সরকারি ভাতা
তিস্তা-ধরলা পাড়ে ভাঙন, সরকারি ভাতার বদলে বাঁধ চায় এলাকাবাসী
তিস্তা ও ধরলার পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত তিন দিনে প্রবল ভাঙনে প্রায় শতাধিক পরিবারের বসতভিটা এবং আবাদি জমি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে।
হুমকির মুখে রয়েছে বাঁধসহ নানান স্থাপনা। বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই তীব্র ভাঙনে দিশেহারা লালমনিরহাটের তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাট সদর উপজেলায় মোগলহাটের ফলিমারী এলাকায় ধরলা নদীর ডান তীরে গত তিন দিনে নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বসতভিটা ও ভুট্টাসহ অর্ধশত বিঘা আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। গৃহহারা হয়েছেন অনেক পরিবার। অসহায় পরিবারগুলো স্থানীয় বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে আছেন।
আরও পড়ুন: যাদুকাটা নদীর ভাঙনে বিলীনের পথে সুনামগঞ্জের ২ গ্রাম
এদিকে তিস্তার ভায়াবহ ভাঙনে লালমনিরহাট আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের কুটিরপাড়, বালাপাড়া, বাদিয়ারটারী ও চৌরাহা গ্রামে গত তিন দিনে তিস্তা নদীর গর্ভে বিলিন হয়েছে ২০টি পরিবারের বসতভিটা। এছাড়া অর্ধশত বসতভিটা ও শতাধিক একর আবাদি জমি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। কুটিরপাড় এলাকার এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি বালুর বাঁধ হুমকিন মুখে পড়েছে। এই বাঁধটি স্থানীয়রা নিজ অর্থায়রে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন। এই বাঁধ রক্ষায় তিস্তা পাড়ের হাজারও পরিবার আশায় আছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত তিন দিনে তিস্তার প্রবল ভাঙনে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের কুটিরপাড় এলাকায় শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়াও ঝুঁকিতে থাকা অর্ধশত বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: বালু উত্তোলন: মাগুরায় মধুমতির ভাঙনে দিশেহারা এলাকাবাসী
এলাকাবাসীর দাবি, ‘আমরা চিড়া, গুড়, মুড়ি, বিধবা ও বয়স্ক ভাতা চাই না আমার তিস্তার বাঁধ চাই।’
উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, গত দুই দিনে ভিটেমাটি গিলেছে তিস্তা। সব হারিয়ে পরিবার নিয়ে আজ তিনি রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ফলিমারী গ্রামের বাসিন্দা জহুরুল হক মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত কয়েক দিন আগে চোখের সামনেই বসতভিটা ধরলা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এখন আশ্রায় নিয়ে আছেন অন্য জায়গায়।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, এ বছর বর্ষা আসার আগেই ধরলার ভাঙন দেখা দিয়েছে। বর্ষাকালে ভাঙন আরও তীব্র হতে পারে। ঝুঁকিতে থাকা অনেকে ঘর-বাড়ি সরিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: মাগুরায় মধুমতির ভাঙনে বসতভিটা, ফসলি জমি বিলীন
হঠাৎ তিস্তায় পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় চরাঞ্চলের সবজি, বাদাম ও ভুট্টাসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবকিছু পানিতে ডুবে গেছে, আর ভাঙতে শুরু হয়েছে। ভাঙ্গনের কারণে চিন্তিত তিস্তাপাড়ের মানুষরা। পানিবন্দী পরিবারগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদি পশুপাখি নিয়ে পড়েছে বিপাকে। তারা তাদের বাড়িঘর নিয়ে অনেকে ঠাঁই নিচ্ছেন অন্যের বাড়িতে।
তিস্তাপাড়ের ফাতেমা খাতুন আহাজারি করে বলেন, ‘হামাক বাঁচান ব্যাহে, হামার শোগ শ্যাষ। সব নদীত ভাঙ্গিয়া গেইছে ব্যাহে। হামাক বাঁচান। হামরা কৈ যাম কি খামো, শোগ নদী ভাঙি নিয়া যাবার লাগছে। সরকার এগুলা কি কইরবার লাগছে। হামাক বাঁচান ব্যাহে, হামা বাঁচান।’
তিস্তাপাড়ের আবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা রিলিপ-টিলিপ কিছু চাই না। বালুর বাঁধ থাকি শুরু করি নদীর পাশে যদি বস্তা দিত তাহল আর নদী ভাঙত না।’
তিস্তাপাড়ের মহিষখোচা বালাপাড়ার রজব পাড়ার শোভা বলেন, ‘আমাদের ভুট্টাবাড়ী ৪ দোন মাটি আবাদ কচ্চি। খুব কষ্ট করি। বাড়ি পাকা করছি তায়ও শোগ ভাঙি যাবার নাগছে। তোমরা বোল্ডার ফেলে দেও। তা হলে ভালো হবে। ৫০০ টাকার জন্য কি ভোট দেই তোমাক। হামার শরম লজ্জা থুইয়া হামরা ভোট দেই। বয়স্ক দেন, বিদুয়া দেন, আরও বাউরা হবে। আর খ্যায় লোব বাড়ি যাইবে। ওগলা বেবাক বন্দ করি দেন। ওই টাকা দেয়া বন্দ করি দেন। ওই টাকা দিয়া তোমরা বস্তা দেও বোল্ডার ফেলান।
তিস্তা নদীর ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে এসে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন বলেন, বালুর বাঁধটির অর্ধেকের বেশি বিলীন হয়েছে। বাকিটুকু রক্ষা করতে জিও ব্যাগ প্রয়োজন। যার চাহিদা পাঠাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বাঁধ নির্মাণের জন্য বাজেটের আবেদন করেছি, কিন্তু এখন পর্যান্ত বাজেট পাইনি। ভাঙ্গন এলাকায় কিছু বস্তা ফেলা হয়েছে যাতে করে ভাঙন রোধ করা যায়।’
এ বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, তিস্তার ভাঙ্গন এলাকা আদিতমারী ইউএনও পরিদর্শন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার মজুত আছে, ভাঙনকবলিত এলাকায় দ্রুত ত্রাণ বিতরণ করা হবে।’
৩ বছর আগে
জীবনযুদ্ধে হার না মানা প্রতিবন্ধী মাজহারুল, অনেক ঘুরেও পাননি সরকারি ভাতা
মাজহারুল ইসলামের (৩০) জন্ম থেকেই দু হাত, দু পা আঁকাবাঁকা। সমাজের সবাই কেমন যেন তুচ্ছ করে তাকায়। ছোটবেলা থেকেই মনটা বিধ্বস্ত। কিভাবে চলবে জীবন! কে ভালোবাসবে!
জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে বসে বসে মোবাইল সার্ভিসিং কাজকে বেছে নিয়েছেন জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী এই মাজহারুল ইসলাম। বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় ও নিজের আগ্রহে শিখেছেন মোবাইল মেরামতের কাজ। এরপর ধার-দেনা করে মোবাইল সাভির্সিংয়ের দোকান দিলেন বাড়ির আঙ্গিনাতেই, অভয়পাড়া রাস্তার পা্শে। তার নিজ নামেই রাখা হয়েছে দোকানের নাম ‘মাজহারুল মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার’।
আরও পড়ুন: প্রতিবন্ধী ও চাকরিদাতাদের সেতুবন্ধনে কাজ করবে ‘ইমপোরিয়া’: প্রতিমন্ত্রী পলক
চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার বিতারা ইউনিয়নের (৫ নং ওয়ার্ড) অভয়পাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান মোল্লার ছোট ছেলে মাজহারুল। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। স্থানীয় অভয়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপর সংসারের হাল ধরেছেন। বাবা-মায়ের কথায় ২০১৬ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সংসার ছেড়ে চলে যান তার স্ত্রী। গত বছর মারা যান তার বাবা।
দুঃখ করে বললেন, দীর্ঘদিন একটি প্রতিবন্ধী ভাতার বইয়ের জন্য এলাকার মেম্বর,ও চেয়ারম্যানের অফিসে ঘোরাঘুরি করেও তা ভাগ্যে জুটেনি মাজহারুলের। আশা ছেড়ে দেন মাজহারুল ইসলাম। পরে মা ও বড় ভাইয়ের উপদেশে সিদ্ধান্ত নেন কারো কাছে হাত না পেতে নিজ উদ্যোগে কিছু করার। এলাকায় এক বড় ভাইয়ের দোকানে মোবাইল সার্ভিসিং, মোবাইল রিচার্জ ও ইলেক্ট্রনিক্সের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ শেখেন। পরে নিজেই বাড়ির কাছে ছোট্ট একটি দোকান দিয়েছেন। এতেই ধীরে ধীরে তিনি হয়ে যান মোটামুটি স্বাবলম্বী। প্রতিদিন প্রায় ৩০০-৪০০ টাকার মতো আয় করেন তিনি। পরিবারের কাজেই খরচ করতে হয়। তার এই আঁকাবাঁকা হাতগুলোই এখন রুটি রোজগারের ও পরিবারের একমাত্র চালিকাশক্তি।
আরও পড়ুন: ট্রেনে নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন বরাদ্দে হাইকোর্টের রুল
মাজহারুল ইসলাম জানান, ২০১৯ সালে একটা প্রতিবন্ধীর কার্ড পেয়েছেন বটে কিন্তু কোনো ভাতার বই আজও পাননি।
স্থানীয় মেম্বর ইউনুস অফিসের ঝামেলার কথা বলে ভাতার বইয়ের জন্য যেতে বললেন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে।
নিজের কাজ করার ইচ্ছাশক্তি থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ ও অর্থাভাবে এগিয়ে যেতে পারছেন না মাজহারুল। তাই সরকারি কিংবা বেসরকারি একটু সহায়তা পেলে তিনি দোকানটির কর্মপরিধি বৃদ্ধির পাশাপাশি ঘুরে দাঁড়াতে পারতেন আর মেয়ে, মা ও বোনকে নিয়ে মোটামুটিভাবে চলতে পারতেন।
মাজহারুল বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও সংসার করার স্বপ্ন দেখি, কিন্তু কিছুই সম্ভব হচ্ছে না। শুধু আমার চার বছরের মেয়েটা আমায় ভালোবাসে। বিয়ে করলেও বউ আমাকে ছেড়ে চলে যায় আড়াই বছর পরে। রেখে যায় ছোট্ট এ মেয়েটাকে।’
আরও পড়ুন: ভিক্ষা নয়, কাজ করেই জীবন বদলাতে চান প্রতিবন্ধী রহিম
মাজহারুল ইসলামের মা নিলুফা বেগম (৫৬) বলেন, ‘সরকার যদি আমার অসহায় প্রতিবন্ধী ছেলেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা করতেন তাহলে ছোট্ট দোকানটিতে কিছু মালামাল তুলে কোনোভাবে বাকি জীবন পার করে দিতে পারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে পুতুল তো দেশের প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক কাজ করছেন, দেশও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এর কোনো ফল এখনো পাচ্ছি না। কবে পাবো আশায় আছি।’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে কচুয়া উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার মোহাম্মদ আকতারুদ্দীন প্রভাত ইউএনবিকে বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম অফিসে এসে দেখা করলে আমরা তাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়ার জন্য কাযর্কর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
৩ বছর আগে