন্যা ও তিন পুত্র। অর্থাৎ, আলোচ্য শিক্ষার্থীরা ১৯৯৬ সাল থেকে পিতৃহীন ৭ ভাই-বোন। অকুল পাথারে পড়ে যাওয়া চিরায়ত গ্রামবাংলার একজন মা কিভাবে ৭ সন্তানকে নিয়ে এতদূর আসলেন সে গল্প আজ থাক। কারণ, আমাদের অনেকের জীবনমানের বিচারে 'এতদূর আসা'- এই শব্দদুটিকে কেবলই বঞ্চিত মানুষের সংগ্রাম আড়াল করার কিতাবি পায়তারা মনে হয়। শুধু একটি তথ্য দেই যে, আলোচ্য শিক্ষার্থীটিকে তার মা এতিমখানায় রেখে আসতে বাধ্য হন যেখানে কেটে যায় শিক্ষার্থীর শৈশবের ৮ বছর।
যাই হোক, শিক্ষার্থীটির চার বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। তারাও কতদূর এগোলো বা পেছালো সে গল্পও থাকে। এই গল্পের দৃশ্যপটে তারা না থাকাই বরং আমাদের জন্য স্বস্তির। দুই ভাইয়েরও বিয়ে হয়েছে। দুই ভাইই দিন মজুর। এক ভাইয়ের চার মেয়ে ও আরেক ভাইয়ের এক মেয়ে। ছোট্ট একটি জীর্ণ মাটির ঘরে ততোধিক ছোট-ছোট তিনটি কক্ষের একটিতে এক ভাইয়ের পরিবার, আরেকটিতে আরেক ভাইয়ের পরিবার এবং শেষটিতে শিক্ষার্থীর মা নাতনিদের নিয়ে থাকেন। লকডাউনের কিছুদিন আগেই এক ভাইয়ের একটি অপারেশনে ঋণের বোঝা পরিবারটির মাথায়।লকডাউনের আঘাতে পরিবারটি আর্থিকভাবে রীতিমতো দিশেহারা। তো, আমাদের উল্লেখিত শিক্ষার্থীটি কোথায় থাকে জানতে চান? বারান্দায় বেড়া দিয়ে।
যারা অনলাইন ক্লাসের বাধ্যবাধকতার কথা বলছেন তারা কি একটু দয়া করে জানাবেন যে এই শিক্ষার্থীটিকে যদি আমরা ডেটা সাপোর্ট দিয়েও দেই, তার বাড়িতে কি ক্লাসে মনোযোগ দেয়ার পরিস্থিতি রয়েছে? এই অবস্থা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাজার-হাজার শিক্ষার্থীর।
এটিকে একটি ক্ষুদ্র এথনোগ্রাফি বলা যায় কিনা জানি না। তবে, এথনোগ্রাফির নিয়ম মেনে (শিক্ষার্থীর অনুমতিক্রমে) তাদের বাড়ির একটি ছবি সংযুক্ত করলাম। আমাদের আধুনিক বাস্তুসংস্থানবিদ্যার নান্দনিকতায় বেমানান লাগলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
এ লেখা যখন লিখছি তার কিছুক্ষন আগেই প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে ঢাবি নৃবিজ্ঞান বিভাগের আমার এক শিক্ষার্থী ফোন দিলো। আসলে আমি সকাল থেকেই ওর খোঁজ করছিলাম। কিন্তু ওর মোবাইল সংযোগ পাচ্ছিলাম না। লকডাউনের আর্থিক কষাঘাতে ওর পরিবার ইতোমধ্যে জর্জরিত। আজ কেমন আছে সে খবর নেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। একটি ম্যাসেজ পাঠিয়ে রেখেছিলাম। রাতে ফোন করে জানালো যে ওদের গ্রামে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতে বিদ্যুতের ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে যায় গত রাতে বা আজ ভোরে। বিদ্যুৎ আসে আজ সন্ধ্যায়। মোবাইলে চার্জ ছিলোনা।
শেষ করছি আমার গ্রামের বাড়ির অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমার গ্রামে আমাদের বাড়ির অধিকাংশ পরিবারের ঘরেই নেটওয়ার্ক খুব, খুব দুর্বল। আমাদের ঘরে নেটওয়ার্ক থাকেনা বললেই চলে। মোবাইলে কথা বলার জন্য আমাদেরকে বারান্দায় বা ঘরের বাইরে উঠানে বা ঘরের পেছনে পুকুর পাড়ে যেতে হয়।
সকলের মঙ্গল কামনা করি। কেটে যাক এই দুর্যোগ।
লেখক: অধ্যাপক রাশেদ মাহমুদ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।