তিস্তা
তিস্তা নদী ভাঙনে দিশেহারা কুড়িগ্রামের মানুষ
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি গ্রামের অসুস্থ্ কৃষক সুবির উদ্দিন (৭০) চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘দুই দিনোত চাইর একর জমি তিস্তা গিলি খাইল বাহে। হামারগুলার বাড়ীঘর, জায়গাজমি সউগ শ্যাষ। হামরা এ্যালা কোটে যাই, কোটে থাকি। থাকপের কোন জায়গা নাই।’
তার বাড়ী লাগোয়া ছোট ভাই মহির উদ্দিনের ছেলে রহিমুদ্দি (৪৪) জানায়, ‘ওই যে পানি দেখছেন। ওই জায়গায় হামার দুই ভাই আর চাচার বাড়ি আছিল। বাড়ির পাশোত এক একর জমিত আলু লাগাইছিনু। নদীতে সব ধ্বংস। এখন হামরা নিঃস্ব হয়া গেইলং।’
এরকম সরব আর নিরব কান্না ভেসে বেড়াচ্ছে কুড়িগ্রামের তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকাকে ঘিরে। গত এক সপ্তাহে তিস্তা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা আর স্বপ্নকে।
আরও পড়ুন: স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় তিস্তাপাড়ের কৃষকেরা
বৃহস্পতিবার সরজমিন এসব এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে ভাঙনের তান্ডব লীলা। প্রচন্ড স্রোতের তোড়ে রামহরি গ্রামের বাড়ীঘর আর গ্রামের ফসলি জমির নদীতে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
এই গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে কৃষক আব্দুল জলিল (৫২) জানান, ‘৬ বিঘা জমিতে ধান লাগাইছি। আর ১০/১২দিন পর কাটা যাইতো। সেই আধাপাকা ধানের জমির অর্ধেকটা নদী ভাঙনে শ্যাষ হয়া গেল। এখন বাকী ধান গরুকে খাওয়ার জন্য কাটা লাগছে।’
রামহরি ভূঁইয়াটারী গ্রামে রাহেলা বেগম (২৬) এর বাড়ীর কাছেই এসেছে নদী। স্বামী মমিনুল আর দুই সন্তানকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। রাহেলা জানান, ‘এবার নিয়া চারবার বাড়ী ভাঙছে। আমরা কামলা খাটি জীবন চালাই। নজিমুদ্দি ভূঁইয়া আমাদের দুরবস্তা দেখি এখানে থাকপের দিছে। এখন বাড়ি ভাঙলে আমাদের থাকবার বা বাঁচার কোন পথ থাকপে না।’ তার সাথেই বাড়ী ঢাকার গার্মেন্টস কর্মী আমিনুল ইসলামের। তার স্ত্রী পারভীন (২৮) জানান, ‘এই জায়গাতে ১০ বছর ধরি আছি। এতদূরে নদী আসবে কল্পনাই করি নাই। এখন বাড়ী ভাঙতে হবে ভাবতেই বুকটা হু-হু করি উঠছে।’
সবচেয়ে বেশি ভাঙছে ঘরিয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের উজানে সরিষাবাড়ী আর গতিয়াসাম এলাকায়। এখানে প্রতিনিয়ত ভাঙছে তিস্তা নদী। গতিয়াসাম বগুড়া পাড়ায় দেড় থেকে দুইশ জন শ্রমিক কাজ করছে বাড়ী ভাঙ্গার কাজে। প্রতিটি বাড়ি থেকেই শোনা যাচ্ছে হাতুড়ির শব্দ। যত্নে লাগানো গাছগুলোও কাটছে কেউ কেউ। সড়ানো হচ্ছে আধাপাকা ঘরের ইট,বেড়া আর টিনের চাল। সবার চোখে মুখে হতাশা আর বোবা কান্না।
আরও পড়ুন: তিস্তায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে সরকার: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
এই গ্রামে নদী ভাঙনের শিকার লালবানু (৫০) সাংবাদিক দেখে ক্ষোভ নিয়ে জানালেন, ‘তোমরাগুলা ছবি তুলি কি করবেন। হামরা মরি যাই, আর তোমরা ছবি তোলেন। হামার যে ক্ষতি হয়া গেইল। তা কি সরকার দিবে।’
কলেজ পড়ুয়া শাওন সরকার (২২) জানায়, এখানে মন্ত্রী আসে, এমপি আসে, জেলা প্রশাসক, ইউএনও স্যার আসে। শুধু দুঃখ প্রকাশ করে শেষ। কিন্তু কোন কাজ হয় না। আমরা এই মূহূর্তে নদী ভাঙন রোধে দ্রুত কাজ চাই।
তিস্তায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে সরকার: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
তিস্তা নদীর ভাঙন স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার তিস্তায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে বলে দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের ডিজাইন ও প্রজেক্ট প্রোফাইল শেষ হয়েছে। এটি অনেক বড় প্রজেক্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। কবে নাগাদ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তিস্তা পারের মানুষের আর দুর্দশা থাকবে না।‘
শুক্রবার সকালে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের গতিয়াশাম এলাকায় তিস্তা নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।
এনামুর রহমান বলেন, উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় কুড়িগ্রামসহ চারটি জেলায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বন্যার্ত ও ভাঙন কবলিতদের দুর্দশা লাঘবে কাজ করে যাচ্ছে।
পড়ুন: তিস্তার ঢলে লালমনিরহাট-রংপুর সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
তিনি বলেন, চারটি জেলার প্রতিটিতে ৫০ মেট্রিক টন চাল, ৫ লাখ টাকা, চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, পশু খাদ্যের জন্য আরও ২ লাখ টাকা এবং ১০০ বান্ডিল করে ঢেউটিন বরাদ্দ করা হয়েছে। পরবর্তীতে বন্যার্ত ও নদী ভাঙনের শিকার প্রতিটি পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পরে প্রতিমন্ত্রী সরিষাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, তেলসহ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন।
এসময় কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসীন, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলী, রাজারহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদ সোহরাওয়াদ্দী বাপ্পি, উপজেলা নিবার্হী অফিসার নূরে তাসনীম, ঘড়িয়ালডাঙা ইউপি চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ কর্মকার বক্তব্য দেন।
পড়ুন: তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে, রেড অ্যালার্ট জারি
তিস্তা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিল ভারত, ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি
তিস্তার ঢলে লালমনিরহাট-রংপুর সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
তিস্তার প্রবল স্রোতে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা-রংপুর সংযোগ সড়কের পাকা রাস্তা ধসে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে দুই জেলার সঙ্গে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বুধবার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় উপজেলার কাকিনা রুদ্রশ্বর মিলনবাজার এলাকার গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর সংযোগ সড়কে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, দুপুর থেকে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীর গতিপথ পরির্বতন হয়ে কাকিনার রুদ্রেশ্বর গ্রামে ঢুকে যায়। গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর সংযোগ সড়কে চাপ পেয়ে তা ধসে যায়। ফলে লালমনিরহাট জেলার সাথে রংপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এদিকে রাত থেকে তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন। উদ্ধার কার্যক্রমে উপজেলা প্রসাশনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সহায়তা করছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস সামাদ বলেন, সড়ক ধসে যাওয়ায় কাকিনা-রংপুর যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
পড়ুন: তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে, রেড অ্যালার্ট জারি
কুড়িগ্রামে উজানের ঢলে বন্যার আশঙ্কা, বৃষ্টি থাকবে আরও দু'দিন
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে কয়েকদিন ধরে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বৃষ্টি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কুড়িগ্রামেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, যা আগামী দু'দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিস। দু’দিন থেকে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারণে বিপাকে পড়েছে এখানকার খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষ।
বুধবার (২০ অক্টোবর) রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী ভারি বর্ষণ, উজানের ঢল ও ভারতের গজলডোবার সব কয়টি গেট খুলে দেয়ায় তিস্তার পানি দোয়ানি পয়েন্টে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তিস্তা ব্যারাজের সড়কের 'ফ্লাট বাইপাস' ভেঙে গেছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪ গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
আরও পড়ুন: তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে, রেড অ্যালার্ট জারি
কুড়িগ্রাম পৌর শহরের রিকশা চালক আব্দুল রহিম জানান, সকালে আকাশ ভালো দেখে বাড়ি থেকে বাহির হয়ে শহরে আসার পর থেকে বৃষ্টি চলছে। প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘন্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষের কি হবে? কোন যাত্রী পাচ্ছি না মানুষ বাসা থেকে বাহির হচ্ছে না। এরকম সারাদিন বৃষ্টি থাকলে তো আজ বাজার নিয়ে বাড়ি যেতে পারবো না।
রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানান, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট লঘুচাপের বৃষ্টি হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় কুড়িগ্রামে ৩৭ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই বৃষ্টি আগামী শুক্রবার পর্যন্ত চলতে পারে। তারপর আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে পারে। পাশাপাশি চলমান বৃষ্টির প্রভাবে কুড়িগ্রামের দিনের গড় তাপমাত্রা কমে এসেছে। বৃষ্টির প্রভাবে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের তিস্তা নদীতে অস্থায়ী বন্যা হতে পারে।
আরও পড়ুন: তিস্তা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিল ভারত, ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, উজানের ঢলের প্রবাহিত পানি বাঁধের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। চরাঞ্চলের বাসিন্দারা সাময়িক সময়ের জন্য পানিবন্দি হতে পারেন। এই পানি দ্রুত নেমে যাবে বলেও জানান তিনি।
তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে, রেড অ্যালার্ট জারি
ভারতে বন্যার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের তিস্তা নদীতেও। এতে এরইমধ্যে ভেঙে গেছে তিস্তা ব্যারাজের লালমনিরহাট অংশের একটি বাঁধ। হুমকির মুখে অন্য বাঁধগুলোও। এদিকে ব্যারাজ রক্ষার্থে রেড এলার্ট জারি করে তিস্তার তীরবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বুধবার (২০ অক্টোবর) দুপুর থেকে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহ আরও কি পরিমাণ বাড়তে পারে তার ধারণা নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের।
এদিকে উজানের ঢলে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েও পানি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামল বলেন, তিস্তা নদীর পানি হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বড়খাতা টু হাতীবান্ধা বাইপাস সড়কটির বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে। এতে তার ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে গেছে লালমনিরহাট জেলার পাঁচ উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী হাজার হাজার একর ফসলি জমি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, পানির চাপে তিস্তা ফ্লাড বাইপাস ভেঙে গেছে। এতে তিস্তার তীরবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের মাধ্যমে বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিবার বন্যার আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বন্যার আগাম পূর্বাভাস জানানো হলেও এবার তা জানানো হয়নি। ফলে বন্যার পানিতে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।
আর পড়ুন: তিস্তা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিল ভারত, ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া’র নির্বাহী প্রকৌশলী আসফুদ্দৌলা বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে তিস্তার পানি বেড়ে ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। বুধবার সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুপুর ১২টায় বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে ইতোমধ্যে ব্যারজের ফ্লাড বাইপাসটি পানির চাপে ভেঙে গেছে। তিস্তার পানি ক্রমেই বাড়ছে। আরও কি পরিমাণ পানি আসতে পারে তা ধারণা করা যাচ্ছে না।
পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলে, ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখেও পানি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। আমরা তিস্তা অববাহিকায় লাল সংকেত দিয়ে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেছি।
আরও পড়ুন: তিস্তা-ধরলা পাড়ে ভাঙন, সরকারি ভাতার বদলে বাঁধ চায় এলাকাবাসী
তিস্তা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিল ভারত, ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি
উজানের ঢল ও ভারতের গজলডোবার সবগুলো গেট খুলে দেয়ায় বাড়ছে তিস্তার পানি। তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি।
বুধবার (২০ অক্টোবর) ভোর থেকে তিস্তার পানি বাড়তে থাকায় লালমনিরহাটের তিন উপজেলার তিস্তার চর এলাকায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর ধানক্ষেত। পানির তোড়ে ভেঙে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট। ঘর-বাড়িতে পানি প্রবেশ করায় পরিবারগুলো উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। তিস্তা ব্যারেজের ফ্লাট বাইপাস সড়কও হুমকির মুখে পড়েছে।
আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তিস্তা শুকিয়ে জেগে উঠেছিল চর। হঠাৎ তিস্তার পানিতে সব ডুবে গেছে। কার্তিক মাসে এমনভাবে পানি বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, মঙ্গলবার রাত থেকে তিস্তার পানি বেড়ে ডালিয়া পয়েন্টে ৫২ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বুধবার সকাল ১০টায় ওই পয়েন্টে ৫৩ দশমিক ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপরে। তিস্তার পানি ক্রমেই বাড়ছে।
এদিকে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, সিঙ্গামারি, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পড়ুন: ভারতে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভূমিধসে নিহত ২১
তিস্তায় সার্বিক নদী ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু অভিযোজন জরুরী: ক্লাইমেট পার্লামেন্ট
তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং নদী অববাহিকায় জলবায়ু অভিযোজন ও সহনশীলতা গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করেছে সংসদ সদস্যদের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নেটওর্য়াক ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) নিলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়াস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসর রেস্টহাউজের সভাকক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক সংলাপে ক্লাইমেট পার্লামেন্টের সদস্যরা এসব কথা বলেন।
আরও পড়ুন: তিস্তার ভাঙন: কুড়িগ্রামের ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি নদী গর্ভে
আলোচনায় বক্তারা বলেন, জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতার অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনায় একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে শুধু তিস্তাই নয়, তিস্তার শাখা-প্রশাখা-উপশাখার খনন এখন সময়ের দাবি। তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা বলতে শুধুমাত্র পানি ব্যবস্থাপনা নয়, তিস্তাকে ঘিরে জীববৈচিত্র্য, তিস্তা-নির্ভর মানুষের জীবন-জীবিকা, তিস্তা অববাহিকার ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা একইসাথে গুরুত্বপুর্ণ।
বক্তারা বলেন, নদীর বিজ্ঞানসম্মত খনন, তীর রক্ষা, শাখা নদীগুলো উন্মুক্তকরণ, শাখা নদী খনন করা জীবনের স্বার্থেই অপরিহার্য। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার নির্মাণও করতে হবে। নদী-তীরবর্তী কৃষি ব্যবস্থাপনা, সমবায়ী কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। তিস্তার দুই পাড় ভালোভাবে বাঁধানো গেলে ভাঙনের হাত থেকে পাঁচ জেলার নদীর তীরবর্তী মানুষ নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে বক্তারা আশা প্রকাশ করেন।
আরও পড়ুন: তিস্তা-ধরলা পাড়ে ভাঙন, সরকারি ভাতার বদলে বাঁধ চায় এলাকাবাসী
ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের আহ্বায়ক নাহিম রাজ্জাক এমপির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আনোয়ারুল আবেদীন খান এমপি, সেলিম আলতাফ জর্জ এমপি, ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রকাশ কর্মসূচির আইবিপি ম্যানেজার আবুল বাশার, প্রতীকি যুব সংসদের চেয়ারপার্সন মো. আমিনুল ইসলাম, নির্বাহী প্রধান ও ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সমন্বয়কারী সোহানুর রহমান,ও আর্থ সোসাইটির মাইশা নওশীন প্রমুখ।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব হাসানের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন উপজেলা চেয়ারম্যান মো. তবিবুল ইসলাম, ভাইস-চেয়ারম্যান নীরেন্দ্র নাথ রায়, মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান মোছা.আয়েশা আক্তারসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, উন্নয়ন সংস্থা ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
আরও পড়ুন: তিস্তা সেচ এলাকায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন
আলোচনা শেষে ক্লাইমেট পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প ও ভাঙন কবলিত এলাকা এবং চর পরিদর্শন করেন।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রকাশ কর্মসূচির আওতায় এই পরিদর্শন ও ক্লাইমেট টক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করছে প্রতীকি যুব সংসদ, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস এবং আর্থ সোসাইটি।
তিস্তা ফুঁসছে, খুলে দেয়া হয়েছে ৪৪ গেট
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প এলাকায় উজানের ঢলের পানিতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তিস্তা তীরবর্তী পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন র্বোড।
শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১ টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিকের থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বন্যায় কুড়িগ্রামে ভোগান্তি চরমে
জানা গেছে, ভারী বর্ষণের কারণে ভারত গজল ডোবা ব্যারেজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়। এতে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করে। তিস্তার পানিতে পাটগ্রামের বহুল আলোচিত বিলুপ্ত ছিটমহল আঙ্গোরপোতা-দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের চর, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, সদর উপজেলার রাজপুর, খুনিয়াগাছ, গোকুন্ডা ইউনিয়ন ও কালীগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলের প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া তিস্তার সাথে ছোট নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। কিছু কিছু স্থানে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। নতুন করে ভাঙন আতঙ্কে অনেকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নিচ্ছেন।
হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারীর পানিবন্দি মানুষরা জানান, বন্যার পানি নামতে না নামতেই চতুর্থবার আবার পানিতে বন্দি হয়ে পড়েছেন তারা। তাই দ্রুত তিস্তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি করেন তারা।
আরও পড়ুন: মাগুরায় বন্যার পানিতে রাস্তা ডুবে জনদুর্ভোগ চরমে
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে তিস্তা ও ছোট নদ-নদীতে পানি বেড়েছে। তবে তিস্তার পানি বিকেল থেকে কমে যেতে পারে।
তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে, খুলে দেয়া হয়েছে সব গেট
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি আবারও বেড়েছে। তিস্তা অববাহিকায় আবারও প্লাবিত হয়েছে চরের নিম্নাঞ্চলগুলো।
শুক্রবার দুপুরে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা তিস্তা ব্যারাজ দোয়ানী পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২.৬৮ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপরে। তিস্তা ব্যারাজ রক্ষায় ৪৪ টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
পাউবো সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ওই দিন সকালে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সন্ধ্যায় তা কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত রবিবার দুপুরের পর থেকে তিস্তা নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সন্ধ্যা ৬ টায় পানি ৫২.৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সোমবার দুপুরে তা কমে ৫২.৬৮ সেন্টিমিটার প্রবাহিত হয়।
আরও পড়ুন: পদ্মার পানি বৃদ্ধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী
জানা যায়, তিস্তা ব্যরাজ এলাকায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলও ফের ডুবে গেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে আবারও পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী, সিঙ্গীমারী, সিন্দুনা, পাটিকাপাড়া ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, চরবৈরাতী, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের চোরাহা, দক্ষিণ বালাপাড়া, কুটিরপাড়, চর গোবরধন এবং সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
দোয়ানী-ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লা আল মামুন বলেন, তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারত থেকে প্রচন্ড গতিতে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। এ কারণে পানির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। আরও কি পরিমাণ পানি আসবে তা ধারণা করা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: তিস্তা-ধরলা পাড়ে ভাঙন, সরকারি ভাতার বদলে বাঁধ চায় এলাকাবাসী
বাংলাদেশ কখনও ঋণের ফাঁদে পড়বে না: চীনা রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন যে, বাংলাদেশকে কখনও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঋণ বা কথিত ঋণের ফাঁদে পড়ার চিন্তা করতে হবে না। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সহযোগিতায় ‘ঋণ’ কখনও কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চাবি-কাঠি হয়ে উঠবে না বলে আশ্বস্ত করেন চীনা রাষ্ট্রদূত। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ খুব দক্ষতার সাথেই বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা করে আসছে।
চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ‘আমি অবশ্যই বলবো যে, আপনারা খুবই দক্ষতার সাথে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা করেছেন এবং আপনাদের কোনও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঋণ নেই। আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম অর্জন করেছে। তাই, কথিত ঋণের ফাঁদ নিয়ে চিন্তা করবেন না।’
আরও পড়ুন: কসমস সংলাপ: ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
বৃহস্পতিবার কসমস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক: ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় (ওয়েবিনার) এক প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন চীনা রাষ্ট্রদূত। অনুষ্ঠানটি কসমস ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে লাইভ সম্প্রচার করা হয়।
উক্ত আলোচনায় উদ্বোধনী ও সমাপনী বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান এবং সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কূটনীতিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।এছাড়া সভায় আলোচক প্যানেলে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম, সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের এম চৌধুরী, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী গবেষক ড. জু ইওংমেং, চীনা ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহকারী গবেষণা ফেলো ড. নিং শেংনান, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। ওয়েবিনারে মূল আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
আরও পড়ুন: দ্রুতই টিকা রপ্তানি শুরু করতে পারে সেরাম
আলোচনার এক পর্যায়ে চীনের অর্থায়নে সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার ঋণের ফাঁদে পড়ার বিষয়টি উঠে আসে। ঋণের ফাঁদ বর্তমান বিশ্বে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আর এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ অঞ্চলে চীনের ব্যাপক ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলার অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংস্থা।
এরই প্রেক্ষিতে চীনা রাষ্ট্রদূত জানান, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর কোনও দেশেই ঋণের ফাঁদ তৈরির চেষ্টা করেনি চীন। তিনি দাবি করেন এমন কোনও কার্যক্রমের প্রমাণ নেই।লি বলেন, ‘আপনাদের দেশে সুপরিকল্পিত নীতিগত কাঠামো এবং দক্ষ কর্মকর্তা ও মন্ত্রী রয়েছেন। তাই আপনাদের এই ব্যাপারে চিন্তিত হবার কিছু নেই।’এসময় চীনা রাষ্টদূত জানান, সম্প্রতি এক নিবন্ধ পড়ে তিনি জানতে পারেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান মোট ঋণের মাত্র ৮ শতাংশ চীনের কাছ থেকে নেয়া। তাছাড়া, এই ৮ শতাংশ ঋণের অধিকাংশই বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে রয়েছে।
আলোচনায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চীন বাংলাদেশের শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে পরিণত হচ্ছে। দেশের বড়-বড় প্রকল্পগুলোতে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে। তার মতে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে চীনের এমন অর্থনৈতিক কাযক্রমকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ঋণের ফাঁদ হিসেবে উল্লেখ করছে। আর এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
তবে এই অর্থনীতিবীদ বলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে এবং দেশের মোট ঋণের বড় অংশই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া।’কিন্তু ২০২৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক শুধুমাত্র ঋণের কারণেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে, বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে মোদির চিঠি: মানবজাতি শিগগিরই মহামারি কাটিয়ে উঠবে
ওয়েবিনারে ঋণ বিষয়ক আলোচনার জবাবে চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বর্তমান চলমান সম্পর্ক ও বাংলাদেশের প্রতি চীন সরকার ও জনগণের সমর্থনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি দুই দেশের সুসম্পর্ক বাংলাদেশকে আরও লাভবান করবে বলে আশ্বস্ত করেন।
বাংলাদেশের সুতোয় বাঁধবে চীন-ভারত সম্পর্ক
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশ চীনের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় চীনা রাষ্ট্রদূত বেশ হৃদ্যতা প্রকাশ করেন। তার মতে, ভারতকে কখনও নিজেদের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেনি চীন।তিনি বলেন, ‘চীন কখনও ভারতকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না। আমরা মনে করি আমাদের (চীন-ভারত) সম্পর্ক আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। তাই এটা কখনও ভাববেন না যে, ভারতের প্রতি চীনের বিদ্বেষমূলক মনোভাব রয়েছে। এমন কিছুই নেই।’
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা সংকট: জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ চায় বাংলাদেশ
ভারতের মানুষ ও এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে লি বলেন, ‘আমরা এখনও অনেক বিষয়ে একসাথে কাজ করে যাচ্ছি। আর ঐতিহাসিক ভাবে গত দুই থেকে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দুই অঞ্চলের মানুষের মাঝে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আছে। যেকোনও শিক্ষিত চীনা নাগরিকের ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আলাদা একটি শ্রদ্ধার জায়গা রয়েছে, যা কখনও জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়নি।’
ভারত সম্পর্কে চীনা রাষ্ট্রদূতের আলোচনার আলোকে কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান ২০০৪ সালে চীনের বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই-এর (তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) সাক্ষাৎকার নেয়ার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ভারত-চীন সম্পর্কে মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই উত্তর দিয়েছিলেন- ভারত এবং চীনের মাঝে সেতু বন্ধন করতে পারে বাংলাদেশ।’
আরও পড়ুন: ভ্যাকসিন বাণিজ্যে স্বচ্ছতার আহ্বান বাংলাদেশের
প্রযুক্তির আদান-প্রদান
প্রযুক্তির আদান-প্রদান বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত লি জানান, বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে ব্যাপক হারে প্রযুক্তির আদান-প্রদান চলছে।এসময় উদাহরণ হিসেবে লি আরও জানান, বেশ কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের কাছ থেকে পোশাক আমদানি করতো না চীন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের এক নম্বর রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্প খাত চীনেও জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এখন চীনে পোশাক আমদানি করছে।এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনাদের তৈরি পোশাক শিল্প খাত এখন এতটাই উন্নতি করেছে যে, বাংলাদেশের কাছ থেকে চীন গারমেন্টস পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে, দুই দেশের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির আদান-প্রদান ঘটছে।’
আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা দেবে জার্মানি
‘কোয়াড’ প্রসঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূতের ভাবনা
আলোচনার এক পর্যায়ে একজন আলোচক চীন বিরোধী আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের জোট- কোয়াড প্রসঙ্গ তুলে আনেন। এ বিষয়ে গত মে মাসে লি জিমিং এর মন্তব্য চীন-বাংলাদেশের মাঝে বেশ অস্বস্তির তৈরি করে।কোয়াড প্রসঙ্গ উঠে আসায় চৈনিক এই কূটনীতিক নিজের সাফাই দেয়ার সুযোগটি লুফে নিয়ে জানান, একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি শুধু এই জোটে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভাবনার কথা আলোচনা করতে চেয়েছিলেন।এসময় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হবার পর এদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে প্রথম যা জানতে পেরেছি, তা হলো বাংলাদেশ সকলের সাথে বন্ধুত্বে বিশ্বাস করে এবং কারো সাথে বৈরিতায় জড়াতে চায় না। তাই আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ কোনও ক্ষুদ্র চক্রান্তকারী গোষ্ঠির সাথে জড়াবে না, বিশেষ করে কোনও যুদ্ধবাজ সামরিক জোটে।’
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিনের জন্য চিকিৎসা সামগ্রী গ্রহণ করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
তিস্তা প্রকল্প
চীনের অর্থায়নে তিস্তার গভীরতা বাড়ানো প্রকল্পের ব্যাপারে লি জিমিং কে প্রশ্ন করা হয়।তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা প্রকল্পের ব্যাপারে যে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত সাধারণ মানের।চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্রস্তাবনার ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনারা প্রথমে একটি পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাই এর প্রতিবেদন তৈরি করুন। এর পরে আমরা এই প্রকল্প মূল্যায়নের কাজ শুরু করবো। এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক, প্রকৃতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটগুলোও আমাদের যাচাই-বাছাই করতে হবে।’