প্রতিবেশীর সন্তানকে ধার নিয়ে সেই সন্তানকে নিজের দাবি করে শিক্ষা কর্মকর্তাকে দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি আদায়ের অভিযোগ উঠেছে এক প্রাথমিক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। আর ওই শিক্ষিকার নাম আলেয়া সালমা শাপলা।
আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের মনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
বিষয়টি জানাজানির পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ওই এলাকার লোকজন।
জানা যায়, প্রভাবশালী ওই শিক্ষিকা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা অফিসার, সহকারি শিক্ষা অফিসার ও হিসাবরক্ষক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এই অন্যায় কাজ করলেও উপজেলা শিক্ষা বিভাগ পুরো বিষয়টি চেপে গেছে।
এর আগেও টানা আড়াই বছর ধরে তিনি স্কুলে অনুপস্থিত থাকলেও উপজেলা শিক্ষা বিভাগ কোন অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে বিধিমতো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উল্টো তার অন্যায় কাজকে নানানভাবে সমর্থন দিয়ে বিষয়গুলো ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন।
বদলী সূত্রে তিনি ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্কুলটিতে যোগদান করেন। এরপর ২০১৯ সালে তিনি তৃতীয় বিয়ের পর বগুড়ায় চলে আসেন। পরে করোনার প্রকোপে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তিনি আর কুড়িগ্রামে ফিরে আসেননি।
চিকিৎসাসহ নানান অজুহাতে তিনি ছুটি নিয়ে বগুড়ায় অবস্থান করছিলেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৪ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ওই শিক্ষিকা মাতৃত্বকালীন ছুটি নিলে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়।
পরে বগুড়ায় ওই শিক্ষিকা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কাগইল ইউনিয়নের দেওনাই গ্রামের আনিছুর রহমান পাশা-শারমীন দম্পতির ছোট সন্তান আশফিয়াকে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে নিয়ে এসে নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেন।
পাশার স্ত্রী শারমীন নিজের সন্তানকে ধার দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে নিখোঁজের চারদিন পর কৃষকের লাশ উদ্ধার
তিনি জানান, তার দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। বড়টির নাম আফিফা (৫), ছোটটির নাম আশফিয়া। সে এ বছরের মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করে। সালমা শাপলা তার প্রতিবেশী। তার অনুরোধে গত মার্চ মাসে কন্যাসন্তানসহ তিনি নাগেশ্বরীতে গিয়েছিলেন।
পাশা বলেন, শাপলার স্বামী আমাকে একটা চাকরি দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এজন্য আমার ছোট মেয়েকে তারা ব্যবহার করেছে। আশফিয়া আমার নিজের সন্তান।
শিক্ষিকা শাপলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটশেরপুর ইউনিয়নের তাজুরপাড়া গ্রামের এএসএম ইবনে আজিজের মেয়ে তিনি। ভাইয়ের চাকরির সুবাদে তিনি কুড়িগ্রামে অবস্থান করছিলেন। এখান থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ২০১২ সালে নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। এরপর বদলী হন একই উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি একই ইউনিয়নের মনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
সালমা শাপলার স্বামী শফি আহমেদ স্বপন বলেন, আমি শাপলাকে কুড়িগ্রামে চাকরি করতে দিবো না। ওকে এখানে নিয়ে আসবো। ট্রান্সফারের সব কাজ রেডি। এখন ট্রান্সফার বন্ধ আছে। চালু হলেই নিয়ে আসবো। এগুলো নিয়ে নিউজ করে কিছুই হবে না। শুধু হয়রানি। আমরা সবাইকে ম্যানেজ করতে পারবো।
আর শাপলা বলেন, ‘আপনারা কেন প্রশ্ন করছেন আমি সবই বুঝি। কুড়িগ্রামে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এটিও, টিও সবাইকে ম্যানেজ করে আমি ছুটিতে আছি। শিক্ষা অফিসের বড়বাবু এসব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এসব নিউজ করেন না। নিউজ করে কিছু হবে না। আমি আবারও ১৪ দিনের ছুটির আবেদন করেছি। যতদিন ট্রান্সফার না হবে ততদিন ছুটি নিয়েই যাবো। আমরা একটা সিস্টেমের মধ্যে আছি। সরকার চাইলেও আমাকে চাকুরিচ্যুত করতে পারবে না। চিকিৎসকসহ যা যা কাগজ লাগে দিবো। আমাকে কে আটকায়। খামোকা এগুলো নিয়ে নিউজ টিউজ আর করিয়েন না।’
এদিকে ছুটির আবেদনে সুপারিশকৃত বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. সলিমুল্লাহ আকন্দ বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকায় সুপারিশপত্র দিয়েছিলাম।
মনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা শিক্ষক আলেয়া সালমা শাপলার সম্পর্কে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি নিয়ম মাফিক ছুটিতে আছেন।
নাগেশ্বরী উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারি ও হিসাবরক্ষক (বড়বাবু) আজিজার রহমান তার বিরুদ্ধে আনা সহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শাপলা তার প্রতিবেশী বোন হয়। এর বেশি কিছু নয়।
নাগেশ্বরী উপজেলা সহকারি শিক্ষা অফিসার আবু নোমান নওশাদ আলী বলেন, বিধি অনুযায়ী শিক্ষিকার মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয়েছে। আমরা যেহেতু ডিএনএ পরীক্ষা করি না, তাই কার বাচ্চা নিয়ে আসলো সেটা যাচাই করার কোন সুযোগ নেই।
নাগেশ্বরী উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মোবাশ্বের আলী বলেন, আমি বাচ্চাকে দেখেছি। প্রধান শিক্ষকের সুপারিশ ছিল। যদি এটি অসত্য হয়ে থাকে তাহলে জেলা শিক্ষা অফিসারকে বিষয়টি জানাবো। ঘটনা মিথ্যা হলে প্রধান শিক্ষকসহ ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার