১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সুফল যা একটি কঠিন বাস্তবতা। এদেশের আপামর জনতার পরোক্ষ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, মা বোনের ইজ্জত, মানবিক বিপর্যয়, ত্যাগ তিতিক্ষার কথা ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। অসমাপ্ত রয়ে গেছে ইতিহাসের অনেক উপাদান। গবেষকরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
দেশের বাইরে থেকেও যারা যুদ্ধে সমর্থন জুগিয়েছিল তাদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকেই দেশের মাটিতে পা না দিয়েও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আছেন এবং ভাতা গ্রহণ করছেন। এমনকি বিজয়ের মুহূর্তে কোন অবদান না রেখেও শুধু মাত্র স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে নিহত হয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সম্বোধিত হচ্ছেন। কিন্তু উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক বাঙালিরা যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানে মানসিক চাপ, নির্যাতন, জেল ও অনেক কষ্ট করে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে নিগৃহীত হয়েছিলেন। তাদের ইতিহাস অনুচ্চারিত রয়ে গেছে।
সামরিক বেসামরিক সকল শ্রেণিই নিজের মাতৃভূমিতে ফেরত এসে বাঙালী মূল স্রোতের সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছিলেন। তাদের এই ত্যাগ তিতিক্ষা কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়? সে উদ্যোগ কেউ নিয়েছেন কি না জানা নেই।
জানামতে আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে । আফগানিস্তান হয়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় অনেকে দেশে ফিরেছেন। দুর্গম পর্বত অতিক্রম করতে গিয়ে নিজের কোলের সন্তান শত ফুট নিচে গড়িয়ে পড়েছে। পরিবার ছাড়া বসবাসকারী অনেকেই পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এসব কি ইতিহাসের উপাদান নয়?
এবার আসি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রসঙ্গে।
২৫ শে মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা চালায় তখন যুদ্ধের সূচনা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করে ও পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে সসস্ত্র প্রতিরোধে অংশ নেয়। সেদিন থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালী সদস্যরা গাদ্দার নামে অভিহিত হয়। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার শপথ ভঙ্গ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও গণ যোদ্ধাদের সম্মিলিত শক্তির মুখোমুখি পাকিস্তানী বাহিনী। অপর দিকে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালী সামরিক সদস্যরা ( তাদের ভাষায় গাদ্দার) কড়া নজরদারির আওতায় এলেন।
এসব ভুক্তভোগী অফিসারদের থেকে অনেক কিছু জানা যায়। যুদ্ধের প্রথম দিকে হালকা নজরদারি। এর মধ্যে সুযোগ বুঝে দু একজন যখন পালিয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় তখন আরও কড়া নজরদারি আরোপিত হয়। অনেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খাটেন, সুবিধা বঞ্চিত হন।
পাকিস্তান মিলিটারি সদর দপ্তর ধরে নিয়েছিল ডান্ডা মেরে বাঙালিকে দু একমাসের মধ্যে ঠান্ডা করে দেয়া যাবে। কিছুদিন পরেই বোঝা গেলো এ ধারণা ভুল। সামগ্রিক অবস্থা পাকিস্তানের অনুকূলে নয়। এর পর থেকে বাঙালীদেরকে যথাসম্ভব দায়িত্বপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। তাদেরকে বিভিন্ন স্থানে একত্রিত করে কঠিন প্রহরায় রাখা হলো। অদম্য বাঙালিরা এখান থেকেও পালিয়ে যাবার চেষ্টা চালিয়ে গেলো।
৭১ সালের যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে পাকিস্তানের পরাজয়ে ( পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তে) বাঙালিরা আরও রোষানলে পড়ে। এবার শুরু হয় সকল বাঙ্গালীদের একত্র করে দুটি গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী করা। একটি গ্রুপ অবিবাহিত ও সিঙ্গেল অফিসারদের, আরেকটি গ্রুপ পরিবারসহ বসবাসকারীদের। সৈনিকদের বেলায় ও একই অবস্থা। কড়া পাহারার মাঝে কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ, দেখা সাক্ষাৎ কিছুই সম্ভব নয়। দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও নেই। কবে ছাড়া পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পুনর্গঠনের কাজ চলছে। পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের ফেরত নেয়ার দৃশ্যমান অগ্রগতি না দেখে বন্দী শিবিরে অবস্থানরত ব্যক্তিরা আরো হতাশ হলেন।
আটকে পড়া বাঙ্গালীদের নিয়ে পাকিস্তানীরা নুতন ষড়যন্ত্র শুরু করে। যুদ্ধে বিপর্যস্ত ও পরাজিত পাকিস্তানীদের মনোবল শূন্যের কোঠায়। ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী কিভাবে কখন ফেরত আসবে। এর মাঝে অনেকের পুত্র, জামাই, নিকটাত্মীয় রয়েছে। এ ৯৩ হাজারের বিপরীতে পাকিস্তানীদের হাতে কোনো ভারতীয় যুদ্ধবন্দী নেই। তাই ওরা চেষ্টা চালালো আটকে পড়া বাঙালিদের যুদ্ধবন্দী বানিয়ে দর কষাকষির ক্ষেত্র তৈরি করার।
বন্দী শিবিরগুলোতে কঠোর নিয়ম কানুন চালু হলো । লয়ালপুর জেল, সাগাই দুর্গ, খাজুরি ক্যাম্পের বিভীষিকার কথা অনেক শুনেছি। বাইরে যোগাযোগ নেই, অর্থকষ্টে অনেকেই বিপদে ছিলো। বেসামরিক ঠিকাদারের সরবরাহকৃত খাবার ক্রয় করে খেতে হতো। কয়েকদিন পরপর বিছানাপত্র ব্যাক্তিগত বাক্স পেটরা তল্লাশি, রেডিও, টেপ রেকর্ডার ক্যামেরা ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করা হতো। সন্দেহ এতই প্রবল যে প্রায়ই দল বদল, রুম বদল, ক্যাম্প বদল ইত্যাদি রুটিন হয়ে দাঁড়ালো। ক্যাম্পের পাহারায় ছিলো উপজাতীয় মিলিশিয়ারা। ওরা ওদের ভাষা ছাড়া আর কারো ভাষা বুঝতো না। ক্যাম্প ইনচার্জ কারো সাথে যোগাযোগের কোনো সুত্রই রাখেননি।
জুনিয়র অফিসারগণ বন্দীত্ব ঘুচাতে সদা তৎপর। ওরা পালিয়ে যাবার চেষ্টা চালিয়ে গেলো। এতো নজরদারির ভেতরেও গোপনে সুড়ঙ্গ তৈরির পরিকল্পনা করলো। সুড়ঙ্গ খননের যন্ত্রপাতি যোগাড় করা, গোপনীয়তা বজায় রেখে খনন কাজ চালানো কঠিন ব্যাপার ছিল । খননের আওয়াজ লুকানোর জন্য হারমোনিয়াম বাজিয়ে উচ্চস্বরে গান করা হতো। খননের বাড়তি মাটি লুকানোর জন্য নিজের সুটকেস খালি করে মাটি ভরা হলো। তাদের চেষ্টা, বুদ্ধিমত্তা ও স্পৃহা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। এতো চেষ্টার পর ও তীরে এসে তরী ডুবলো। সুড়ঙ্গ তৈরি হলো কিন্তু তার শেষ প্রান্ত গিয়ে ঠেকলো কর্তব্যরত এক সেন্ট্রির পায়ের কাছে। উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। নেমে এলো সবার উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন। রূপকথার কাহিনীকেও এসব বাস্তব গল্প হার মানায়। কিন্তু কোথাও উল্লেখ না থাকায় বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম জানবে না এ কাহিনী।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
পড়ুন: বাংলাদেশে বিরোধী দলের বন্ধ্যাত্ব