সর্বশান্ত হয়ে পড়া এ প্রবীণ হতাশা জানিয়ে বললেন, ‘বাপ-দাদার সয়-সম্পদ সউগ (সব) গেইছে। মনে করছিনু থাকমো এ বছর। কই থাকপের পাই। পয়সাও নাই কিদি (কি দিয়ে) জাগা নিমো (নিবো)। কারো বাড়িত ধাপড়ি তুলি থাকা নাগবে (লাগবে)।’
তার অসহায়ত্বের মধ্যে দিয়ে যেন গোটা নদী ভাঙনের কারণে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়া পরিবারগুলোর আঁকুতি ঝড়ে পড়ছিল। বাড়ির পাশে তার তিন বিঘা অবশিষ্ট জমিও গত এক সপ্তাহে গিলে খেয়েছে প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র নদ। কারো শেষ আশ্রয়, কারো ঘরে তুলবার পাকা ধানী জমি, গাছপালা এবং বাপ-দাদার কবরও রেখে যায়নি। চোখের সামনে নিজের সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া দেখে কান্না চেপে রাখতে পারছেন না কেউই।
গত সোমবার সকালে সরেজমিন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের ডানতীরে বসবাসকারী ভাঙন কবলিতদের সাথে কথা বলেন ইউএনবির এই প্রতিনিধি। জানা যায় তাদের দুর্দশার কথা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনুমোদন পেয়ে এ ইউনিয়নের ১২০০ মিটার এলাকা বাদ রেখে দুদিকে প্রায় ৫ কিলোমিটার ব্যাপী এলাকায় স্থায়ী নদীতীর সংরক্ষণ কাজ শুরু হয়েছে। মাঝখানে ১২০০ মিটার এলাকা উন্মুক্ত রাখায় ওই এলাকার ৪ গ্রামের শতশত মানুষকে সর্বশান্ত করে ফেলেছে। গত ৫ বছরে এই গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বারবার নদী ভাঙনের ফলে নিঃস্ব হয়েছে পরিবারগুলো। এতে দেড় হাজার পরিবার ২ হাজার একর জমি হারিয়ে হয়েছেন সহায়-সম্বলহীন।
ওই এলাকার কলাতি পাড়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ব্যবসায়ী ছেলে আব্দুল হাই, নীলকণ্ঠ গ্রামের জহুরুলের ছেলে মহুবর দর্জি ও আব্দুস ছোবহানের ছেলে আব্দুল মোত্তালেব দর্জি জানান, হাতিয়া ইউনিয়নের উত্তরে পালেরঘাট এলাকার প্রফুল্ল পালের বাড়ি থেকে দক্ষিণে কলাতিপাড়া গ্রামের অপিজলের বাড়ি পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এতে গত ৬ মাসে নীলকণ্ঠ গ্রামের ২৫৯টি বাড়িসহ গোটা গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়াও হাতিয়া বিল গ্রামের ৬০টি বাড়ি, রামখানার ১১টি বাড়ি, কলাতিপাড়ার ৭০টি বাড়িসহ মোট ৩৯০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
ভাঙন কবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিরুপ আবহাওয়া ও বৃষ্টির মধ্যেও বাড়িঘর সরাচ্ছেন দক্ষিণের কলাতিপাড়া গ্রামের শেষ বাড়ির সদস্য দিনমজুর অপিজল। তিনি বলেন, ‘একদিকে করোনা অপরদিকে নদী ভাঙন। আমরা শ্যাষ হয়া গেলাম।’
বৃষ্টি আর করোনার কারণে প্রতিবেশি কেউ তাকে সহযোগিতা করতে আসছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ভাঙনের কারণে এরই মধ্যে এখান থেকে তার ভাতিজা রহিম বাদশাসহ ৭টি পরিবার খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী রিয়াজুল, সিরাজুল, আজিজুল, আহাম্মদ, মতি, আজিজ, বাবলু মন্ডল, বাহানন্দ, জায়দা, মমিনুল প্রস্ততি নিচ্ছে বাড়ি সরানোর। নদী ২০ হাত দূর থেকে উন্মত্ত হয়ে ধেয়ে আসছে বসতবাড়ির দিকে।
নদী ভাঙনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কলাতি পাড়ার মৃত ঢোলো মিয়ার ৫ ছেলে। তাদের ৪২০ শতক আবাদি জমি ও গাছপালা, আইজলের ২২০ শতক জমি, আব্দুল হাইয়ের ২০০ শতক জমি ও ৫ শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, মজিদ মুন্সির ৫৫ শতক আবাদি জমিসহ আরও প্রায় ৩৫/৪০ জনের জমিজমা বিলীন হয়ে গেছে।
বারবার নদী ভাঙনের শিকার নিঃস্ব পরিবারগুলো কিভাবে ঠাঁই নেন এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল অলিখিত কিছু অনিয়মের কথা।
এলাকাবাসীরা জানান, বাড়ি ভেঙে গেলে স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রতি শতক জমি ৩ হাজার টাকায় চুক্তি করে ৫ বছরের জন্য লিজ নেয়া হয়। যাদের টাকা যেমন আছে তারা তেমনভাবে বাড়ির জন্য জমিতে থাকার অধিকার পায়। এ ৫ বছরে নদীতে বাড়ি ভেঙে গেলে টাকা ফেরৎ পাবে না। ভাঙনকবলিতদের সামর্থ্য অনুযায়ী ৫ শতক থেকে এক বিঘা পর্যন্ত জমি লিজ নিয়ে থাকে। এ ৫ বছরে কারো সামর্থ্য হলে নিজেই জায়গা কিনে জমি ফেরৎ দিয়ে চলে যান। সরকারিভাবেও ভাঙন কবলিতরা কোনো সাহায্য পায় না।
হাতিয়া বাজারে পত্রিকা বিলি করে জীবিকা নির্বাহ করা মজিবরের ছেলে হকার ছকিয়ল বলেন, ‘নুরু পুলিশের জমিতে ১৫ হাজার টাকায় ৫ শতক জমি নিয়ে বসবাস করছিলাম। মাত্র দেড় বছরেই গত ১৮ দিন পূর্বে নদী সব ভেঙে নিয়ে গেছে। এখন জায়গা জমি না পেয়ে নীলকণ্ঠ গ্রামে বোনজামাই মোন্নাফের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।’
জিজ্ঞাসা করা হলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, উন্মুক্ত হাতিয়া অঞ্চলে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে ব্রহ্মপুত্র ডান তীর রক্ষা প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে। হাতিয়ায় উন্মুক্ত এলাকায় শিগগিরই কাজ বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।
এ ব্যপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের ডানতীরে ইতিমধ্যে অনুমোদনকৃত প্রকল্প থেকে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার ব্যাপী স্থায়ী নদী সংরক্ষণ কাজ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়ন এবং ভাটিতে চিলমারীর জোড়গাছ এলাকায় ১৭৫০ মিটার এলাকা গ্যাপ রয়েছে। এটাও আমরা অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আশাকরি এটা আমরা অনুমোদন পেলে শিগগিরই স্থায়ী নদী সংরক্ষণের কাজ শুরু করবো।
‘ইতোমধ্যে যেহেতু ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ভাঙন কবলিত হাতিয়া এলাকায় এক হাজার মিটারে জরুরি অস্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ শুরু করেছি,’ বলেন এ নির্বাহী প্রকৌশলী।