ইয়াস
জলোচ্ছ্বাসে ডুবেছে সুন্দরবন, ভেসে আসছে বন্য প্রাণী
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ডুবে যায়। কয়েক ঘণ্টা ধরে নোনা পানি (লবণ পানি) সুন্দরবনে আটকে ছিল। বনের মধ্যে ৫ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে জোয়ারের সময় পানি বাড়তে থাকায় বন্য প্রাণী দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে থাকে।
জলোচ্ছ্বাসের কারণে দুদিন জোয়ারের সময় গোটা সুন্দরবন জলোমগ্ন হয়ে পরে। বনের কোন কোন অংশে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট গাছ-পালা সম্পূর্ণ পানিতে ডুবে ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বণ্য প্রাণীর খাদ্য ও আবাসস্থল। জলোচ্ছাসে বন থেকে ভেসে যাওয়া মৃত এবং জীবিত ৬টি হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। লবণ পানি ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির উৎস পুকুর।
আরও পড়ুন: ভারত উপকূলে আঘাত আনলো ঘূর্ণিঝড় ইয়াস
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন বন্য প্রাণীদের নিরাপদ আবাসস্থল। জলোচ্ছাসের কারণে বনের সব ধরণের বন্য প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লবণ পানি বনে আটকে থাকার কারণে বনভূমিও অতিমাত্রায় লবণাক্ত হবে। সুন্দরবনে বন্য প্রাণীর প্রজননের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে। সব মিলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের উপর প্রভাব পড়বে ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসের কারণে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য সুন্দরবন এক প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবাসীকে রক্ষা করে চলেছে। প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, বুলবুল এবং আম্ফান প্রথম তাণ্ডব চালায় সুন্দরবনে। পরে দুর্বল হয়ে এসব ঝড় উপকূলে আছড়ে পড়ে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব প্রথমে সুন্দরবনে পড়ে। নদ-নদী ও খালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়। বুধবার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে সুন্দরনবনের বিভিন্ন অংশ ডুবে যায়। জোয়ারের সময় সুন্দরবনের মধ্যে ৫ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবারও জোয়ারের সময় সুন্দরবনে দুই ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয় বলে বন বিভাগ জানান।
আরও পড়ুন: ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের সম্ভব্য ক্ষতি এড়াতে চট্টগ্রামে প্রস্তুতি সম্পন্ন
বৃহস্পতিবার বিকালে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জ অফিসের কাছে একটি ছোট এবং একটি বড় হরিণকে গলা সমান পানির মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে স্থানীয় সাংবাদিকরা।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন চালতেবুনিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর জমাদ্দার জানান, জোয়ারের সময় সুন্দরবনের দিক দিকে একটি বন্যশুকর ভেসে যেতে দেখেছে।
আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে ১৬ গ্রাম প্লাবিত
বন সংলগ্ন খুড়িয়াখালী গ্রামের জেলে তুহিন ও ইউসুফ জানান, মাছ ধরে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনে তাদের আসা যাওয়া। কিন্তু বনের মধ্যে এত পানি তারা আগে কখনো দেখেনি। সুন্দরবনের মধ্যে মাথা সমান উচু পানিতে বিভিন্ন ধরণের বন্য প্রাণী ভেসে যাওয়ার কথা। এখনো বনের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে আছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) গবেষক অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ক্রমাগত এই ধরণের ঝড় জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। এই ধরণের দুর্যোগ মোকাবিলা করে পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসতে সাধারণত ২৫ বছর সময় লাগে। কিন্তু প্রায়ই সুন্দরবনের উপর দিয়ে ঝড়-জলোচ্ছাস বয়ে যাচ্ছে।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, অস্বাভাবিক জোয়ারে গোটা সুন্দরবনে লবণ পানি প্রবেশ করেছে। বনের মধ্যে ৫ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়েছে। পানিতে সুন্দরবনের ৫৫টি মিষ্টি পানির পুকুরে লবণ পানি প্রবেশ করেছে। মিষ্টি পানির সংরক্ষণের জন্য ওই সব পুকুর খনন করা হয়। বনের স্টাফ এবং বন্য প্রাণীরা তাদের পানির চাহিদা মিটাতো ওই সব পুকুর থেকে। পানির কারণে কিছু বন্য প্রাণী বনের মধ্যে পুকুর পাড়ে উচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। ছোট এবং দুর্বল প্রকৃতির কিছু হরিণ ভেসে যেতে পারে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে বন্য প্রাণীর কিছু ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী আরও জানান, ভবিষ্যতে এই ধরণের জলোচ্ছ্বাসের কথা বিবেচনায় নিয়ে সুন্দরবনে বন্য প্রাণীদের আশ্রয়ের কথা চিন্তা করে বনের মধ্যে উচু কেল্লা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
খুলনায় বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’র প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনার কয়রা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের কয়েকটি পোল্ডারে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিশাল জনগোষ্ঠী নোনা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। দাকোপের একাধিক স্থানে নদী ভাঙন ও পানি উপচে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনগোষ্ঠী।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: সাতক্ষীরার ৪৪ পয়েন্টে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ
সাতক্ষীরা উপকূলবর্তী এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট নিম্নচাপের রেশ এখনো কাটেনি।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছে।
এদিকে, ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরার ৪৪ পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে শ্যামনগরে ২৪টি, আশাশুনিতে ১২, কালিগঞ্জে পাঁচ ও দেবহাটায় একটি পয়েন্ট রয়েছে। বুধবার বিকাল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এসব বেড়িবাঁধ স্থানীয় লোকজন সংস্কারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে ১৬ গ্রাম প্লাবিত
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইয়াসের প্রভাবে কারণে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে মৎস্য শিল্পে। কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে নদীর সাথে মিশে গেছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।
ইয়াস অতিক্রম করার সময় নদীতে ৮ থেকে ৯ ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। তবে বুধবার বিকালে নদীতে ভাটার টানে প্রচুর পরিমাণ পানি নেমে গেছে। ফলে রাতে জোয়ারের পানি ৩ থেকে ৪ ফুট কমে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা নদীতে দ্রুত পানি কমে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
অপরদিকে, ইয়াসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সগঞ্জ ও রমজাননগর ইউনিয়ন এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রিউলা ইউনিয়ন। বুধবার দুপুরে ইয়াস অতিক্রম করার সময় জলোচ্ছাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে বিস্তিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। এদিন রাতে শ্যামনগর উপজেলার ২৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ আশ্রয় নেয়। তাদের অধিকাংশের বাড়িঘর পানিতে ধসে পড়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে অনেকেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ আশ্রয় কেন্দ্রে রাতে খাবার পৌঁছায়নি। খাবার পানির তীব্র সংকট দুর্গত এলাকায়। এই মুহূর্তে দুর্গত এলাকায় খাবার পানি ও শুকনো খাবারের প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: 'ইয়াস' মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধিদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, যে সমস্ত এলাকায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মেরামতের জন্য বুধবার বিকাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার অনেক মানুষকে সংস্কার কাজে লাগানো হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অধিকাংশ জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি।
তিনি জানান, এ পর্যন্ত ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৬৩ মেট্রিক টন খাদ্য মজুদ রয়েছে। বৃহস্পতিবার শুকনো খাবার বরাদ্দ আসার কথা রয়েছে।
জোয়ারের পানিতে ভেসে এল দুটি মৃত হরিণ
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পানির চাপে বন থেকে ভেসে যাওয়া দুটি চিত্রল হরিণ মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
বুধবার বিকালে সুন্দরবনের দুবলারচর এবং বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী থেকে মৃত ওই হরিণ দু’টি উদ্ধার করে বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজন।
তবে পানিতে সুন্দরবনের বন্য প্রাণীর কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা জানাতে পারেনি বন বিভাগ। তবে পানিতে সুন্দরবনের মিষ্টি পানির পুকুর ও অফিসসহ বেশ কিছু অবকাঠামোর ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে বন বিভাগ।
আরও পড়ুন: ভোলায় ইয়াসের প্রভাবে চরাঞ্চল প্লাবিত, ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা ডুবে যায়। বুধবার দুপুরে জোয়ারের সময় সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে ৫ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়েছে। পানির চাপে সুন্দরবন থেকে ভেসে যাওয়া দু’টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। পরে ওই মৃত হরিণ দু’টি মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।
বেলায়েত হোসেন জানান, ইয়াসের প্রভাবে ঝড় ও জলোচ্ছাসে সুন্দরবনের ১১টি জেটি, ৬টি মিষ্টি পানির পুকুর, বন বিভাগের দু’টি অফিস, একটি স্টাফ ব্যারাক, ১২টি রাস্তা, একটি ফুটটেইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভোলায় ইয়াসের প্রভাবে চরাঞ্চল প্লাবিত, ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলার ওপর মেঘনা নদীর জোয়ারের পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপে মনপুরায় দুটি স্থান দিয়ে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। জেলার দুর্গম অন্তত ৩০টি চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে ভোলার লালমোহন উপজেলায় আবু তাহের (৪৮) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার রাত সোয়া ৯টার দিকে লালমোহনের কালমা ইউনিয়নের চর কলমি ফরাজি বাজারের কৃষক আবু তাহের (৪৫) প্রকৃতির ডাকা সারা দিতে ঘরের বাইরে যায়। এ সময় ঝড়ো বাতাসে গাছের একটি ঢাল ভেঙে তার নিচে চাপা পড়েন তিনি। এতে তার বুকের পাজর ভেঙে যায়। তাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে লালমোহন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে তাকে রাতেই ভোলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১১ টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে বুধবার সকাল থেকে উত্তাল হয়ে উঠেছে মেঘনা নদী। জোয়ারের পানিতে জেলার মনপুরা, চরফ্যাসনের ঢাল চর, কুকুরি মুকরি, চরনিজাম, চর জহিরউদ্দিন, মাঝের চর, মদনপুর, চরপাতিলা, চরজ্ঞান, সোনার চর, কুলাগাজীর তালুক, চর যতিন, চর শাহজালাল, কলাতলীর চরসহ প্রায় ৩০টি নিম্নাঞ্চল ৩-৫ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাসহ বিস্তীর্ন এলাকা ডুবে আছে। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। ফলে উপকূলে আতঙ্কছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন সাইক্লোন সেল্টারে।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: বাগেরহাটে ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি
ভোলা সদরের শিবপুর ইউনয়নের চেয়ারম্যাস জসিম উদ্দিন জানান, তার এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে অন্তত অর্ধশত ঘর জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে জোয়ার এলে পরিবার নিয়ে সাধারণ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
রাজাপুর ইউনিয়নের আমির হোসেন জানান, রাজাপুরের বেড়িবাঁধের বাইরে কন্দকপুর, রুপা পুর, রামদাসপুরসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
চরফ্যাসন উপজেলার সাগর মোহনার ঢাল চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম জানান, তার ইউনিয়নে প্রায় ৬-৭ শত ঘর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ।
ইয়াসের প্রভাবে খুলনায় ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াস অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে খুলনায় ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি বৃষ্টি হচ্ছে। মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে সহস্রাধিক আশ্রয় কেন্দ্র
ভারত উপকূলে আঘাত আনলো ঘূর্ণিঝড় ইয়াস
ভারতের পূর্বাঞ্চল উড়িষ্যার উপকূলে আছড়ে পড়েছে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।
বুধবার সকালে ঘূর্ণিঝড়টি উড়িষ্যায় আছড়ে পড়ে।
উড়িষ্যার আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, রাজ্যের বেলাশুর জেলার ধামরার উত্তর দিকে এবং বাহানাগার দক্ষিণ দিকে আছড়ে পড়ে। আঘাতে সময়ে ঘূণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০ থেকে ১৫০ কি.মি.।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায়
উড়িষ্যার শীর্ষ ত্রাণ কর্মকর্তা পি.কে. জেনা ইউএনবিকে জানান, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানা শুরু করেছে এবং এটি অতিক্রম হতে আরও ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা লাগতে পারে।
তার মতে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে রাজ্যের বেলাশুর ও ভদ্রাক জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যেই প্রায় ৫ লাখ ৮০ বাসিন্দাকে অন্যত্র সড়িয়ে নেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে ১৬ গ্রাম প্লাবিত
এদিকে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার থেকেই রাজ্যের সচিবালয়ে অবস্থান করছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে কন্ট্রোল রুমের সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন তিনি।
এদিকে সতর্কতা স্বরূপ কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
ইয়াসের প্রভাবে ভোলায় থেমে থেমে ঝড়ো বাতাস ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলার উপর দিয়ে বুধবার সকাল থেকে থেমে থেমে ঝড়ো বাতাস ও মাঝে মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ভোলায় ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছে এবং ২৪ ঘণ্টায় ১৫.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে ভোলার লালমোহন উপজেলায় আবু তাহের (৪৮) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায়
এদিকে বুধবার সকাল থেকে উত্তাল হয়ে উঠেছে মেঘনা নদী। জোয়ারের পানিতে গেলো রাতে জেলার মনপুরা, চরফ্যাসনের ঢাল চর, কুকুরি মুকরি,চরনিজাম, চর জহিরউদ্দিন, মাঝের চর, মদনপুরসহ প্রায় অর্ধশত নিন্মঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে ১৬ গ্রাম প্লাবিত
সাগর মোহনার ঢাল চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম জানান, তার ইউনিয়নে প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ ঘর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ।
অপর দিকে জোয়ারের পানিতে করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধের ১৭টি স্পট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ভোলার মনপুরাতে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ২০ মিটার ও চরফ্যাসনের মাদ্রাজে ১০ মিটার বিধ্বস্ত হয়ে পানি প্রবেশে করেছে।
আরও পড়ুন: 'ইয়াস' মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধিদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাবুল আক্তার জানান, গেলো রাতে ভোলার মেঘনা নদীর পানি বিপদ সীমার ৫৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত বেড়ি বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক ই-লাহী চৌধুরী জানান, লালমোহনে গাছ চাপায় নিহত কৃষকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া জোয়ারে প্লাবিত হলে রাতে ঢাল চরে প্রায় ১ হাজার ২০০ লোককে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে ও কোস্ট ট্রাস্টে নিরাপদে সরিয়ে আনায় হয়। তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের সম্ভব্য ক্ষতি এড়াতে চট্টগ্রামে প্রস্তুতি সম্পন্ন
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় ইতিমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। ইতিমধ্যে ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে সারাদেশে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামে জেলা ও উপজেলায় প্রস্তুত করা হয়েছে ৫১১টি আশ্রয়কেন্দ্র। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টিম ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেডিকেল টিম। মজুদ করা হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায়
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক। তিনি ইউএনবিকে বলেন, জেলার আওতাধীন প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। উপকূলীয় এলাকায় প্রশাসনের উদ্যোগে চলছে সচেতনতামূলক মাইকিং।
এদিকে ঘুর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবেলায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দামপাড়াস্থ বিদ্যুৎ অফিসে ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে।
চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী নগরবাসীকে ঘুর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জনান।
আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে ১৬ গ্রাম প্লাবিত
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নম্বর ০৩১-৬৩০৭৩৯ অথবা ০৩১-৬৩৩৬৪৯।
বুধবার মেয়রের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম জানান, উপকূলীয় ওয়ার্ডগুলোতে ৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির প্রধান কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিম বলেন, নগরীর পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলীসহ উপকূলীয় ওয়ার্ডগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি আমরা। এসব এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ড কার্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং দামপাড়ায় চসিকের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে।
পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে ১৬ গ্রাম প্লাবিত
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়ায় বিধ্বস্ত বেড়িবাধ দিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চ জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় ৯টি গ্রাম পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ওইসব গ্রামের প্রায় ৮ হাজার মানুষ।
এছাড়া রাঙ্গাবালী উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের বাইরের সকল নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলসহ ৭টি গ্রাম ৩ থেকে ৪ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। চর মোন্তাজ ইউনিয়নের চর আন্ডার বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ।
ফলে এইসব এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। কয়েকশ পুকুর ও ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। রাতের জোয়ারে আরও পানির চাপ বাড়তে পারে বলে শঙ্কায় রয়েছেন এলাকাবাসী।
আরও পড়ুন: 'ইয়াস' মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধিদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর
এদিকে, কলাপাড়ার নীলগঞ্জের ইউনিয়নে যে কোন সময় প্লাবিত হতে পারে অন্তত ১২টি গ্রাম। এতে পানিবন্দি হওয়ায় শঙ্কায় রয়েছে ১২ হাজার মানুষ।
ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের নিরাপদ আশ্রয়সহ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গাবালি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসফাকুর রহমান ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক।