সংস্থাটির মতে, ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে গুরুত্ব না দেয়া, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সমন্বিত না হয়ে শুধু রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও কীটনাশক ক্রয়-নির্ভর হওয়া, বিক্ষিপ্তভাবে লোক দেখানো কার্যক্রম নেয়া এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং দুই শতাধিক মানুষ মারা যায়।
বুধবার টিআইবির ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘ঢাকা শহরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করা হয়।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্ট-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র গ্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরামের তত্ত্বাবধানে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয় এবং তা উপস্থাপন করেন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন ও মো. মোস্তফা কামাল।
বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হওয়া সত্ত্বেও ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কতটুকু কার্যকর হচ্ছে এবং কার্যকর না হলে কেন হচ্ছে না তা নিয়ে অনুসন্ধানী গবেষণার প্রয়োজনীয়তা থেকে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
গবেষণায় জানা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে আগাম পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ডেঙ্গুর ভয়াবহতাকে গুরুত্ব না দিয়ে সিটি করপোরেশনসহ সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি একে ‘গুজব’ বলে অভিহিত করেন। এডিস মশার উৎস গৃহস্থালীতে বেশি উল্লেখ করে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের দায় জনগণের ওপর চাপানো হয়। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ মশা জরিপে সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপোর পরিত্যক্ত টায়ারে এবং রেলস্টেশনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এডিস মশার জরিপ শুধুমাত্র ঢাকা- কেন্দ্রিক হওয়ায় বাইরে অন্যান্য জেলায় আগাম সতর্কবার্তা দেয়া সম্ভব হয়নি। ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র চিহ্নিত করাতেও ঘাটতি পাওয়া গেছে। সেই সাথে ঢাকার উভয় সিটি করপোরেশনেই উপযুক্ত কীটনাশক নির্ধারণ না করার অভিযোগ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
গবেষণায় দেখা যায়, দুই সিটি করপোরেশনেরই কীটনাশকের ক্ষমতা পরীক্ষা করানো বা কীটনাশক পরিবর্তন করার কোনো উদ্যোগ ছিল না। তাদের নিজস্ব কোনো ল্যাবরেটরি ও কীটতত্ত্ববিদ নেই। কোনো কীটতত্ত্ববিদ ছাড়াই সরকারি রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কীটতত্ত্ব বিভাগ চলছে। সেখানে চিকিৎসক দিয়ে কীটনাশকের কার্যকারতা পরীক্ষা করানো হতো, তবে বর্তমানে এ জরুরি পরিস্থিতিতে একজন কীটতত্ত্ববিদ সাময়িকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
কীটনাশক ও ফগার মেশিনের জ্বালানি ব্যবহার না করে বাজারে বিক্রি করে দেয়া, লার্ভিসাইড ব্যবহার না করে ফেলে দেয়া, ভবনে ফগিং করার জন্য ৫০ থেকে ২০০ টাকা নেয়া, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ঘাটতি, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর ছড়িয়ে পড়া রোধে বাস, ট্রেন ও লঞ্চে মশার স্প্রে ব্যবহারের কথা থাকলেও তা না করা এবং হোল্ডিং করদাতাদের জন্য অ্যারোসল ক্রয়, ডেঙ্গু মশার অ্যাপ তৈরি ও পরিষ্কার সড়কে ‘বর্জ্য পরিষ্কার’ করার মতো অপ্রয়োজনীয় ও লোক দেখানো ব্যবস্থার চিত্র উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ডেঙ্গু সমস্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো সমস্যা ছিল না। পর্যাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণসহ সতর্কীকরণ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অস্বীকৃতির মানসকিতা, প্রস্তুতি ও কৌশলের অভাব এবং যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে এডহক-ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সুনির্দিষ্ট কৌশলের অভাবে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা গুরুত্ব পায়নি। তুলনামূলকভাবে অকার্যকর রাসায়নিক ব্যবহারসহ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণমূলক ও অ্যাডাল্টিসাইট নির্ভর কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।’
কীটনাশক ক্রয়ের প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ক্রয় বিধিমালা অনুসরণ ও যোগ্যতার শর্ত পূরণ না করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এমন সংস্থাকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। বিল অনুমোদন, বিল প্রদান, পণ্য সরবরাহসহ সব পর্যায়ে অবৈধ লেনদেন হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক অপচয় হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্যের আনুমানিক ৪০ শতাংশ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে।