বিলেতের নামী দৈনিক গার্ডিয়ান, বলা যায়, কাতারিদের চেহারার একটি দিক অনেকটা নগ্নভাবেই উন্মোচন করে দিয়েছে। সেই দিকটি হলো দরিদ্রদের মানুষের হিসাবের মধ্যে গণ্য না করার মন-মানসিকতা। কাতারিরা এখানে যে ব্যতিক্রম তা অবশ্য বলা যায় না। তেল ও গ্যাস সম্পদের কল্যাণে রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের বেলাতেই এটা প্রযোজ্য। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে যাওয়া নারীদের প্রতি সৌদি রাজা-বাদশাহদের আচরণের খবর তো আমরা নিত্যই সংবাদ মাধ্যমে পাচ্ছি। সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে আরও আমরা জানছি কিভাবে আমার দেশের হত-দরিদ্র মানুষজন স্বপ্নের পেছনে তাড়িত হয়ে সেইসব দেশে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছেন। তবে জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করে প্রাণ বিসর্জন দেয়া নিশ্চয় যারা এদের কাজে লাগাচ্ছেন তাদের জন্য অনেক বড় পাপ।
২০২২ বিশ্বকাপের জন্য আটটি স্টেডিয়াম কাতার নির্ধারণ করে নিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি হবে একেবারেই আনকোরা নতুন স্টেডিয়াম, মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে খেলার ক্লান্তি সহনীয় করে তুলতে শীততাপ নিয়ন্ত্রণসহ স্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি যেখানে যুক্ত থাকবে। এছাড়া এসব স্টেডিয়াম স্থাপত্য নির্দেশনার দিক থেকেও হবে চমকপ্রদ। সেরকম কয়েকটি স্থাপনার নকশা করেছেন প্রয়াত বিলেতবাসী ইরাকি স্থপতি জাহা হাদিদ। তার নকশা করা কয়েকটি স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া অবস্থাতেই শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জানা গেলে পশ্চিমের সাংবাদিকরা একসময় এই স্থপতির কাছে জানতে চেয়েছিলেন বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত কিনা। উত্তরে জাহা হাদিদ সরাসরি বলেছিলেন যে এটা তার বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যদিকে কাতারি কর্তৃপক্ষ এসব মৃত্যুকে নির্মাণ সম্পর্কিত মৃত্যু নয় বলে বার বার দাবি করে আসছে। এরকম অবস্থাকেই মনে হয় বলতে হয় প্রদীপের নিচে অন্ধকার।
বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন, বিশেষ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অনেকদিন থেকেই বলে আসছে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের নামে যা হচ্ছে সেটা হলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। হাজার হাজার মৃত্যুর উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি কয়েক বছর আগে বলেছিল কাজের অমানবিক পরিবেশ হচ্ছে এসব মৃত্যুর পেছনে প্রধান কারণ। এরকম সমালোচনার জবাবে কাতার সরকার ২০১৪ সালে খসড়া একটি শ্রমিক কল্যাণ মানদণ্ড প্রণয়ন করলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি যে আদৌ হয়নি, গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন সেই প্রমাণ আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
আমরা জানি আন্তর্জাতিক সম্প্রচার কেন্দ্রের দাবিদার নিউজ চ্যানেল আল জাজিরা কাতারি আমিরদের টাকাপয়সায় পরিচালিত। নিজেদের আন্তর্জাতিক চরিত্র নিয়ে গৌরব করে গেলেও বিশ্বকাপের পেছনের নানারকম অনিয়ম আর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দূরে থাক, এমন কি তেমন কোনো সংবাদও এই চ্যানেল প্রচার করেনি। বরং অভিযোগের তীর উত্থাপিত হতে যাওয়া অবস্থায় দৃষ্টি সবসময় অন্যত্র সরিয়ে নিতে দূরের দেশগুলোতে গণতন্ত্র কটা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, দুর্নীতি কিভাবে সেইসব দেশকে গ্রাস করছে, সেদিকে নজর দিয়েছে অনেক বেশি। তেলের অর্থে ভাড়া খাটতে আসা চ্যানেলের টক শো'র বড় বড় চাইরাও মানবাধিকার ধুলায় গেল বলে বুক চাপড়ালেও যেখানে তারা বসে আছেন সেখানে যে কি ঘটছে সেদিকে নজর দেয়ার সময় এদের হয়নি।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হওয়ার অধিকার অর্জনের পর থেকে গত দশ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা থেকে কাতারে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ৬৫০০ জন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। অন্য হিসাবে মৃত্যুর এই হার হচ্ছে গড়ে প্রতি সপ্তাহে ১২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছেন ১,০১৮ জন। এই সংখ্যা খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই, কেননা প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে আছে বঞ্চনা আর প্রতারিত হওয়ার করুণ কাহিনী। গার্ডিয়ান সেরকম এক হতভাগা বাংলাদেশির কথা উল্লেখ করেছে, যার নাম হচ্ছে মোহাম্মদ শহীদ মিয়া।
আমাদের এই ভাগ্যহত শহীদ মিয়া দালালের হাতে আনুমানিক প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে কাতারে গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। সেই টাকা যে ছিল পরিবারের মালিকানার সামান্য জমি বিক্রির বাইরে ধার-কর্যের টাকা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেখানে তিনি গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। আমরা ধরে নিতে পারি শহীদ মিয়া কাতারে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র প্রায় বছর তিনেক। এই অল্প সময়ের মধ্যে ধার কর্য করে দালালকে দেয়া টাকার অর্থের সামান্য এক অংশই কেবল উঠে আসতে পেরেছে। শহীদ মিয়ার আত্মীয়-স্বজনরা বলছেন তারা এখন পরিবারের এই সদস্যের কাতারে যাওয়ার অর্থের যোগান দিতে গিয়ে ঋণভারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং শহীদ মিয়ার মৃত্যুতে কাতার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনোরকম ক্ষতিপূরণ তারা পাননি।
কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারানোদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি মনে হয় সরকারের পক্ষ থেকে কাতার সরকারের সামনে উপস্থাপন করা উচিৎ। কেননা, বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করতে যাওয়া একটি দেশের জন্য নির্মাণ কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো হচ্ছে বাধ্যতামূলক। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে সেখানে ক্ষতিপূরণ দেয়াটাও সেরকম অগ্রসর বলে দাবি করা একটি দেশের জন্য আবশ্যকীয়।
ভারত এদিক থেকে দেশের নিহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও অনেক কাঠখড় দেশটিকে এজন্য পোড়াতে হয়েছে। গার্ডিয়ানের একই প্রতিবেদনে যেমন ভারতীয় শ্রমিক মধু বোল্লাপাল্লির মৃত্যুর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রায় বছরখানেক ধরে আলোচনার শেষে বোল্লাপাল্লির মৃত্যুর জন্য পরিবারকে মাত্র দেড় লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজী হয়েছে কাতারি কর্তৃপক্ষ।
কাতারে বিশ্বকাপ সম্পর্কিত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে ঝুকিপূর্ণ কাজে জড়িত থাকা অবস্থায় শ্রমিকের মৃত্যুর পাশাপাশি আরও যে একটি ব্যবস্থা দেশটিতে প্রচলিত আছে, সেটাকে অন্য অর্থে দাস ব্যবস্থা বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বেশ কয়েক বছর ধরেই আল কাফালা নামের এই দাস ব্যবস্থা তুলে নেয়ার জন্য দেশটির উপর চাপ দিয়ে আসছে। এমনকি বিশ্বকাপ অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য ফিফা ও উন্নত বিশ্বে ধর্না দেয়ার হুমকিও আইএলও একসময় দিয়েছিল। ফলে চাপের মুখে কাতারি কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে আল কাফালা তুলে নেয়ার বিষয়ে বিশ্ব শ্রম সংস্থার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও সেই চুক্তি এখনও কাগজে কলমে আটকে আছে। এই আল কাফালা ব্যবস্থার অধীনে শ্রমিকদের জন্য কাজের জায়গা বদলের উপর, এমন কি চাকরিদাতার অনুমোদন ছাড়া দেশত্যাগের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপিত আছে। ফলে অনেকেই এটাকে আধুনিক যুগের দাসপ্রথা আখ্যায়িত করে থাকেন। এই আল কাফালা নিয়েও আল জাজিরার কোনো রকম দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। অন্যের ফাঁক ফোঁকর খুঁজে দেখার সন্ধানে এরা এতই ব্যস্ত যে ঘরের ভেতরে কি হচ্ছে তা দেখার সময় এদের যেন একেবারেই নেই।
এসব কারণেই এখন আবারও আওয়াজ উঠেছে যে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ অন্য কোনো দেশে সরিয়ে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প বোধ হয় এখন আর নেই। বিভিন্ন দেশের তারকা ফুটবলাররাও মরুভূমির গরমে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা শুরু থেকেই করে আসছিলেন। তবে কাতারের অর্থের সামনে এদের সেই প্রতিবাদ একসময় আগের বলিষ্ঠ অবস্থান হারিয়ে ফেললেও এখন মনে হয় ধীরে ধীরে আবারও তা জেগে উঠতে শুরু করেছে। মানবাধিকার লজ্জিত হওয়া নিয়ে ক্রীড়াবিদদের অনেকেই আজকাল সচেতন।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাজের পরিবেশ উন্নত করার দাবি জানানোর পাশাপাশি গত এক দশকে প্রাণ হারানো হাজারের বেশি হতভাগ্য শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ লাভের দাবি নিয়ে কুয়েতের কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থিত হওয়ার এখন মনে হচ্ছে সবচেয়ে যুতসই সময়। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার ত্রুটি দেশটির সম্প্রচার মাধ্যম ধরিয়ে দেয়ায় আমরা কৃতজ্ঞ। তবে আমরা আরও বেশি তৃপ্ত অনুভব করবো যদি সেই দেশটি নিজের ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো স্বীকার করে আরও কিছুটা সভ্য আচরণ দেখাতে এগিয়ে আসে। কেননা, বিশ্বকাপ ফুটবল তো কেবল খেলার আনন্দের কথাই বলে না। একই সাথে আমরা যেন বিশ্ব সমাজের যোগ্য অংশীদার হয়ে উঠতে পারি, সেই দাবিও এই আয়োজন আমাদের প্রতি জানায়।