কিছুক্ষণ আগে কাঠমান্ডু থেকে আমার একজন প্রিয় জুনিয়র একটা মজার টেক্সট পাঠিয়েছে। যার মর্মার্থ দাঁড়ায় রাশিয়া যখন জর্জিয়া বা ইউক্রেন দখল করে নেয় তখন তা হয় আগ্রাসন। যখন ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান অভিযান পরিচালিত হয় তখন তা হয় গণতন্ত্র ও মুক্তির জন্য যুদ্ধ। সবই যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত মিডিয়ার কারসাজি।
কিয়েভে রাশিয়ান সৈন্যরা প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ ইউক্রেন রাশিয়ান আগ্রাসন ঠেকাতে মিত্রদের সাহায্য পায়নি যার উপরে অনেক ভরসা ছিল।
ইউক্রেন আসলে কাকে চায়? রাশিয়া কিংবা আমেরিকা? ইউক্রেন ছিল সমাজতান্ত্রিক ঘরানার দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের রিপাবলিক গুলোর মাঝে ইউক্রেন ছিল ধনী ও শক্তিশালী যে রাশিয়ান বলয়ের বাইরে যায়নি। ন্যাটোতেও যোগ দেয়নি। ওরা মিলেমিশে ছিল। এতে রাশিয়ান সীমান্ত হয় নিরাপদ। এত বছর পর আমেরিকা ও মিত্ররা চাইছে ইউক্রেন রাশিয়া মুক্ত হোক। রাশিয়ান নিরাপদ সীমান্ত ভেঙে যাক। ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করলে আমেরিকার চির প্রতিদ্বন্দ্বীকে নুতন অবস্থান থেকে হেনস্তা করা সহজ হবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে রিপাবলিকগুলো স্বাধীন হয়ে যায় এবং কিছু কিছু দেশ ন্যাটোতে যোগ দেয়। তখন আমেরিকা ইউক্রেনকে ন্যাটোতে গ্রহণ না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপেক্ষিত হওয়াটা বর্তমান ক্রাইসিসের কারণ।
ধনতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থায় বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুখ স্বাচ্ছন্দের প্রাচুর্যের সংবাদ সমাজতান্ত্রিক শিবিরে মাঝে মাঝেই নাড়া দিতো। ফলে কমিউনিজমের বেড়াজাল ভেঙে কবে মুক্ত হতে পারবে তা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বাসীদের আকাঙ্ক্ষা। এক সময় সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। রিপাবলিক গুলো স্বাধীন হয়ে পড়ে। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলো প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ান বলয়ে থেকে যায়। কট্টর কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রধানগণ খোলাখুলিভাবে রাশিয়ার সাহায্যে ক্ষমতায় রয়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু হয়।
রিপাবলিকগুলো স্বাধীন হলেও একের ওপর অন্যের নির্ভরতা রয়ে যায়। সোভিয়েত প্রথায় কোন রিপাবলিক এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ একটা টেলিফোন সেটের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভিন্ন ভিন্ন দেশে তৈরি হয়। একক প্রয়োজনে কেউ কিছু উৎপাদন করতে পারে না। স্বাধীনতার পর এসব সমস্যা প্রকট হয়ে পড়ে।
রাশিয়ান ভাষা হয়ে পড়ে সার্বজনীন। এছাড়া ব্যক্তি যোগাযোগ হয়ে পড়ে কঠিন। জনসংখ্যাকে কোনো গোত্র, এলাকা ভিত্তিক পরিচয়ে যাতে না রাখা হয় সে জন্যে সারা ইউনিয়নে বিভিন্ন দল বা গোত্রকে জোরপূর্বক ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়াটা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়।
এবার আসি বিলুপ্ত সোভিয়েতের গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রাপ্তি কতটুকু।
পৃথিবী যখন দুই মেরুতে অবস্থান করছিল তখন আমেরিকা ও ধনবাদীরা কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নকে উচ্চ মূল্যায়ন করতো। তখন ডলার ও রুবল সমমানের ছিল। ক্ষেপণাস্ত্র, মহাকাশ গবেষণা ইত্যাদিতে উচচ মানের ছাপ রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা বার বার স্বাধীনতা ও মুক্তির পানে তাকিয়ে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর দেখা গেল এতদিন রাশিয়াকে উচ্চ মূল্যায়ন করা হয়েছিল।
ধনবাদীদের ব্যবসা বাণিজ্যের দরজা খুলে গেল। গ্রামে গঞ্জে, পাহাড় জঙ্গলে চুইং গাম, পেপসি, কোকাকোলা পৌঁছে গেল। বিখ্যাত রাশিয়ান ভদকার পরিবর্তে ডেনিশ, ফিনিশ, আইরিশ আরো অনেক ব্র্যান্ডের ভদকা বাজার দখল করে নিল। নব্য গণতন্ত্রে জনগণ দিশাহারা। চারিদিকে অস্ত্রের ঝনঝননি। মাফিয়া চক্রের সন্ত্রাস। অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দেশ সমাজ কোন নিয়মে চলবে সবাই দ্বিধান্বিত। গণতন্ত্র কোথায়? অনেকেই ফিরছেন নিজ রিপাবলিকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতই খারাপ যে তারা আদৌ পৌঁছাতে পারবে কি না অনিশ্চিত।
রাশিয়ান আর্মি বিভিন্ন দেশে মোতায়েন রয়েছে। সদস্যগণ ও ভিন্ন ভিন্ন জাতির।
কমিউনিস্ট দেশগুলো এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে অনুমতি লাগে। সবার পাসপোর্ট আছে। কিন্তু পাবলিকের বিড়ম্বনা। হারিয়ে যাওয়া বা গুম হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
একটা সিস্টেমের ভেতর দিয়ে আসা একটা জাতি হঠাৎ করে নুতন নিয়ম মেনে চলতে পারে না। তাই জনগণের মনে প্রশ্ন, গণতন্ত্র কোথায়? মুক্তি কোথায়? সমৃদ্ধি কোথায়? তাহলে পশ্চিমারা কি ধোঁকা দিয়েছে? কায়দা করে প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দেয়া হয়েছে?
সাবেক সোভিয়েত ব্লকের কিছু কিছু দেশ ন্যাটো তে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ড নয় বলে যথাযথ মূল্য দেয়া হয়নি। ইচ্ছা থাকলেও কূটনৈতিক কারণে সেসব দেশ এখন ন্যাটো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সাধারণ জনগণের ও গণতন্ত্রের মোহ মুক্তি ঘটেছে। সাবেক কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় ফিরে না গেলেও নুতন কোনো ব্যবস্থায় তারা রাশিয়ান নৈকট্যে স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা শক্তি প্রয়োগে যোগ দিতে পারে। এ কারণেই পুতিন বাহুতে শক্তি খুঁজে পাচ্ছেন। কৌশলগত কারণে চীন রাশিয়ানদের পক্ষ নেয়ায় ন্যাটো জোটের নুতন করে হোম ওয়ার্ক করতে হচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: সমস্যা কি শুধুই ইউক্রেনের?
পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে উচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ পুতিনের, বাড়ছে উত্তেজনা