স্বাস্থ্য
কেমন হওয়া উচিত সকালের শুরুটা?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কিছুই বর্তমানে বেশ সাড়া ফেলে, সম্প্রতি এক ইনফ্লুয়েন্সারের সকালের রুটিনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, কয়েক কোটি ভিউ পেয়েছে সেটি।
ভিডিওতে দেখা যায় আস্টন হল নামের ওই ইনফ্লুয়েন্সার ভোর চারটার আগে উঠে দাঁত ব্রাশ করছেন, এরপর তিনি সাঁতার কাটছেন, ধ্যান করছেন, জার্নাল পড়ছেন, কলার খোসা দিয়ে মুখ ঘষছেন, ওয়েট লিফটিং করছেন, বরফের মধ্যে মুখ ডোবেচ্ছন, এমন আরও অনেক কিছু করে শেষমেষ সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি নাস্তা করেন।
তার এই রুটিন দেখে নেট দুনিয়ায় আলোচনার ঝড় উঠেছে; কিভাবে দিনের শুরু করা উচিত। যদির আস্টনের মতো ছয়ঘণ্টা ধরে দিনের শুরু করাকে বেশিরভাগের মানুষই বিলাসিতা বলেছেন।
তবে ছয়ঘণ্টা ধরে দিনের শুরু না করলেও সুন্দরভাবে শুরু করাটা আবশ্যক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকেই জানেন না, কিভাবে দিনের শুরু করা উচিত। আসুন, তবে জেনে নেওয়া যাক বিশেষজ্ঞরা কি বলেন।
আরও পড়ুন: শিশুদের পেটের মেদ কমাতে কী করবেন?
কিভাবে একটি সুন্দর দিনের শুরু করা যায়?
ইংল্যান্ডের সাইকোথেরাপিস্ট (মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন যিনি) কামাল্যান কর বলেন, ‘দিনের শুরু ভালোভাবে করতে ডজনখানেক কাজ করার দরকার নেই। তবে সুস্থ, স্বাভাবিক ও গঠনমূলক একটি দিন অতিবাহিত করার জন্য সকালের কাজগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা যেতেই পারে। যে কাজগুলো ব্যক্তির মন উৎফুল্ল রাখতে সহায়তা করে, পাশাপাশি সারাদিনের জন্য শক্তি যোগায়— সেগুলো জানা প্রয়োজন।’
কামাল্যান বলেন, ‘আপনি যদি সকালটি ভালোভাবে শুরু করেন, আপনার সারাদিন ভালো কাটবে, আপনি বেশ গোছালোভাবে আপনার দিনটি অতিবাহিত করতে পারবেন।’
মানুষের কাজকর্ম ঠিক কিভাবে তার জীবনকে প্রভাবিত করে, সেটি নিয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছেন ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক শন ম্যাকক্লেইন।
প্রতিদিন সকালে রুটিনমাফিক একই ধরনের কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। শন বলেন, মানুষ যদি প্রতিদিন সকালে একই ধরনের কাজ করেন, তাহলে তার আলাদাকরে চিন্তা করতে হয় না। এতে অন্যসময়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য মস্তিস্কে শক্তি সঞ্চিত হয়। সকালে রুটিন মাফিক কাজ করা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক শর্টকার্ট।তিনি বলেন, মানুষের মস্তিস্ক সাধারণত অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা করতে পছন্দ করে না। চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে মানুষকে কৃপণ বলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: ধীরেসুস্থে খাবার না খেয়ে বিপদ টানছেন নাতো?
শনের গবেষণার তথ্যমতে, যেসব মানুষ কোনোরকম বিঘ্ন ছাড়া দিনের শুরুটা ভালোভাবে করেন, তারা কর্মক্ষেত্রে ভালো করেন, তারা শান্ত মেজাজে নিজেদের কাজগুলো করতে পারেন। অন্যদিকে যারা বিশৃঙ্খলভাবে দিনের শুরু করেন, তারা সারাদিন মানসিক ক্লান্তিতে ভোগেন।তিনি বলেন, সকালের রুটিনে কোনো বিঘ্ন ঘটলেই সারাদিন এলোমেলো হয়ে যায়।
একবার তার মেয়ের একটি প্রোগ্রামের কথা ভুলে অন্য কাজ করছিলেন বলেও জানান এই গবেষক।
সকালের রুটিনে কোন বিষয়গুলো থাকা ভালো?
শন বলেন, ‘প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু রুটিন থাকে। তবে খুব কম মানুষই সেটি ভেবেচিন্তে ঠিক করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করতে করতে সেটিই রুটিন হয়ে গেছে— বিষয়টি এমন।’
ঠিক কোন কাজগুলো সকালে করা ভালো এটি নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন বলে মনে করেন তিনি। কারণ একজনের জন্য যেটি কার্যকর সেটি আরেকজনের জন্য না-ও হতে পারে। তবে কিছু কাজ সবার ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর।
কামাল্যান কর বলেন, সকালে তাড়াহুড়ো করে গোসল করা, খাওয়া কিংবা বাসা থেকে বের হওয়া এগুলো খারাপ জিনিস। এর ফলে মানুষের শরীর থেকে অতিরিক্ত কর্টিসোল হরমোন নিঃসরণ হয়। এই হরমোনটি মানুষের সার্কাডিয়ান রিদমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সার্কাডিয়ান রিদম হলো দিনভর একটি মানুষের শরীর কিভাবে কাজ করবে, তা পরিচালনার জন্য একটি ঘড়ির মতো ব্যবস্থা। যেখানে মানুষের ঘুমিয়ে পড়া, জেগে ওঠা, শরীরের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে মানসিক অবস্থা, সব ধরনের ক্ষুধা সবই নিয়ন্ত্রিত হয়।
কামাল্যান বলেন, এই সার্কাডিয়ান রিদমের কারণেই মানুষ সকালে জেগে ওঠে। তবে অতিমাত্রায় কর্টিসোল নিঃসৃত হলে সেটি মানুষের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও অস্বস্তির সৃষ্টি করে।
খালি পেটে কফি খেলে শরীরের যে ক্ষতি হয়, এক্ষেত্রেও ঠিক সেরকম বলে জানান তিনি।
সকালে যেসব মানুষের এমন তাড়াহুড়ো হয়ে থাকে, তাদের এলার্ম ৩০ মিনিটি আগে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কামাল্যান। তবে এলার্ম দিয়ে আরেকটু ঘুমানোর জন্য ‘স্নুজ বাটন’ চাপতে নিষেধ করেছেন তিনি। এতে বরং মানুষ সারাদিন তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকেন বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: কতটুকু ঘুম দরকার সুস্থ মানুষের?
সকালে উঠে এমন অন্তত দুই বা তিনটি কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন কামাল্যান যেটি ব্যক্তির মন ভালো করতে সহায়ক হয়। উদাহরণস্বরুপ তিনি বিছানা গোছানোর কথা বলেছেন। কারণ অগোছালো পরিবেশ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে, আর সকালে প্রথম যে কাজটা করা হয় সেটি ভালো অনুভব করার জন্য ডোপামিন হরমোন নিঃসৃত করে।
এরপর এক গ্লাস পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। রাতভর ঘুমশেষে শরীর কিছুটা শুষ্ক (ডিহাইড্রেট) হয়ে যায়, তাই পানি প্রয়োজন। পাশাপাশি নাস্তা না করা পর্যন্ত কফি জাতীয় কিছু না খাওয়ার জন্য বলেছেন কামাল্যান।
এছাড়া ঘুম থেকে ওঠার পর প্রাকৃতিক আলোতে কিছুটা হাঁটার পরামর্শ দেন তিনি। এমনকি মেঘলা আবহাওয়া হলেও এই হাঁটা সার্কাডিয়ান রিদমের জন্য ফলপ্রসূ বলে জানান এই চিকিৎসক।
কামাল্যান বলেন, সারাদিন ভালোভাবে চলার জন্য, ‘ঠিকঠাকভাবে নিজের কাজ করার জন্য এই অভ্যাসগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
১২ দিন আগে
শিশুদের পেটের মেদ কমাতে কী করবেন?
পেটের মেদ বা ভুড়ি নিয়ে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন থাকেন না এমনটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরিণত বয়সের সচেতন সবাই এটি নিয়ন্ত্রণে বেশ চেষ্টা করেন—নিয়ন্ত্রণ করেন খাদ্যাভাস, করেন নানারকম ব্যায়াম বা শরীরচর্চা।
তবে এটি যে শুধু পরিণতদের জন্য জরুরি, তা কিন্তু নয়—শিশুদের জন্যও এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শিশুদের পেটের চর্বি কমাতেও সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের। শিশুদের খাদ্যাভাস কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কীভাবে শরীরচর্চা করে চর্বি কমানো যায়, আজ সে বিষয়ে গবেষকদের মতামত তুলে ধরব।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা বলছেন, শিশুদের পেটের অতিরিক্ত মেদ কমানোর সর্বোত্তম উপায় হলো একটি মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করা। শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চ বা ব্যায়াম হলো এই মিশ্র পদ্ধতি।
আরও পড়ুন: কতটুকু ঘুম দরকার সুস্থ মানুষের?
শনিবার (১২ এপ্রিল) প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যায়াম ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাসের সমন্বয় শিশুর স্থূলতা কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৮ হাজার ১০০টির বেশি শিশুর ওপর পরিচালিত ৩৪টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য বিশ্লেষণে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
চার্লস স্টার্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, পেট এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর চারপাশে জমা হওয়া চর্বি সাধারণ স্থূলতার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। কারণ এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী।
জেএএমএ নেটওয়ার্ক ওপেনে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, কোমরের আকার কমাতে শুধু খাদ্যাভ্যাস, শুধু ব্যায়াম, সম্পূরক বা ওষুধের মতো স্বতন্ত্র কৌশলগুলোতে উল্লেখযোগ্য ফলাফল দেখা যায়নি।
গবেষণায় উঠে এসেছে, সবচেয়ে সফল কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরীয়-ধাঁচের বা কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ এবং সপ্তাহে ১৫০ মিনিট পর্যন্ত শারীরিক ব্যায়াম বা কার্যক্রম পরিচালনা করা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী শৈশবকালীন স্থূলতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে আনুমানিক ৯ কোটি ৪০ লাখ মেয়ে এবং ৬ কোটি ৫০ লাখ ছেলেকে প্রভাবিত করেছিল। তাই এই সংখ্যানুপাতিক ফলাফল জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে।
গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন, উদ্ভুত এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার, স্কুল এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আর এমন উদ্যোগ নিলে এর ফলাফলগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে অপুষ্টি দূরীকরণ এবং অসংক্রামক রোগে মৃত্যু হ্রাস করার বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলোকে পূরণে সহায়তা করবে।
২২ দিন আগে
কতটুকু ঘুম দরকার সুস্থ মানুষের?
ধরুন ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১২টা বাজছে, আপনি হয়তো তখন এই খবরটি পড়ছেন। এর মানে আপনি গত রাতে ঘুমিয়েছিলেন, তাই এখন জেগে রয়েছেন। আচ্ছা জেগে তো রয়েছেন, আপনি কি নিজেকে সজীব-সতেজ অনুভব করছেন? প্রতিদিনের কাজে নিজেকে প্রাণবন্ত অনুভব করছেন?
একজন মানুষ ঘুম থেকে ওঠার পর তার ঠিকঠাক বিশ্রাম অনুভব হচ্ছে কিনা, তার শরীরের অবসাদ বা ক্লান্তি ঘুমানোর পর কেটেছে কিনা; এই প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য পরিমাণ মতো ঘুমানোর পাশাপাশি ঘুম পরিপূর্ণ হওয়াও জরুরি—বলেছেন ঘুম বিশেষজ্ঞরা।
বেশিরভাগ মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ঘুমের জন্য ব্যয় করেন। তবে প্রতিরাতে আট ঘণ্টার বেশি বা কম ঘুমালেই সেটি যথেষ্ট। আবার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ঘুমের পরিমাণেরও পরিবর্তন ঘটে।-খবর এপির
সাধারণত শিশু ও কিশোরদের তুলনামূলক বেশি ঘুমের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ৬৫ বা তার বেশি বয়সী মানুষ ৭ থেকে ৯ ঘন্টা বা এরচেয়ে কিছুটা কম ঘুমালেও চলে।
তবে সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের কতটুকু ঘুমানো দরকার, এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ রয়েছে কিনা; এই প্রশ্নও কিন্তু অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। তবে আসুন জেনে নেওয়া যাক, এ বিষয়ে ঘুম বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা বিজ্ঞানীরা কি বলেন।
আরও পড়ুন: রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতি: দেহ ও মনকে সুস্থ রাখতে করণীয়
বেশি ঘুমানোর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘুম ভালো হওয়া
ঘুম যেন আস্ত একটি রহস্যের জগৎ। কত শত রহস্য যে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই, এই নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষেণাও হয়েছে অনেক। কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলেছে, কিছু অজানা। তবে সে যাই হোক, ঠিকঠাক ঘুম হওয়া মানুষের শরীরের সুস্থতার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় একটি জিনিস।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুম বিশেষজ্ঞ ড. রাফায়েল পেলায়ো বলেন, ‘আমরা কেন ঘুমাই, এটার কোনো নির্দিষ্ট কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ঘুম আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন, তাই আমরা প্রতিদিন ঘুমাই।’
তিনি বলেন, ‘ঘুমের সময় অসাধারণ কিছু ঘটে। ঘুম হলো মানুষের নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার সবচেয়ে স্বাভাবিক একটি পন্থা।’
জন হপকিংস হাসপাতালের ঘুম বিষয়ক চিকিৎসক মলি অ্যাটউড বলেন, ‘একজন ব্যক্তি দৈনিক সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমালে তার স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে কম থাকে। আবার ছয় ঘণ্টার কম বা নয় ঘন্টার বেশি ঘুমালে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যদিও সব মানুষের শারীরিক অবস্থা একরকম নয়।
বিহেভিয়ারাল স্লিপ মেডিসিন নিয়ে কাজ করেন এই গবেষক। মানে ঘুমের সমস্যা, ঘুম-সংক্রান্ত বিভিন্ন লক্ষণ ও অনিদ্রার চিকিৎসা দিয়ে আসছেন তিনি।
তবে সাত কিংবা নয় ঘণ্টা ঘুমালেই হবে না, ঘুম ভালো হওয়াটা দরকারি বলে মত দিয়েছেন ড. রাফায়েল। তিনি বলেন, ‘আপনি কত ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন, তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো—ঘুম থেকে উঠে আপনি সতেজ বোধ করছেন কি না।’
আরও পড়ুন: ঠান্ডা না গরম পানি পান করবেন?
অনেকক্ষণ ঘুমানোর পরেও যদি কেউ শরীরে ক্লান্তি অনুভব করেন, তাহলে নিশ্চয়ই ওই ব্যক্তির ঘুমে কোনো সমস্যা থাকতে পারে বলে ড. রাফায়েলের ধারণা।
তিনি বলেন, ‘প্রিয় খাবারের দোকানে গিয়ে কারও ক্ষুধার্ত হয়ে বের হতে নেই।’ অর্থাৎ একজন মানুষ ঘুমালেন কিন্তু তার শরীরে ক্লান্তি থেকে যাওয়াটা একদমই উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন ড. রাফায়েল।
বয়সের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ঘুমের পরিমাণে পরিবর্তন
ঘুম প্রতিটি মানুষের জন্যই প্রয়োজন। তবে পরিমাণে তারতম্য রয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের প্রয়োজনীয়তায় পরিবর্তন হতে থাকে। যেমন, নবজাতক শিশুর সবচেয়ে বেশি ঘুম প্রয়োজন—প্রায় ১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা।
মলি বলেন, ‘শিশু ও কিশোরদের বেশি ঘুম দরকার। কারণ এ বয়সে তাদের খুব দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে থাকে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ২৬ থেকে ৬৪ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ৬৫ বা তার বেশি বয়সীদের কিছুটা কম (সাত ঘণ্টার কাছাকাছি), আর ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণদের সাত ঘণ্টার সামান্য বেশি ঘুম দরকার।
মানুষের ঘুম প্রায় প্রতি ৯০ মিনিটে একটি চক্রে আবর্তিত হয় বলে জানান মলি। তিনি বলেন, রাতের প্রথম ভাগে ঘুম চক্রে গভীর ঘুমের অংশ বেশি থাকে, এটি শরীরের সেরে ওঠা ও সতেজ করে তোলার জন্য অপরিহার্য। এই সময়েই শরীর থেকে ‘গ্রোথ হরমোন’ নিঃসৃত হয় বলে জানান তিনি। এই হরমোনটি মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি ও উচ্চতার জন্য প্রয়োজন। হাড়ের গঠন, পেশির বিকাশে এর অবদান রয়েছে।
রাতের শেষভাগের ঘুমে মানুষ সাধারণত স্বপ্ন দেখে থাকে। মানুষের স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন ঘুম বিশেষজ্ঞ মলি। তিনি বলেন, শিশুরা অর্ধেক সময়ই গভীর ঘুমে থাকেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পরিমাণ কমতে থাকে।
ঘুমে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য রয়েছে কিনা
গবেষণাতে এমন কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও গড়ে পুরুষদের তুলনায় নারীরা কিছুটা বেশি ঘুমান বলে মনে করেন মলি অ্যাটউড।
এই পার্থক্য ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়ে যায় উল্লেখ করে ড. রাফায়েল বলেন, ‘কিশোরদের তুলনায় কিশোরীরা সাধারণত কম ঘুমান। এমনকি কিছু কিছু কিশোরীকে অনিদ্রা নিয়ে অভিযোগ করতেও শোনা যায়।’
ইউসি বার্কলির ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ও ঘুম গবেষক অ্যালিসন হার্ভে বলেন, প্রথমবার মা হওয়ার পরে রাতে বাচ্চার দায়িত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মায়েদের ওপর পড়ে, এতে তাদের ঘুম কম হয়। এছাড়া গর্ভাবস্থা ও মেনোপজের সময় হরমোনের প্রভাবেও নারীদের ঘুমের পরিমাণ ও গুণগত মান পরিবর্তিত হতে পারে।
মায়ো ক্লিনিকের স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ডা. মিথরি জুনা বলেন, ‘মেনোপজের সময় বিশেষভাবে নারীদের ঘুমের মান কমে যায়। এসময় রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। এতে ঘুমের স্থায়িত্ব বেড়ে যায়।’
মলি বলেন, মাসিক চক্র শুরু হওয়ার ঠিক আগে নারীদের কিছুটা বেশি ঘুমের প্রয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে মানুষের শরীর জানান দেয়, যে তার আরও কিছুটা ঘুম প্রয়োজন। এটি সবার গ্রাহ্য করা উচিত।’
ঘুম আমাদের শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। ঠিকঠাক ঘুম না হলে মানুষের শরীরে ক্লান্তি অনুভব হয়, মেজাজে বিরক্তি আসে, অমনোযোগী হয়ে ওঠেন তারা। দীর্ঘমেয়াদে এই সমস্যাগুলো মারাত্বক হয়ে উঠতে পারে, এমনকি প্রাণঘাতিও হয়ে উঠতে পারে।
মলি জানান, যদি কোনো ব্যক্তির পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, অনিদ্রা বা স্লিপ এপনিয়া(ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা, যাতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে) সমস্যা থাকলে, ঠিকঠাকভাবে চিকিৎসা না করানো হলে, তা হতাশা বাড়িয়ে দিতে পারে।
শুধু তাই নয়, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মতো হৃদরোগজনিত সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ভিড়যুক্ত শপিংমল ও গণপরিবহনে করোনা সংক্রমণ: সাবধানতায় করণীয়
মলি বলেন, ‘ঘুমের ঘাটতি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়, এমনটি অ্যালজাইমারস রোগেরও শিকার হতে পারেন কেউ কেউ।’
অ্যালজাইমারস এক ধরনের স্নায়বিক রোগ, এতে মানুষ ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি হারাতে থাকেন। রোগটি অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রোগীর অবস্থার অবনতি হয়, এমনকি রোগীরে মৃত্যুও হতে পারে।
ঘুম নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হলে তা অবহেলা না করতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিনিয়ত ঘুমে সমস্যা হলে প্রাথমিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছেন মলি। এতেও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, ঘুম বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
৪০ দিন আগে
ভিড়যুক্ত শপিংমল ও গণপরিবহনে করোনা সংক্রমণ: সাবধানতায় করণীয়
জাতিসংঘের হিউম্যানিটারিয়ান ইনফরমেশন সার্ভিস রিলিফওয়েব অনুসারে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে পুরো ঢাকা জুড়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা ছিলো ৩২টি। এদের মধ্যে কারোরই মৃত্যু হয়নি। বরং পূর্বের ও জানুয়ারির এই রেকর্ড থেকে মোট আরোগ্য লাভের সংখ্যা দাড়িয়েছিলো ৭২-এ। মোটা দাগে সংক্রমণের এই অনুপাত নিম্নগামী, তবে এখনও তা একদম শূন্যের কোঠায় চলে যাইনি। সুতরাং করোনাকালীন সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলো এখনও বজায় রাখা জরুরি। বিশেষ করে শপিংমল ও গণপরিবহনের মতো ভিড়যুক্ত স্থানগুলোতে সাবধানতা অবলম্বন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলুন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ এবং তা প্রতিরোধে করণীয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
করোনা সংক্রমণের লক্ষণ
কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ২ থেকে ১৪ দিন পরে দৃশ্যমান হতে শুরু করে উপসর্গগুলো। প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো নিতান্তই হাল্কা ভাবে দেখা দেয়। অবশ্য কারও কারও ক্ষেত্রে শুরুতেই গুরুতর আকার ধারণ করে।
কোভিডের নতুন ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলোতে বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। মূলত টিকা দেওয়ার অবস্থার উপর নির্ভর করে এই পরিবর্তন হয়।
আরো পড়ুন: নিরাপদ ব্রয়লার মুরগি কী, কেন খাবেন
অধিকাংশ কেসগুলোতে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, সেগুলো হলো-
জ্বর বা ঠান্ডা লাগা, কফ, কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যাথা, সর্দি, স্বাদ বা গন্ধের অনুভূতি কমে আসা, প্রচন্ড ক্লান্তি, পেশী বা শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, এবং ডায়রিয়া।
ভিড়যুক্ত শপিংমলে ও গণপরিবহনে করোনা থেকে বাঁচতে করণীয়
.
মান সম্পন্ন মাস্ক পরিধান করা
করোনা ভাইরাস প্রবেশের জন্য মানবদেহের প্রধান অঙ্গগুলো হলো মুখ ও নাক। তাই মাস্ক পরিধানের মতো পুরনো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার কোনও বিকল্প নেই। শপিংমলে কেনাকাটার সময় বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, নানা ধরণের কাপড়-চোপড় ধরে দেখতে হয়। এমনকি এ যাবতীয় কার্যক্রম চলে অত্যন্ত ভিড়ের মধ্যে থেকে।
এছাড়া দেশের জনসাধারণের সবচেয়ে বড় অংশটিই যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনের উপর নির্ভর করেন। ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করায় এই যানবাহনগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত ভিড় একদমি নতুন নয়। শিশু থেকে শুরু করে নারী ও বৃদ্ধ সকলেই এই ভিড়ের মধ্যেই কাটিয়ে দিচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা।
আরো পড়ুন: তীব্র গরমে পানিশূন্যতা প্রতিরোধে উপকারী শাকসবজি
এই অপরিষ্কার জায়গাগুলোতে যে কোনও জীবাণু থেকে নিরাপদে থাকতে ভালো মানের মাস্ক পরা জরুরি। মুখ এবং নাক সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখে এমন সার্জিক্যাল মাস্ক ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর। একাধিকবার ব্যবহারযোগ্য মাস্ক ব্যবহার করলে তা নিয়মিত ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। একই সাথে মাস্ক পরে থাকার সময় এটি বারবার স্পর্শ না করা এবং প্রয়োজন ছাড়া মুখ থেকে সরানো উচিত নয়।
হাত নিয়মিত স্যানিটাইজ করা
করোনাকালীন সময়গুলোতে হাত ধোয়াটা রীতিমত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। এই অভ্যাসটিই আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে, গণপরিবহনে ওঠা-নামার পর, এবং শপিংমলে প্রবেশের পর হাত ধুয়ে নেওয়া উচিত। বাসায় সাবান-পানি ও ৬০ শতাংশ অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করা জরুরি। আর বাইরে সার্বক্ষণিক একটি পকেট স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখতে হবে। বড়দের পাশাপাশি বাচ্চা ও বয়স্কদের পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর রাখা জরুরি। ঘরে ঢোকার পর, স্কুলে ও অন্যত্রে চলতে ফিরতে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে।
অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে চলা
সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য ভিড় এড়ানো অত্যাবশ্যক। ঈদের মতো বিভিন্ন উপলক্ষগুলোতে নামকড়া দোকানগুলোতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একই দৃশ্য পরিলক্ষিত হয় কাজে যেতে বা কাজ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য যানবাহনে ওঠার সময়।
স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা ভেবে এই প্রবণতা থেকে সর্বদা দূরে থাকা উচিত। কেনাকাটার ক্ষেত্রে কখনোই অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়া যাবে না। যাতায়াতের জন্য একটু আগে ঘর থেকে বেরতে হবে।
আরো পড়ুন: নিরাপদে স্ট্রিট ফুড খাওয়ার ১০টি উপায়
বয়স্ক ও শিশুদের নিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে পারতপক্ষে বেশি ভিড়যুক্ত পরিবহন এড়িয়ে চলা উত্তম। অপেক্ষা করে তুলনামূলক ফাঁকা যানবাহনে উঠা যেতে পারে। বাসা ও কাজের জায়গা খুব বেশি দূরে না হলে পায়ে হেটে যাওয়া-আসা করা উপযুক্ত।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা
করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়েভের সময়ের মতো প্রতিটি ভবনেই সামাজিক দূরত্ব বজায়কে পুনঃবাস্তবায়ন করা দরকার। শপিংমলে কেনাকাটার বা গণপরিবহনের লাইনে সবক্ষেত্রে প্রত্যেকের মধ্যে কমপক্ষে ৩ ফুট (১ মিটার) দূরত্ব রাখা বাঞ্ছনীয়। এটি সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে গায়ে গা লেগে যায় এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে হবে।
বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুদের অবস্থানের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রাখা উচিত। বড় বড় শপিংমলগুলোতে লিফ্টের পরিবর্তে উপরে উঠার জন্য সিঁড়ি বেছে নিতে হবে।
গণপরিবহনে দরজার কাছে জটলা করা যাবে না। দুই সারি সিটের মাঝের চলাচলের জায়গাটিতে এক স্থানে ভিড় না করে নির্দিষ্ট দূরত্বে দাড়ানো উচিত।
আরো পড়ুন: বাসা-বাড়ির রান্নায় সিলিন্ডার গ্যাসের খরচ কমাবেন যেভাবে
ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা
রাস্তাঘাটে ও বিভিন্ন ভবনে চলাফেরার সময় সর্বাধিক ব্যবহৃত উন্মুক্ত পৃষ্ঠগুলো ভাইরাস ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত। যেমন- প্রবেশ দরজার হাতল, চলন্ত সিঁড়ির রেলিং, লিফ্টের বোতাম, গণপরিবহনে সিলিং-এর হাতল ইত্যাদি। এগুলো ব্যবহারের জন্য সাথে সার্বক্ষণিক টিস্যু রাখা যেতে পারে।
শিশুরা যেন এরকম কিছু না ধরে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বয়স্করা গ্লাভ্স বা টিস্যু ব্যবহার করতে পারেন। যে জায়গাগুলোতে ঘন ঘন এরকম পৃষ্ঠের সংস্পর্শে যেতে হয়, সেখানে উৎকৃষ্ট হচ্ছে পকেট স্যানিটাইজার। এছাড়া কোনও কোনও ক্ষেত্রে (যেমন দরজা) অনেকে কনুই বা কাঁধ ব্যবহার করে থাকেন।
লেনদেনে ডিজিটাল মাধ্যমগুলো ব্যবহার করা
নগদ টাকা লেনদেনে হাতের স্পর্শ থাকে বিধায় এখানে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। নগদবিহীন বা ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতিগুলো এক্ষেত্রে সেরা ও নিরাপদ বিকল্প। এখন ছোট থেকে বড় প্রায় সব ধরণের দোকানগুলো মোবাইল ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট বা কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে লেনদেনের ব্যবস্থা রাখে।
যাতায়াতের ক্ষেত্রে এ ধরণের লেনদেনের জন্য রাইড শেয়ার পরিষেবাগুলোই একমাত্র অবলম্বন। কেননা দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায় এখনও এই সুবিধা সংযুক্ত করা হয়নি।
আরো পড়ুন: পবিত্র রমজান ২০২৫-এ ইফতারের জন্য ঢাকার সেরা ১০টি রেস্টুরেন্ট
পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল আছে এমন জায়গা বেছে নেওয়া
অতিরিক্ত লোকসমাগমের জায়গাটি যদি বদ্ধ হয় তাহলে তা এমনিতেই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। এমন পরিবেশ শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। তাই গণপরিবহন বা শপিংমল যেখানেই থাকা হোক না কেন, যতটা সম্ভব উন্মুক্ত বায়ুপ্রবাহের দিকে সরে যাওয়া উচিত।
শপিংমলে লিফ্টে লোকসংখ্যা বেশি হয়ে গেলে বের হয়ে এসে সিঁড়ি ব্যবহার করা উত্তম। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে জানালার দিকের সিটে বসে জানালা খুলে দেওয়া যায়।
বয়স্ক ও শিশুদের জন্য পৃথক জায়গার ব্যবস্থা রাখার ক্ষেত্রে ঠিক এমন স্থানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বদ্ধ, গরম, ও বাতাসবিহীন স্থানে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যথাসম্ভব ঘরের বাইরে বের হওয়ার বিকল্প পন্থা অবলম্বন করা
করোনা পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করেছে অনলাইন যোগাযোগ এবং রিমোট জব। এতে অধিকাংশ প্রয়োজনীয় কাজগুলো ঘরে থেকেই করে ফেলা সম্ভব হয়। তাছাড়া কেনাকাটা ও বিনোদন সবকিছুই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সাথে। এই জীবনধারা যে কোনও সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুগান্তকারি এক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
আরো পড়ুন: রেস্তোরাঁ-শপিং মলে প্রবেশের আগে যে বিষয়গুলোতে সাবধান থাকা জরুরি
তাই প্রতিদিনের বিভিন্ন কাজের জন্য বাইরে না বেরিয়ে আগে ভাবা উচিত যে তা ঘরে থেকেই করা সম্ভব কিনা। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এর জন্য মোবাইল থেকে শুরু করে ভিডিও কলিং-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। এগুলো এখন আর আগের মতো দুষ্প্রাপ্য নয়।
এই প্রবণতা যে শুধু ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে দূরে রাখে তা নয়। সময় বাঁচিয়ে কাজের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্যও এটি যথেষ্ট উপযোগী।
পরিবহন ব্যবহারে অগ্রিম বুকিংকে অগ্রাধিকার দেওয়া
গণপরিবহনের জন্য দীর্ঘ লাইনে ভিড়ের মধ্যে দাড়িয়ে থাকা বিপুল সময় নষ্ট করে। একই সাথে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার জন্যও তৈরি করে সহায়ক পরিবেশ। চলন্ত বাসের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে লাফিয়ে পাদানি উঠে পড়া এখন হরহামেশাই দেখা যায়। কোনও রকম সামাজিক দূরত্বের কথা না ভেবে প্রতিদিনি এমন ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে চলেছেন হাজার হাজার যাত্রী।
কিন্তু সময় ও অর্থ সবকিছুর চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই যে কোনও মূল্যেই এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে অগ্রিম যানবাহন বুক করা দরকার। দূর পাল্লার যানবাহনগুলোতে অগ্রিম সিট বুকিং বিষয়টি স্বাভাবিক। কিন্তু শহরের ভেতরের যাতায়াতের ক্ষেত্রে এমন সুযোগ শুধু রাইড শেয়ারিং সেবাগুলোতেই রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধির দিক দিয়ে ভাবলে এই সেবাগুলো সব দিক থেকে নিরাপদ।
আরো পড়ুন: তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে: জানুন কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
ব্যক্তিগত ব্যবহারের উপকরণগুলো সর্বদা সঙ্গে রাখা
ফুটপাত, শপিংমল, ও যানবাহনে খাবার খাওয়ার জন্য শুধুমাত্র নিজস্ব জিনিসপত্রের উপর নির্ভর করা উচিত। দোকান বা হোটেলে যে গ্লাস, প্লেট, চামচ, ছুরি দেওয়া হয় তা এড়িয়ে চলাই ভালো। পানি পানের জন্য ব্যক্তিগত বোতল বা ফ্লাস্ক অনেকেই সঙ্গে রাখেন। এর পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবহার্য ছোট-খাট সামগ্রীও বাসা থেকে ভালভাবে ধুয়ে ব্যাগে ভরে নিতে হবে। সেই সাথে ঘরের বাইরে সর্বত্রে নিজের খাবার ও এই ব্যবহার্য জিনিসপত্র অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের জন্য এটি অতীব জরুরি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তারা যে কোনও সংক্রমণের সহজ শিকারে পরিণত হয়।
শেষাংশ
ভিড়যুক্ত শপিংমল ও গণপরিবহনে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে উপরোক্ত সাবধানতাগুলোর কোনও বিকল্প নেই। করোনাকালীন সময়গুলোর মতো মাস্ক পরিধান, হাত নিয়মিত স্যানিটাইজ, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের স্থানে থাকা, এবং যথাসম্ভব ঘরে থাকাটা এখনও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভিড় এড়িয়ে চলা, অযাচিত স্পর্শকাতর স্থানগুলো এড়িয়ে চলা, এবং ডিজিটাল লেনদেন হতে পারে সামাজিক দূরত্ব বজায়ের অনুকূল পদক্ষেপ। এগুলোর সাথে কার্যকরি সংযোজন হতে পারে অগ্রিম পরিবহন বুকিং এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র সর্বদা সাথে রাখা। সর্বসাকূল্যে, এই করণীয়গুলোর মাঝে নিহিত রয়েছে একটি সুরক্ষিত জীবনধারণে অভ্যস্ত হওয়ার রূপরেখা।
আরো পড়ুন: মরণঘাতী ড্রাগ ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ থেকে বাঁচতে করণীয়
৪১ দিন আগে
ঠান্ডা না গরম পানি পান করবেন?
পানি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পানি পান করার অনেক উপকারিতা রয়েছে। তবে পানির তাপমাত্রা আপনার শরীরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটি নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন যে গরম বা ঠান্ডা পানি কোনটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য পান করা বেশি উপকারী। এটি আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ, পরিস্থিতি এবং স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে।
গরম পানি পান করার উপকারিতা
ওয়ার্ল্ড জার্নাল অব ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ অনুযায়ী, ২০২০ সালের একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে গরম পানি কাশি (৭১ শতাংশ), শ্বাসকষ্ট (৭১ শতাংশ) এবং স্থূলতা (৫৭ শতাংশ) কমাতে সহায়ক। উষ্ণ পানি পানের কয়েকটি মূল উপকারিতা নিম্নরূপ:
হজমে সহায়তা করে
গরম পানি খাবার ভেঙে হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করতে পারে। এটি হজম এনজাইমগুলোকে সক্রিয় করে, যার ফলে খাবার ভালোভাবে পরিপাক হয়। খাবারের আগে গরম পানি পান করা হজমে সহায়ক হতে পারে।
তবে খুব বেশি গরম পানি পান করা উচিত নয়, কারণ এটি জিহ্বা, তালু এবং খাদ্যনালীর ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত গরম পানীয় গ্রহণ খাদ্যনালীর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
আরো পড়ুন: ভিমরুলের কামড় কতটা ভয়ংকর? সাবধানতা ও করণীয়
নাক ও বুকে জমে থাকা কফ দূর করে
যদি নাক বা বুকে কফ জমে থাকে—তাহলে গরম পানি তা শিথিল করতে সহায়তা করতে পারে। এটি গলা ব্যথা উপশম করতে পারে এবং শ্বাসনালী পরিষ্কার করতে সহায়ক।
রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে
গরম পানি রক্তনালী প্রসারিত করে, যা অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায় এবং শরীর থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। এটি হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সহায়ক।
৬৭ দিন আগে
মরণঘাতী ড্রাগ ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ থেকে বাঁচতে করণীয়
রাস্তাঘাটে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গুরুতর দিক হচ্ছে রাসায়নিক বস্তুর অপব্যবহার। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে মারাত্মক ড্রাগ হলো ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস। এর ভয়াবহ প্রভাবে ভুক্তভোগীরা কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই দুর্বৃত্তদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান এই বিপদ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে জনসচেতনতা। চলুন, ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস আসলে কি ধরনের ড্রাগ ও কিভাবে এর থেকে নিরাপদ থাকা যায়- তা বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস কী
নাইটশেড গোত্রভুক্ত উদ্ভিদ (যেমন রাজঘণ্টা, ধুতুরা)-এর পাতা থেকে ট্রোপেন অ্যালকালয়েড নামক এক ধরনের শক্তিশালী জৈব যৌগ পাওয়া যায়। কথিত আছে প্রাকৃতিকভাবে উৎসরিত এই নির্যাসটি মানুষকে জোম্বি বা জিন্দালাশে পরিণত করে। আর তাই উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্কোপোলামিন নামে অভিহিত এই রাসায়নিক বস্তুটি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ নামে।
তবে এমন অদ্ভূত নামের জন্য দায়ী এর অ্যান্টিকোলিনার্জিক বৈশিষ্ট্য। এর ফলে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর পারস্পরিক বার্তা আদান-প্রদানের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তাই এটি অতি অল্প মাত্রায় মোশন সিকনেস এবং অত্যধিক বমির চিকিৎসায় ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে পরিমিত মাত্রায় আরোগ্য দানকারী এই ঔষধই অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিষ হয়ে ওঠে। এর নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্ক বিভ্রম, হ্যালুসিনেশন এবং ঝাপসা দৃষ্টি। এমনকি এর মাত্রাতিরিক্ত সেবনে চরম পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট, হার্ট-অ্যাটাক ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আরো পড়ুন: অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়
স্কোপোলামিনের ব্যাপক অসদ্ব্যবহার দেখা যায় নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। খাবার, পানীয় বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এটি শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির হ্যালুসিনেশন শুরু হয়। এ সময় মস্তিষ্ক বিভ্রমের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগীর স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির বিলুপ্তি ঘটে। যখন বিভ্রান্তি কেটে যায় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তি কিছুই মনে করতে পারেন না। গন্ধ ও স্বাদ কোনোটাই না থাকায় এই রাসায়নিক পদার্থটি তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করারও উপায় থাকে না।
আর এই সামগ্রিক কারণে চোর ও ছিনতাইকারীদের ভয়ানক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে স্কোপোলামিন। দুষ্কৃতিকারী খাবারে মিশিয়ে অথবা মুখের উপর এর গুঁড়ো ফুঁ দিয়ে জনসাধারণকে আক্রান্ত করে। এছাড়া অনেকে অপরিচিতদের সাহায্য আবেদনে তাদের বাড়িয়ে ধরা কাগজ চোখের কাছে নিয়ে পড়তে যেয়েও ধরাশায়ী হন। এরপর তাকে যা করতে বলা হয় সে কোনো ধরনের দ্বিধা না করে তা অনুসরণ করে। ফলশ্রুতিতে ঘটনাটি আশেপাশের লোকেদের মনেও কোনো সন্দেহের উদ্রেক করে না। এভাবে কোনোরকম বল প্রয়োগ ছাড়াই অসহায় ব্যক্তিটির সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয়।
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস থেকে বাঁচার ১০টি উপায়
.
অপরিচিতদের দেওয়া খাবার বা পানীয় গ্রহণ না করা
বিভিন্ন গণপরিবহন, যাত্রী ছাউনী, পার্ক, রেস্তোরা ও আবাসিক হোটেল এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এগুলোতে পরিবেশিত কোনো একটি খাবারে মেশানো থাকতে পারে ভয়াবহ স্কোপোলামিন। এসব জায়গা বাদেও যেকোনো অযাচিত খাবারের সুযোগ ভদ্রতার সঙ্গে ফিরিয়ে দেওয়া শ্রেয়। এমনকি অস্বাস্থ্যকর ফেরীওয়ালাদের খাবারও এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা সেই বিক্রেতা যেকোনো দুষ্কৃতি চক্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আরো পড়ুন: এসির বাতাসে শিশুকে নিরাপদ রাখবেন যেভাবে
খাবার বা পানীয় উন্মুক্ত না রাখা
কোথাও খেতে বসে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য কোথাও যাওয়ার সময় খাবার উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা উচিত নয়। আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে থাকা কোনো দুর্বৃত্তের জন্য এটি হতে পারে সুবর্ণ সুযোগ। ফিরে এসে হয়ত খাবার সেই আগের স্থানেই পাওয়া যাবে, কিন্তু তা আগের মতো বিশুদ্ধ নাও থাকতে পারে। তাই একা হলে নিজের কেনা বা সঙ্গে করে বহন করা খাবারটি সর্বদা সঙ্গেই রাখতে হবে। সঙ্গী থাকলে তখন কোথাও যেতে হলে খাবার তার দায়িত্বে রেখে যাওয়া যেতে পারে। অবশ্য পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে ভাবলেও তা ঢেকে রেখে যাওয়াটাই উত্তম।
অপরিচিতদের বাড়িয়ে ধরা কাগজ গ্রহণের ব্যাপারে সাবধান
অনেক প্রতারক চক্র আইডি কার্ড, প্রেসক্রিপশন, এমনকি সাদা কাগজে লেখা ঠিকানা জানতে চেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে। তখন সাহায্য করতে উদ্যত হওয়া ব্যক্তিটি কাগজটি চোখের কাছাকাছি নিতেই ঘটে বিপত্তি। নিঃশ্বাসের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে যায় বিপজ্জনক মাত্রার ডেভিলস ব্রেথ। তাই নিজের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ ধরনের অনুরোধগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। নতুনবা একবার এই বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে আশপাশ থেকেও কোনো সাহায্য প্রাপ্তির অবকাশ থাকবে না।
ফুল বিক্রেতাদের ফুলের সুবাস নেওয়া থেকে বিরত থাকা
নিজস্ব কোনো গন্ধ না থাকায় ডেভিলস ব্রেথ অন্যান্য ফুলের সঙ্গে মিশিয়েও শিকারের উপর প্রয়োগ করা যায়। যানজট অথবা পার্কের মতো জায়গাগুলোতে প্রায়ই ফুল বিক্রেতাদের আনাগোণা দেখা যায়। এদের থেকে ফুল কেনার সঙ্গে সঙ্গে তার সুবাস নেওয়া ঠিক নয়। বরং এ ধরনের স্থানগুলোতে এদের এড়িয়ে চলাই উত্তম। বিষয়টি ফুটপাত বা ভ্রাম্যমাণ আতর বা পারফিউম বিক্রেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আরো পড়ুন: ভিমরুলের কামড় কতটা ভয়ংকর? সাবধানতা ও করণীয়
পথে-ঘাটে চলতে ফিরতে সর্বদা মাস্ক পরিধান করা
করোনা মহামারির সময়ের মতো সার্বক্ষণিক মাস্ক পড়ে চলা কার্যকরী একটি সুরক্ষা পদ্ধতি। পোর্টেবল এয়ার পিউরিফায়ার মাস্ক বায়ুবাহিত যেকোনো টক্সিনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মাস্কগুলোতে থাকা ফিল্টার বাতাসকে পরিশোধিত করে সুস্থ শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা করে।
সবসময় সঙ্গে পকেট স্যানিটাইজার রাখা
একই সঙ্গে একটি পকেট স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখাটাও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপত্তির মোকাবেলা করতে পারে। কোভিড-১৯ চলাকালীন সবার মধ্যেই ঘন ঘন হাত স্যানিটাইজের অভ্যাসটি চালু হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে স্কোপোলামিন সংক্রান্ত দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এই অভ্যাসটির পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন।
কোনো কিছু স্পর্শ করার পর হাত স্যানিটাইজ না করে অন্যান্য কাজ করা যাবে না। যাদের মধ্যে ঘন ঘন নাকে-মুখে হাত দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের জন্য এই সতর্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি অতি গরমের সময় অতিরিক্ত ঘাম মুছার জন্যও মুখমন্ডলে স্পর্শ করার দরকার পড়ে। এ পরিস্থিতিতে একটি পকেট স্যানিটাইজার হতে পারে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কবজ।
আরো পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
টাকা লেনদেনের পর হাত স্যানিটাইজ করা
দৈনন্দিন কাজে ঘন ঘন হাত বদল হওয়ার জন্য টাকা-পয়সা হতে পারে স্কোপোলামিন পরিবহনের সহজ মাধ্যম। তাই লেনদেনের পর সর্বদা হাত ভালভাবে স্যানিটাইজ করে নিতে হবে। বিশেষত জনাকীর্ণ এলাকায় এই সচেতনতা অবলম্বন জরুরি। যাদের মধ্যে জিহ্বে আঙ্গুল দিয়ে টাকা গোণা বা বইয়ের পাতা উল্টানোর প্রবণতা রয়েছে তাদের ডেভিলস ব্রেথে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সর্বাধিক। তাই যেকোনো মূল্যে ঘন ঘন মুখমন্ডল স্পর্শ করার অভ্যাস পরিত্যাগ করা অত্যাবশ্যক।
ব্যক্তিগত জিনিসপত্র অপরিচিতদের নাগালের বাইরে রাখা
কেবল অপরিচিতদের দেওয়া জিনিস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলেই হবে না। সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে নিজের জিনিসপত্রও যেন তাদের নাগালের বাইরে থাকে। নিজের কেনা খাবারের সাথে সাথে ব্যাগ, মানিব্যাগ, ও মোবাইল ফোনসহ প্রতিটি জিনিস সযত্নে রাখতে হবে। কোনোভাবেই নিজের নাগালের বাইরে রাখা যাবে না। অন্যথায় এ জাতীয় ছোট ছোট জিনিসপত্রে ক্ষতিকর পদার্থ মেশানোর জন্য কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট।
বিভিন্ন জায়গা সরবরাহকৃত স্প্রে জাতীয় পণ্য ব্যবহারে সাবধানতা
বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের আবাসিক হোটেলগুলোতে মশা নিরোধক বা এয়ার ফ্রেশনারে সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে মানহীন হোটেলগুলোতে থাকার ক্ষেত্রে এ জাতীয় স্প্রেগুলো ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। ট্যাক্সিতে ওঠার পর গাড়ির দুর্গন্ধ দূর করার জন্য ড্রাইভার এয়ার ফ্রেশনার বের করতে পারে। এর বদলে গাড়ির জানালা খুলে বাতাস চলাচলের পথ তৈরি করে দিতে হবে। এই অতিরিক্ত সাবধানতা ক্ষতিকর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে।
আরো পড়ুন: রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতি: দেহ ও মনকে সুস্থ রাখতে করণীয়
অ্যাপ-ভিত্তিক পরিবহন সেবাতে অগ্রাধিকার দেওয়া
যাতায়াতে অ্যাপভিত্তিক রাইডগুলোতে আগে থেকেই ড্রাইভারের নাম, ছবি এবং গাড়ির বিশদ বৃত্তান্ত দেখে নেওয়া যায়। পরবর্তীতে সঠিক গাড়িটি যাচাইয়ের জন্য প্লেট নাম্বার মিলিয়ে নেওয়ারও সুযোগ থাকে। এছাড়া অত্যধিক গণপরিবহনের অত্যধিক ভিড়ে ক্ষতিকর স্পর্শের সম্ভাবনা এখানে নেই।
তবে অ্যাপে ড্রাইভার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ইতিবাচক হওয়ার পরও দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। সেজন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। এ জন্য গাড়িতে ওঠার আগেই পরিচিতিদের সাথে রিয়েল-টাইম লোকেশন শেয়ার করে রাখতে হবে। একা হলে ড্রাইভারের পাশের সিটে না বসে পেছনের সিটে বসতে হবে।
পরিশিষ্ট
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস মূলত স্কোপোলামাইন নামক একটি রাসায়নিক বস্তু। এটি প্রয়োগের মাধ্যমে মস্তিষ্ক বিভ্রম ঘটিয়ে ভুক্তভোগীর সর্বস্ব লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ ধরণের অপরাধমূলক ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য নিজের চারপাশের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এর জন্য রাস্তাঘাটে চলাচলে অপরিচিতদের দেওয়া খাদ্য, পানীয়, কাগজ গ্রহণ না করা এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সযত্নে নিজ দায়িত্বে রাখা অপরিহার্য। যাতায়াতের পুরোটা সময় মাস্ক পরিধান, সঙ্গে পকেট স্যানিটাইজার রাখা জরুরি। উপরন্তু, রাইড-শেয়ার অ্যাপ ব্যবহার ও আবাসিক হোটেলে স্প্রে ব্যবহার এড়িয়ে চলা এই সমস্যা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
আরো পড়ুন: তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে: জানুন কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
৭১ দিন আগে
তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে: জানুন কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
স্ট্রোক এমন এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য জটিলতা যেখানে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কেবল বার্ধক্য পীড়িতদের মধ্যেই নয়, তরুণদের মধ্যেও রয়েছে স্ট্রোকের ঝুঁকি। আর এই প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এই স্বাস্থ্য সংকট নিয়েই আজকের স্বাস্থ্য-বিষয়ক নিবন্ধ। কোন কোন বিষয়গুলো এর জন্য দায়ী, কিভাবে তা শনাক্ত করবেন, এ থেকে বাঁচার উপায়ই বা কি- চলুন তা বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
তরুণদের মাঝে স্ট্রোকের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ
তৈলাক্ত বা ভাজা খাবারের প্রতি আসক্তি
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুগুণে বেড়েছে ভাজা-পোড়া খাবারের বিচিত্রতা। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁ পর্যন্ত সর্বত্র রীতিমত উৎসবমুখর আয়োজনে চলে নিত্য-নতুন পরিবেশনা। আর সেগুলোতেই হামলে পড়েন তরুণরা। এদের মধ্যে যাদের একটু বেশি ভোজনপ্রীতি রয়েছে, তারা কোনোরকম বাছ-বিচারের তোয়াক্কা করেন না। ফলে দেখা দিচ্ছে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরল- যার প্রতিটিই স্ট্রোকের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
এই মুখরোচক খাবারগুলোতে থাকে ট্রান্স ফ্যাট, পরিশোধিত শর্করা এবং অত্যধিক সোডিয়াম। এই উপাদানগুলো ধমনীতে প্লাক তৈরি করে রক্তের প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটায়। কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত এই ভোজ অভ্যাসে পরিণত হলে তা প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের কারণ হয়। এর ফলে রক্তনালীগুলো সঙ্কুচিত হয় ও চরম পর্যায়ে পুরো নালীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়; পরিণতিতে স্ট্রোক হয়।
আরো পড়ুন: রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতি: দেহ ও মনকে সুস্থ রাখতে করণীয়
শরীরের দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা
প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে কায়িক শ্রমের কাজ। এর বদলে জায়গা করে নিয়েছে মানসিক শ্রমযুক্ত কাজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত হচ্ছে কম্পিউটারের সামনে বসে। এখানে দীর্ঘ সময় যাবত শরীরের পেশীগুলোর ন্যূনতম নড়াচড়া হয় না।
একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা বিশাল তরুণ সমাজকে ঠেলে দিয়েছে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের দিকে। ফলে সবচেয়ে কর্মক্ষম শ্রেণিটির দিনের একটা বড় সময় কেটে যাচ্ছে বসে বা শুয়ে থাকা।
এই অচলাবস্থা হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে তোলে। শারীরিক ক্রিয়াকলাপের অভাব রক্ত সঞ্চালনের দক্ষতা হ্রাস করে, যার ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ হয় না। আর এরই কারণে শরীরের ওজন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের উপক্রম হয়। এগুলো সবই স্ট্রোকের দিকে পরিচালিত করে। নিষ্ক্রিয় পেশীগুলো রক্তে শর্করা এবং কোলেস্টেরলকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে রক্তের ধমনীতে ক্লট তৈরি হয়ে স্ট্রোকের ঘটনা ঘটে।
আরো পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
ধূমপান এবং উদ্দীপক পানীয় গ্রহণ
তামাক ব্যবহারে ধমনীকে শক্ত করে দেয়, যার ফলে বাড়ে রক্তের চাপ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় রক্তনালী। নিকোটিন এবং কার্বন মনোক্সাইড মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমায়, যা ক্লট গঠনের অন্যতম প্রধান কারণ। উপরন্তু, উচ্চ ক্যাফেইন বা উদ্দীপক পানীয় হৃৎপিণ্ডের নিয়মিত ছন্দে ব্যাঘাত ঘটায় এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এই পদার্থগুলোর অত্যধিক সেবন স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে। এতে দীর্ঘমেয়াদে রক্তনালী ধ্বংস হয়, যা স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ।
দুশ্চিন্তা ও মানসিক অসুস্থতা
বিগত দশকে শারীরিক সমস্যাগুলোর পাশাপাশি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মানসিক জটিলতাগুলো। অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, হতাশা ও নিরাশার নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হওয়া জনগোষ্ঠির একটা বিশাল অংশ তরুণ সম্প্রদায়।
দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ কর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে রক্তচাপ ও প্রদাহ বৃদ্ধিতে অংশ নেয়, যেগুলো স্ট্রোকের দিকে নিয়ে যায়। উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং ক্ষতিকারক পদার্থ সেবনের সঙ্গে জড়িত। উপরন্তু, রক্ত সঞ্চালনে চাপের তারতম্য ক্ষণস্থায়ী স্ট্রোকের সূত্রপাত ঘটায় যেটি ইস্কেমিক অ্যাটাক নামে পরিচিত। এর আরেক নাম মিনি-স্ট্রোক, যা সাধারণত বড় কোনও স্ট্রোকের আগে হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন: অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়
স্ট্রোকের যে লক্ষণগুলো তরুণদের মধ্যে দেখা যায়
আকস্মিক দুর্বলতা
স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় লক্ষণগুলোর একটি হচ্ছে হঠাৎ দুর্বলতা বা অসাড়তা। এটি সাধারণত শরীরের যে কোনও একপাশ অসাড় হওয়া থেকে শুরু হয়। শরীরের আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের নেপথ্যে থাকে মূলত মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল। সেখানে রক্ত প্রবাহ না গেলেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় পর্যুদস্ত ব্যক্তিরা তাদের এক হাত বা পা তুলতে বেশ ভারী অনুভব করে। কারও ক্ষেত্রে তাদের মুখের একপাশ ঝুলে যায়। কোনও ক্ষেত্রে এই দুর্বলতা কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে, আবার কারও ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়।
কথা বলার সময় শব্দ উচ্চারণে প্রতিবন্ধকতা
মস্তিষ্কের একটি অংশ রয়েছে যেটি কথা বলার সময় মুখের স্বাভাবিক পেশী সঞ্চালন অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে। স্ট্রোকের ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের এই অঞ্চলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কথা বলার সময় সুসংগত বাক্য গঠনে অসুবিধা হয়। কিছু ব্যক্তি অ্যাফেসিয়া অনুভব করতে পারে। এটি এমন এক অবস্থা যেখানে সঠিক শব্দটি স্মরণে আসে না বা কথাগুলো অসংলগ্ন হয়। কেউ কেউ ডিসার্থ্রিয়ায় ভুগেন। এর ফলে মুখ এবং জিহ্বার পেশী দুর্বল হয়ে যায় বিধায় উচ্চারণ সমস্যা দেখা দেয় এবং শব্দগুলো অস্পষ্ট শোনায়। এই উপসর্গগুলো হঠাৎ ঘটতে পারে এবং পরবর্তীতে এর তীব্রতা ওঠানামা করতে পারে।
আরো পড়ুন: রক্তের গ্রুপ: কে কাকে রক্ত দিতে পারবে?
দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত
মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল প্রসেসিং এলাকাটি মানুষের দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে রক্ত প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে দৃষ্টিশক্তিতে অসঙ্গতি দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা এক বা উভয় চোখে অস্পষ্ট দেখে, কেউ কেউ সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে। সাধারণ লক্ষণের মধ্যে আরও রয়েছে ডিপ্লোপিয়া বা ডাবল ভিশন, যার ফলে ব্যক্তি যে কোনও জিনিস দুটো দেখতে পায়। এক চোখে অস্থায়ী অন্ধত্ব অ্যামাউরোসিস ফুগাক্স নামে পরিচিত। এটি আসন্ন স্ট্রোকের জন্য একটি সতর্ক সংকেত।
গুরুতর মাথাব্যথা
তীব্র মাথাব্যথা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পূর্বাভাস হতে পারে যার কারণে হেমোরেজিক স্ট্রোকের উপক্রম হয়ে থাকে। সাধারণ মাথাব্যথার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এটি আকস্মিকভাবে বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বমি বমি ভাব, বমি; এমনকি ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। ব্যক্তি শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবেন না। কোনো কিছু না ধরে হাঁটা বা দাড়িয়ে থাকা তার জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠবে।
সাধারণ বোধের অবনতি এবং স্মৃতিভ্রম
মূল সমস্যাটা যখন মস্তিষ্ক কেন্দ্রিক, তখন বোধগম্যতা ও স্মৃতিশক্তির বিলোপ ঘটাটা স্বাভাবিক। এর শুরুটা হয় আকস্মিকভাবে কোনো কিছু ভুলে যাওয়া থেকে। ব্যক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছুর প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন না। কি কি বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে সামঞ্জস্যতা বিধান করা এদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। কেউ কেউ পরিচিত লোকেদের পরিপূর্ণভাবে চেনার জন্য বেশ সময় নিয়ে ফেলেন। এদের অনেকেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝে প্রাসঙ্গিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা হতবাক বা নির্লিপ্ত হয়ে যান।
আরো পড়ুন: মুখের দুর্গন্ধ দূর করার ঘরোয়া উপায়
কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন
তরুণদের মধ্যে যারা নিয়মিত ধূমপান ও উদ্দীপক পানীয় গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে রয়েছেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি সর্বাধিক। এছাড়াও অতিরিক্ত স্থূলতা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস এবং দীর্ঘ সময় বসে থাকা সামগ্রিকভাবে স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ায়।
উপরন্তু, পরিবারে পূর্বে কারও উচ্চ রক্তচাপ বা রক্ত জমাট বাঁধার ব্যাধি থাকলে তারাও এই ঝুঁকির আওতায় পড়েন।
তরুণদের স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়
সুষম খাদ্যাভ্যাস গঠন
নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে একটি পুষ্টিকর খাদ্য তালিকা তৈরি করা উচিত। বিভিন্ন ধরনের বীজ জাতীয় খাবার, ফলমূল, শাকসবজি এবং চর্বিহীন প্রোটিন কোলেস্টেরল গঠন প্রতিরোধ করে ধমনী সুদৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। মাছ এবং বাদামে পাওয়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রে ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে। অপরদিকে, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। সম্মিলিতভাবে এই খাবারগুলো স্ট্রোকের বিরুদ্ধে শরীরকে রীতিমত দূর্গ বানিয়ে তুলতে পারে।
আরো পড়ুন: থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
নিয়মিত শরীর চর্চা
সুষম খাবার গ্রহণ এবং উপযুক্ত শরীর চর্চা উভয়েরই যুগপৎভাবে চলতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে রক্তচাপ হ্রাস করে এবং স্থূলতা প্রতিরোধ করে। দ্রুত হাঁটা, জগিং এবং সাইকেল চালানোর মতো অ্যারোবিক ব্যায়াম হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। একই সঙ্গে ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়, যা ধমনীকে শক্ত হয়ে যাওয়া থেকে দূরে রাখে। শরীর চর্চা বিপাকীয় স্বাস্থ্যকে সমুন্নত রেখে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও শারীরিক অনুশীলন প্রদাহ কমায়, যা রক্তে ক্লট তৈরির প্রধান প্রভাবক।
ক্ষতিকর অভ্যাস এড়িয়ে চলা
স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য তামাক, অ্যালকোহল ও অন্যান্য মাদক থেকে দূরে থাকা অত্যাবশ্যক। এমনকি সাধারণ ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত সেবনও রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
দীর্ঘদিনের অভ্যাস বদলানোর জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতার সরণাপন্ন হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার ও আশেপাশে থাকা আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিরও পরম সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা থাকা জরুরি। তাৎক্ষণিক ভাবে পরিত্যাগের সুযোগ না থাকলেও প্রতিদিন একটু একটু করে চেষ্টা করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্যান্য ইতিবাচক কায়িক শ্রমযুক্ত কাজের মধ্য দিয়ে মনকে সার্বক্ষণিক ব্যতিব্যস্ত করে রাখতে হবে। একই সঙ্গে অবসরগুলো প্রিয় জনদের আন্তরিক আড্ডায় ভরিয়ে তুলতে হবে।
আরো পড়ুন: সার্কেডিয়ান রিদম বা দেহ ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস গড়ে তোলা
স্ট্রোকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য স্বাস্থ্যকর ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। রাত জেগে কাজ করে দিনে ঘুমানো মোটেই উৎপাদনশীলতার সহায়ক নয়। বরং তা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য বিনষ্টের পটভূমি তৈরি করে। রাতে ঘুমানোর ক্ষেত্রেও দেরি করা অনুচিত। কারণ এর ধারাবাহিকতায় এক সময় পুরো রাত অনিদ্রায় কেটে যায়। এর জন্য বিশেষ করে ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতে স্ক্রিন টাইম কমিয়ে আনা আবশ্যক। কেননা স্মার্টফোনে অতিবাহিত সময়ের বিস্তৃতি গভীর রাত ছাড়িয়ে যায়। এই কারণে স্মার্টফোন ব্যবহারকারিদের সিংহভাগ তরুণ সমাজকে প্রায় অনিদ্রায় ভুগতে দেখা যায়।
এই সমস্যার নিরসণকল্পে যত দ্রুত সম্ভব ঘুমিয়ে পড়ে ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই উঠে যাওয়া উত্তম। এটি মুক্ত বাতাসে শারীরিক অনুশীলনের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। ঘুমাতে যাওয়া এবং জেগে ওঠার সময়টিও প্রতিটি একই ভাবে অনুসরণ করতে হবে। ঘুমের ভিন্ন রুটিন মন-মেজাজের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যা পরিণতিতে স্বাস্থ্যহানির অবতারণা ঘটায়।
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানো
হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ফাংশনের জন্য খাওয়া, ঘুম, ও ব্যায়ামের পাশাপাশি মানসিক চাপমুক্তিও দরকারি। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বদমেজাজ সম্পন্ন ব্যক্তিদের রক্তচাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা বেশি থাকে। এর বিপরীতে ধ্যান, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং নিয়মিত শরীর চর্চা মানসিক ভারসাম্যের ক্ষেত্র তৈরি করে।
আরো পড়ুন: অটিজম কী? অটিজম সচেতনতা ও সহমর্মিতা কেন জরুরি?
এর সঙ্গে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে যুক্ত হতে পারে যে কোনও কাজ-কর্মে ইতিবাচকতা এবং স্বল্পতুষ্টি। এই দৃষ্টিভঙ্গি উদ্বেগ, বিষণ্নতা বা মানসিক আঘাতকে লাঘব করার শক্তি দেয়। নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়া কিভাবে করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় একজন ব্যক্তির জীবন-ব্যবস্থা। ভালো-মন্দ নির্বিশেষে প্রতিটি ঘটনায় ইতিবাচক ও গঠনমূলক সাড়া প্রদানের মাধ্যমে সুস্থ মনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব।
শেষাংশ
তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের ক্রমবর্ধমান ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন এবং মানসিক অসুস্থতা। কায়িক শ্রম না করা ও ক্ষতিকর খাদ্যাভ্যাস এই প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করে। এর ফলে আকস্মিক দূর্বলতা, উচ্চারণগত অস্বাভাবিকতা, দৃষ্টি, বোধ ও স্মৃতি শক্তির অবনতির মতো উপসর্গ দেখা দেয়। রুটিন মাফিক সুষম আহার, ঘুম ও শরীর চর্চার মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারণ পদ্ধতি বাঁচাতে পারে এই মরণঘাতী স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে। পাশাপাশি মনের সুস্থতার লক্ষ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানোও জরুরি। এই পদক্ষেপগুলোর দৌলতে দীর্ঘমেয়াদে স্ট্রোকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
আরো পড়ুন: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
৭৫ দিন আগে
রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতি: দেহ ও মনকে সুস্থ রাখতে করণীয়
পবিত্র রমজান মাস ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য সংযম ও শৃঙ্খলা অনুশীলনের এক পরম সুযোগ। ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি এই আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি দৈহিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র তৈরি করে। ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একটানা পানাহার থেকে বিরত থাকা স্বাভাবিক জীবন ধারণে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য শরীর ও মন দুটোকেই আগে থেকে প্রস্তুত করা উচিত। চলুন, রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা কী এবং এর বাস্তবায়নের জন্য কী ধরণের কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে- তা বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
রমজানে মাসব্যাপী রোজা রাখতে স্বাস্থ্যগত পূর্বপ্রস্তুতি কেন জরুরি
পুরো এক মাস টানা রোজা রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো স্বাস্থ্যগত জটিলতা। সব রকম পানাহার থেকে বিরত থাকার পরেও পর্যাপ্ত শক্তির মাত্রা বজায় রাখার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করা দরকার। খাওয়া এবং ঘুমের ধরণে আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে ক্লান্তি, পানিশূন্যতা এবং হজমের সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে মাসের প্রথম রোজাগুলোতে এরকম অবস্থা সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক।
তাই রমজানের আগেই খাদ্যাভ্যাসে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা হলে এই ধাক্কা সামলানো সহজ হয়ে ওঠে। এই প্রস্তুতি শরীরে শক্তির ভারসাম্য এবং মনোনিবেশে সহায়তা করে, যা রমজানের ধর্মীয় মাহাত্ম্য বজায় রাখার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে শরীর দীর্ঘ সময় আহার থেকে বিরত থাকার সময়কে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় সহনশীলতা অর্জন করে। এই সঙ্গতিপূর্ণতা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যতীত রমজান পরবর্তী তিন বেলা আহারের জীবনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক।
পবিত্র রমজানে এক মাস রোজা রাখার পূর্বে শারীরিক প্রস্তুতি
.
প্রতি বেলার আহারে সময়ানুবর্তিতা
প্রস্তুতিপর্বটা শুরু করতে হবে রমজানের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে ধীরে ধীরে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে। আসন্ন রোজার সময়সূচির সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে ভারী খাবারের পরিবর্তে নিয়মিত বিরতিতে হাল্কা খাবার গ্রহণ করা যায়। সারা দিনের জন্য ডিনারের উপর নির্ভরশীলতা কমানো উচিত। কেননা এই অভ্যাস হজমকে ব্যাহত করে এবং রোজার সময় অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন: ভিমরুলের কামড় কতটা ভয়ংকর? সাবধানতা ও করণীয়
পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি অধিক মনোযোগী হতে হবে। বীজ জাতীয় খাবার, ফল এবং চর্বিহীন প্রোটিন দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে সাহায্য করে। অপরদিকে চিনি ও অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার শরীরের দুর্বলতার কারণ হয়। এই নতুন খাদ্যাভ্যাস ভোর রাতে খেয়ে সারা দিন রোজা রাখার জন্য শরীরকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে তৈরি করে।
সব সময় হাইড্রেটেড থাকা
সমগ্র মাসব্যাপী রোজা মানে প্রতিদিন এক বিপুল পরিসরের সময় শরীরের অভ্যন্তর ভাগ শুষ্ক থাকা। এ অবস্থায় শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগানের জন্য আগে থেকেই নিয়মিত পানি খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। শরীরের পর্যাপ্ত হাইড্রেশনের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করার প্রয়োজন। নারকেলের পানি, তাজা ফলের রস এবং তরমুজের মতো পানিসমৃদ্ধ ফলগুলো হাইড্রেশনের জন্য সহায়ক। এভাবে শরীরের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণ করলে রোজার সময় ক্লান্তি, মাথাব্যথা এবং অন্যান্য ডিহাইড্রেশন-সংক্রান্ত লক্ষণগুলো থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস
দীর্ঘ মেয়াদে শরীরকে সুস্থ ও সতেজ রাখতে স্বাস্থ্যকর ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। সেহরি ও ইফতারের সময়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য আগে থেকেই ঘুমের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনতে হবে। যারা রাতে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন, তাদের জন্য এই পরিবর্তন আনা অনেকটাই সহজ ব্যাপার।
ঘুমের অনিয়ম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং হজমে ব্যাঘাত ঘটায়। এতে করে দেহের সামগ্রিক শক্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলশ্রুতিতে রোজা রাখার মুহূর্তগুলো ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, রাতে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া এবং ভোরের কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করা হলে রমজানের রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়। ঘুমের এই অনুশীলন কেবল শরীরের জন্যই নয়, মনের স্বাস্থ্যের জন্যও উপযোগী।
আহারে ধীরে ধীরে ক্যাফেইন এবং চিনির পরিমাণ কমানো
রোজার প্রথম দিনগুলোতে আকস্মিকভাবে ক্যাফেইন ও চিনি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা মাথাব্যথা, বিরক্তি এবং ক্লান্তির কারণ হতে পারে। এই উপসর্গগুলো এড়াতে রমজান মাসের আগে থেকে ধীরে ধীরে এ ধরণের খাদ্য উপাদানগুলো পরিহার করা উচিত।
কফি, এনার্জি ড্রিংক্স এবং চিনিযুক্ত স্ন্যাকসের বদলে ভেষজ চা এবং তাজা ফল খাওয়া শুরু করা যেতে পারে। চিনি ও ক্যাফেইনের এই ক্রমান্বয়ে হ্রাস শরীরকে আকস্মিক ধাক্কা থেকে রক্ষা করবে। এছাড়া পরিশোধিত চিনি গ্রহণ কমিয়ে দেওয়া রক্তে শর্করার মাত্রাকে স্থিতিশীল করে ও ক্ষুধা হ্রাস করে। এটি সারা দিন ধরে শক্তি ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট কার্যকর।
এক মাস রোজা পালনের পূর্বে মানসিক প্রস্তুতি
.
প্রাত্যহিক জীবনকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা
পুরো রমজান মাস জুড়ে রোজা রাখা সম্পূর্ণ একটি নতুন জীবন ধারণের সমতূল্য। তাই নতুন নিয়মের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। রমজানের প্রথম দিন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছু বদলে ফেলার পরিবর্তে আগে থেকে ধীরে ধীরে পবির্তন আনা উচিত।
আরও পড়ুন: ক্যান্সারের নতুন অ্যান্টিবডি চিকিৎসা টিউমার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: গবেষণা
ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে ঘুম ও খাওয়া-দাওয়া প্রতিটি কাজের জন্য নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করতে হবে। ধৈর্য্য ধারণের উপর অধিক মনোনিবেশ করা জরুরি। এর সঙ্গে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করা হলে তা মানসিক চাপ কমানোর জন্য সহায়ক হবে।
অপ্রয়োজনীয় কাজ এবং বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। এর পরিবর্তে ইবাদতের পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে।
সহনশীলতার অনুশীলন
রোজার দিনগুলোতে মানসিক উন্নতির পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা হলো সহনশীলতা বা ধৈর্য্য। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও রোজা পালনে ধৈর্য্যের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। এর সঙ্গে মানসিক নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম বা হাল্কা ধ্যান দিয়ে এই অনুশীলন শুরু করা যেতে পারে। এই ক্রিয়াকলাপ কঠিন মুহূর্তগুলো অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। একজন সহনশীল ব্যক্তি তার চিন্তাগুলোকে সুসংগঠিত করতে পারেন, যা তার উদ্বেগ কমাতে এবং মনকে শান্ত করতে কাজে লাগে।
একই সঙ্গে নিজের সময়টাও কাটাতে হবে সমমনা লোকদের সঙ্গে। ধর্মীয় বিষয়ে সৃজনশীল আলোচনা পরস্পরের মধ্যে রোজা রাখার উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। মসজিদে গিয়ে সবার সঙ্গে একত্রে নামাজ পড়া এবং গরীব-মিসকিনদের সাহায্য করা মানসিক জীর্ণতা দূর করার মোক্ষম উপায়। এতে মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটে, যা ক্ষুধা বা ক্লান্তির মতো কঠিন মুহূর্তগুলো মোকাবিলা করার উৎকৃষ্ট হাতিয়ার।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু: প্রাণে বাঁচলেও নীরবে শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন নারীরা
কুরআন তেলাওয়াতের প্রয়োজনীয় অ্যাপস ব্যবহার
বর্তমান সময়ের সমগ্র জীবন যখন প্রযুক্তিতে নিমজ্জিত, তখন সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যেতে পারে ইবাদতের কাজে। এখন কুরআন পড়া ও শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মোবাইল অ্যাপ্স রয়েছে। এগুলো ঘরে ও বাইরে যেকোনো স্থানে চলতে ফিরতে কুরআন পাঠ বা দোয়ার মধ্যে থাকার জন্য যথেষ্ট উপযোগী।
‘তার্তিল’, ‘দ্বীন’, ‘মুসলিম বাংলা’, এবং আল কুরআন (তাফসির অ্যান্ড বাই ওয়ার্ড)-এর মতো অ্যাপগুলোতে সাবলীলভাবে কুরআন পড়া এবং শোনা যায়। এগুলোতে রয়েছে ভয়েস-কমান্ড, বুকমার্ক, এবং সঠিক উচ্চারণ যাচাইয়ের ফিচার। এছাড়াও এগুলোর শাব্দিক অনুবাদ ও তাফসিরের সুবিধাগুলো কুরআন গভীরভাবে বোঝার জন্যও উপযোগী।
স্মার্টফোনে অতিক্রান্ত সময় নিয়ন্ত্রণ
ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ এবং সহনশীলতা বিনষ্টকরণের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময় দেওয়া। প্রয়োজনীয় কাজের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিনোদনমূলক অ্যাপগুলোতে দিনের একটা বিরাট অংশ অতিবাহিত হয়। এতে উৎপাদন ও সৃজনশীল কাজের প্রতি নিরুৎসাহ সৃষ্টি হয়। সেখানে রমজান মাসে এই কার্যকলাপ ধর্মীয় কার্যক্রমের প্রতি উদাসিন করে তোলে। ফলশ্রুতিতে নষ্ট হয় রোজা পালনের ভাবমূর্তি। তাই স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করে গরীব-মিসকিনদের সাহায্য, কুরআন পড়া ও তাফসির আলোচনা এবং নামাজ পড়ার প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। উপরন্তু, স্মার্টফোনের নীল আলো ঘুমের জন্যও ক্ষতিকর, যা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার দিকে ধাবিত করে। ফলে সেহরি ও ফজরের নামাজ বাদ পড়ে যায় এবং পরবর্তীতে সারাদিন পানাহার থেকে বিরতি থাকার অভিজ্ঞতা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
পরিশিষ্ট
কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়া সঠিক ভাবগাম্ভীর্য মেনে রমজানের রোজা পালনের জন্য শারীরিক ও মানসিক পূর্বপ্রস্তুতি অপরিহার্য। নিত্যদিনের আহার ও ঘুমে রুটিন মেনে চলা এবং সার্বক্ষণিক হাইড্রেটেড থাকা শরীরকে যেকোনো দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। অপরদিকে, নিয়মতান্ত্রিক জীবনধারণ এবং সহনশীলতার চর্চা মননশীলতা বিকাশে সহায়ক হবে। এই পদ্ধতিতে ত্বরান্বিত করতে পারে কুরআন তেলাওয়াতের অ্যাপ ব্যবহার এবং স্মার্টফোন ব্যবহারে পরিমিতিবোধ। সার্বিকভাবে এই পদক্ষেপগুলোর যথাযথ অনুসরণের সম্ভব সুস্থ দেহ ও মন নিয়ে পুরো রোজার মাসটি অতিবাহিত করা।
আরও পড়ুন: শীতে ওজন বেড়ে যাচ্ছে? জেনে নিন কারণ ও সমাধান
৭৮ দিন আগে
শীতে ওজন বেড়ে যাচ্ছে? জেনে নিন কারণ ও সমাধান
শীতের আমেজ যতই বাড়তে থাকে, ঘরে থাকার লোভটা যেন ততই জেঁকে বসে। একই সঙ্গে মুখরোচক মৌসুমি খাবারগুলো এড়ানোটা রীতিমত দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ঋতুর এই পালাবদলে চিরায়ত নিয়মেই সারা শরীর জুড়ে ভর করে আড়ষ্টতা। এই প্রবণতা প্রকোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরুৎসাহ চলে আসে শরীর চর্চার প্রতি। অপরদিকে জিভে জল আনা খাবারের লোভ সামলাতে না পারায় সঙ্গত কারণেই বিপত্তি ঘটে শরীরের ওজন নিয়ে। বসন্ত পেরিয়ে গরম আসার আগেই বেজায় ভারী হয়ে ওঠে সারা শরীর। প্রতি শীতে এভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা নিয়ে কেন এতটা ঝামেলা পোহাতে হয়? এ থেকে মুক্তিই বা কিসে! চলুন, শীতকালে শরীরের ওজন বৃদ্ধি প্রতিরোধে কার্যকরি উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
শীতে কেন ওজন কমানো কঠিন
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো সৃষ্টি হয় পরিবেশগত, মনস্তাত্ত্বিক এবং শারীরিক দিক থেকে সামগ্রিকভাবে। পৃথকভাবে এই প্রভাব বিভক্ত করা হলে নিম্নোক্ত কারণগুলোর অবতারণা ঘটে।
শরীর চর্চার ঘাটতি
দিন ছোট হয়ে আসা এবং শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য আবদ্ধ জায়গায় থাকার প্রবণতা বাড়তে থাকে। খোলা জায়গায় জগিং, দৌড়ানো এবং খেলাধুলা তো বন্ধ হয়ই, এমনকি অন্যান্য সময়ের মতো হালকা পায়চারির জন্যও কেউ ঘরের বাইরে বেরতে চান না। ঘরে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার দরুণ দেহের স্থিতিশীলতা শীতের প্রাকৃতিক জড়তাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। এতে করে শরীরের পেশীগুলোর সঙ্কোচন-প্রসারণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। এই পরিবর্তন প্রতিদিনের ক্যালোরি ব্যয়কে কমিয়ে দিয়ে শরীরের স্বাভাবিক বিপাকে অবনতি ঘটায়। এভাবে সপ্তাহ কিংবা মাসব্যাপি চলতে থাকলে দেহ ক্রমশ ওজন বৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়।
আরো পড়ুন: সার্কেডিয়ান রিদম বা দেহ ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
অতিরিক্ত আহার
অন্যান্য মৌসুমের ন্যায় শীতের মাসগুলোতেও পাওয়া যায় নতুন সবজি, ফল ও অন্যান্য মুখরোচক খাবার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট, চর্বি ও শর্করা সমৃদ্ধ এই খাবারগুলো তৃপ্তির সঙ্গে তাৎক্ষণিক উষ্ণতা দেয়। তাই এগুলো শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখার জন্য সহায়ক। তবে ক্রমাগত আহারের ফলে শরীরে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যতটুকু প্রয়োজন তার থেকেও উদ্বৃত্ত থাকে ক্যালোরির পরিমাণ। যথা সময়ে নির্গত না হলে এই ক্যালোরি শরীরে মেদ সৃষ্টিতে অংশ নেয়।
এমনকি পুষ্টিকর খাবারগুলোও অতিরিক্ত খাওয়া হলে পুষ্টির ভারসাম্য ব্যাহত হয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওজন বেড়ে যায়। একদিকে শীতের জড়তা, তারপর দেহের নড়াচড়া কমিয়ে দেওয়ার সঙ্গে আবার অতি আহার যুক্ত হয়ে সুস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
সূর্যালোকের স্বল্পতা
শরীরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতা থাকে শীতের মৌসুমে। কেননা অধিকাংশ দিনগুলোতে কুয়াশার কারণে সূর্যালোকের দেখা পাওয়া যায় না। দেহের হাড়ের গঠন, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন ডি অপরিহার্য। সেখানে শীতকালের অভাবে ক্লান্তি ও হতাশার অনুভূতি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে যেগুলো সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (এসএডি)-এর সাধারণ লক্ষণ।
এসএডি কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায়, যা সাময়িকভাবে দেহে সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটে, তবে অতিরিক্ত মাত্রা বিরামহীন ভক্ষণ ও অলসতার একটি চক্র তৈরি করে, যা ভেঙে বের হওয়া কঠিন।
আরো পড়ুন: থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
মেটাবলিজমের পরিবর্তন
মানবদেহের বিপাক প্রক্রিয়া প্রকৃতিগতভাবেই ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেয়। ঠাণ্ডা তাপমাত্রা শরীরের আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বজায় রেখে বিপাকীয় হারে সামান্য বৃদ্ধি ঘটায়। কিন্তু যখন শীতকালীন খাবার অতিমাত্রায় গ্রহণ করা হয় তখন এই বিপাক প্রক্রিয়া ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীর একটি হালকা ‘হাইবারনেশন মুডে’ প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় শক্তি ব্যবহার না করে বিপাকের গতিকে কিছুটা কমিয়ে দেয়। এর সঙ্গে বাহ্যিকভাবে যখন শরীরের পেশীগুলোর স্থবিরতা যুক্ত হয়, তখন তা দেহকে স্থুলতার দিকে পরিচালিত করে।
মানসিক চাপে আহারের প্রবণতা
মেজাজ ও দেহের অভ্যন্তরে সঞ্চিত শক্তির উপর ঋতুগত প্রভাবের কারণে ‘ইমোশোনাল ইটিং’ বা ‘স্ট্রেস ইটিং’-এর প্রবণতা তীব্র হয়। ফলে ব্যক্তি মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে ঘন ঘন আহার করতে উদ্যত হন। অনেকের মাঝেই শীতল আবহাওয়া বিষন্নতার উদ্রেক ঘটায়। এর সঙ্গে বাহ্যিক প্রভাবক যেমন একাকীত্ব বা একঘেয়েমির অনুভূতি যুক্ত হলে তা মানসিক চাপে রূপ নেয়। এ সময় আহারের জন্য তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিক ক্যালোরি সমৃদ্ধ মুখরোচক খাবারগুলোকেই বেছে নেন। এগুলো তাৎক্ষণিকভাবে উষ্ণতা ও তৃপ্তির একটি অস্থায়ী অনুভূতি দেয়। কিন্তু এই আচরণের পুনরাবৃত্তি পরবর্তীতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
আরো পড়ুন: মুখের দুর্গন্ধ দূর করার ঘরোয়া উপায়
শীতকালে ওজন বৃদ্ধি এড়ানোর কার্যকরি সমাধান
উপরোক্ত অসুবিধাগুলোর কারণে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য হলেও তা অসম্ভব নয়। আশার কথা হচ্ছে- উষ্ণ মৌসুমে যে কোনো অভ্যাস গড়ে তোলার সময়ে অল্পতেই প্রচণ্ড ক্লান্তি চলে আসে। কিন্তু শীতে এই সমস্যা নেই, বরং এ সময় অল্প শ্রমেই পাওয়া উষ্ণতা আরও বেশি কায়িক শ্রমের খোরাক যোগায়। এই উদ্দীপনাকে পুজি করে নিম্নলিখিত কৌশলগুলো অবলম্বন করা হলে ওজন বৃদ্ধি এড়ানোর কঠিন পথটা সহজ হয়ে আসবে।
ঘরে থাকার সময়গুলো কর্মচঞ্চল রাখা
প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে স্বাভাবিক ভাবে ঘরের বাইরে আনাগোণাটা কমে আসে। তাই ঘরের ভেতরে থাকার মুহুর্তগুলো দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া অব্যাহত রাখার দিকে মনযোগ দিতে হবে। বর্তমানে অনলাইন থেকেই ওয়ার্কআউট ভিডিওগুলোর মাধ্যমে হোম জিম সেট-আপ করা যায়। খুব বেশি আয়োজনের দিকে যেতে না চাইলে যোগব্যায়াম বা পাইলেটেস-এর মত ব্যায়ামগুলো যথেষ্ট উপযোগী।
রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং এবং কার্ডিও এক্সারসাইজ সমৃদ্ধ ওয়ার্কআউটগুলো ক্যালোরি পোড়ানো এবং একই সঙ্গে ঘরের ভেতরে ব্যায়ামের জন্য উৎকৃষ্ট। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড, কেটলবেল, লাঞ্জ এবং পুশ-আপ।
আরো পড়ুন: রক্তের গ্রুপ: কে কাকে রক্ত দিতে পারবে?
ঘরে থাকার মুহুর্তগুলোতে শরীরের পেশী সচল রাখার জন্য ব্যায়ামই একমাত্র উপায় নয়। আরও একটি কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে ঘর গোছানো। প্রায় সময় দেখা যায় সারা বছর ধরে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় ঘর পরিপাটি রাখার দিকেই নজর দেওয়া হয় না। এর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হতে পারে এই শীতকাল।
এই কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে রিডিং বা কম্পিউটার টেবিল গোছানো, বইয়ের তাক ছোট করে আনা, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা, এবং বহু দিনের জমে থাকা ময়লা যেমন স্টোর রুম পরিষ্কার প্রভৃতি। সিলিং-এর ঝুল, ফ্যান, টয়লেট, এবং আসবাব পরিষ্কারের মত নিত্য-নৈমিত্তিক কাজগুলোও করা যেতে পারে। এই উৎপাদনশীল ক্রিয়াকলাপ কর্মচঞ্চলতার মাধ্যমে উষ্ণতার যোগান দেয় এবং বাধাধরা ব্যায়াম ছাড়াই দেহের ক্যালোরি পোড়াতে সহায়তা করে। শুধু তাই নয়, এই কাজগুলো অযথা দুশ্চিন্তা থেকে মনকে অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট কার্যকর। উপরন্তু, বসবাসের ঘরটি সুসংগঠিত ও বিশৃঙ্খলামুক্ত হলে তা মনস্তত্ত্বের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ঘরের বাইরে শরীর চর্চা
উন্মুক্ত পরিবেশে শরীর চর্চার কোনও বিকল্প নেই। নিদেনপক্ষে আবহাওয়া একটু সহনীয় হয়ে এলে ঘরের বাইরের শারীরিক অনুশীলনগুলো শুরু করা উচিত। যারা নিয়মিত শরীর চর্চায় অভ্যস্ত তাদের জন্য দুয়েক সপ্তাহের গ্যাপ সামগ্রিক ভাবে শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রয়োজনে অন্যান্য মৌসুমগুলোর তুলনায় শরীর চর্চার সময়টা কিছু কমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ব্যায়াম না করে আবহাওয়া বুঝে ভিন্ন ভিন্ন সময় বেছে নেওয়া যায়। এতে করে অভ্যাস বজায় থাকবে এবং সেই সঙ্গে দেহের পেশীগুলো সচল থাকবে।
আরো পড়ুন: এমপক্সের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি গুরুত্বারোপ
শীতের মৌসুমি খাবারগুলো উপভোগের জন্য প্রোটিন ও ফাইবার পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবারগুলো সর্বোত্তম। প্রোটিন পেশী রক্ষণাবেক্ষণ, বিপাক এবং ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে। আর ফাইবার স্বল্পাহারেই পাকস্থলির পূর্ণতা বৃদ্ধি ও হজমে সহায়তা করে ঘন ঘন খাওয়ার উন্মাদনা কমায়। এছাড়াও এ ধরণের খাবার মশলা বা উচ্চ-চর্বিযুক্ত উপাদানগুলোর প্রয়োজন ছাড়াই আলাদা স্বাদ যোগ করতে পারে।
যেমন মিষ্টি আলু, গাজর, শালগম এবং পালং শাকের মত হাল্কা খাবারগুলো রাখা যেতে পারে লাঞ্চ ও ডিনারে। এগুলোর সঙ্গে চর্বিহীন প্রোটিন ও কম সোডিয়াম সম্পন্ন স্যুপ অতিরিক্ত ক্যালোরি ছাড়াই উষ্ণতার যোগান দিবে। এছাড়া মটরশুটি, ডিম ও শিমের সমন্বয়ের মাধ্যমে ফাইবার ও স্বাস্থ্যকর প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হতে পারে।
স্ন্যাক হিসেবে চিনাবাদাম ও মাখনের মিশ্রণের সঙ্গে আপেল কুঁচি সহ দই একটি উৎকৃষ্ট বিকল্প। বেশি তেলযুক্ত ও মশলাদার খাবারগুলো এড়িয়ে চলাই উত্তম।
আরো পড়ুন: অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়
পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি গ্রহণ
সূর্যালোকের অভাবে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি পূরণের জন্য কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো সব মৌসুমেই পাওয়া যায়। যেমন ফ্যাটযুক্ত মাছ, ডিমের কুসুম এবং ফোর্টিফাইড দুগ্ধজাত খাবার। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এই খাবারগুলো রাখা শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগানের জন্য যথেষ্ট। এই ভিটামিনের অভাব খুব বেশি খারাপের দিকে এগোলে অবশ্যই পরিপূরক বিকল্পের জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সরণাপন্ন হতে হবে।
পানিশূন্যতা এড়িয়ে চলা
ঠান্ডায় ঘামের ঝামেলা না থাকলেও শরীরে পানির ভারসাম্য ধরে রাখা আবশ্যক। বিপাক সহ শরীরের আভ্যন্তরীণ প্রতিটি কার্যকলাপে একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে পানি। অল্প মাত্রায় পানিশূন্যতাও কখনও কখনও অতি মাত্রায় ক্ষুধার উদ্রেক ঘটাতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা ছাড়াও এই সমস্যার একটি উপযুক্ত সমাধান হচ্ছে ভেষজ চা। এটি তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি দেহে আরামদায়ক উষ্ণতা সরবরাহ করে। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিনির পরিমাণ কমাতে হবে।
প্রতিদিন ঘুমের নিয়ম ঠিক রাখা
ক্ষুধা ও ক্ষুধার সঙ্গে সম্পৃক্ত হরমোন নিয়ন্ত্রণে রুটিন মাফিক ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার সময় এবং ঘুম থেকে উঠার সময়ের মধ্যে সামঞ্জস্যতা রাখতে হবে। এমনকি মাঝের ঘুমের সময়টিও কখনও বেশি কখনও কম হওয়া উচিত নয়। অপর্যাপ্ত ঘুম মানেই মেজাজের ভারসাম্যহীনতা, যার রেশ ধরে আসে ক্লান্তি, বিষণ্নতা এবং কর্মবিমুখতা। এ সবকিছু পরিচালিত করে মানসিক চাপের দিকে, যে অবস্থায় অনেকেই অতিরিক্ত অস্বাস্থ্যকর এবং অতিরিক্ত আহারের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
আরো পড়ুন: ভিমরুলের কামড় কতটা ভয়ংকর? সাবধানতা ও করণীয়
অলসতা পরিহার ও স্বাস্থ্যকর ঘুমের জন্য দিনে ঘুম পরিত্যাগ করতে হবে। সেই সঙ্গে ঘুমের বিছানাটিও হতে হবে সমতল। উচু-নিচু নরম বিছানা ঘুমের সময়কালীন শরীরের আভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া এমন বিছানায় ঘুম থেকে ওঠার পরেও শরীরের বিভিন্ন সন্ধিস্থলে ব্যথা অনুভূত হয়।
দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা
প্রচণ্ড মানসিক চাপের সময় দেহের ভেতর কর্টিসল নামক হরমোনের অধিক মাত্রায় নিঃসরণ ঘটে। ফলে অধিক চর্বি বা চিনিযুক্ত খাবারের জন্য প্রচণ্ড উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। এই প্রভাবকে প্রশমিত করতে মেডিটেশন ও বাইরে অল্প হাঁটার পরামর্শ দেওয়া হয়। আসলে নিয়মিত শরীর চর্চা শরীরের ক্যালোরি পোড়ানোর পাশাপাশি মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণেরও একটি মোক্ষম হাতিয়ার।
তবে ব্যায়াম ছাড়াও দুশ্চিন্তা মুক্তির আরও কিছু কার্যকর উপায় রয়েছে। তন্মধ্যে ঘর গোছানোর বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রথম কৌশল পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়া।
আরো পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্র, খাদ্য ব্যাংক ও অনুদান সঙ্ঘগুলো প্রায়ই শীতের মাসগুলোতে বঞ্চিত নাগরিকদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মৌসুমি ইভেন্টগুলোতে দাতব্য তহবিল সংগ্রহ, বিনামূল্যে মুদ্রি সামগ্রী ও রান্না করা খাবার বিতরণ, এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা করা হয়। এগুলোতে শুধু অর্থ সাহায্য না দিয়ে সশরীরে অংশগ্রহণ করা যায়। এই সামাজিক কার্যকলাপ একই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে সমুন্নত রাখে।
দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখার আরও একটি আকর্ষণীয় উপায় হচ্ছে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে যাওয়া। প্রতিটি ভ্রমণেই উদ্দিষ্ট গন্তব্যে যাতায়াত ও আবাসান সহ দর্শণীয় স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়ানোতে পর্যাপ্ত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হয়। যারা হাইকিং, রাফ্টিং, কায়াকিং, বা ট্রেকিং-এ যান তাদের অবশ্য শারীরিক ধকলটা একটু বেশিই হয়। তবে মনের যাবতীয় নৈরাশ্য দূরীকরণে এর থেকে উৎকৃষ্ট বিকল্প আর নেই। তাছাড়া প্রকৃতির সান্নিধ্যে যে কোনও অস্থির মন নিমেষেই শান্ত হয়ে যায়। সর্বপরি, স্থুলতা এড়িয়ে ফিটনেস ধরে রাখার ক্ষেত্রে ভ্রমণ হতে পারে নিশ্চয়তার মাপকাঠি।
পরিশিষ্ট
শীতকালে শরীরের ওজন বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা কেন কঠিন সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকলে এর কার্যকরি কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। হিম শীতল আবহাওয়ার আড়ষ্টতা, মৌসুমি খাবার ও সূর্যালোকের স্বল্পতাই মূলত এখানে প্রধান নির্ধারক। এগুলোর পথ ধরে আসে মানসিক ও শারীরিক জীর্ণতা, যার বদৌলতে শরীর ধাবিত হয় স্থুলতার দিকে। এর বিপরীতে শরীর চর্চা ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণে দৃঢ়চেতা হওয়া গেলে নেতিবাচক প্রভাবগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে। দেহকে সার্বক্ষণিক নড়াচড়ার মধ্যে রাখা জড়তা কাটানোর পাশাপাশি আরামদায়ক উষ্ণতা পাওয়ার জন্যও সহায়ক। আর মুখরোচক খাবারের স্বাদ নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিমিতি বজায় রাখলে প্রাণ ভরে উপভোগ করা যাবে শীতের আমেজ।
আরো পড়ুন: এইচএমপিভি ভাইরাস: কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
১১৪ দিন আগে
ডেঙ্গু: প্রাণে বাঁচলেও নীরবে শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন নারীরা
আলেয়া বেগম। রাজধানীতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। ঘর মোছা থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া—অত্যধিক খাটুনির পর দিন শেষে তার শরীর ব্যথা হবে, এটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছিলেন ২৯ বছর বয়সী এই নারী। তবে একদিন হঠাৎ করে জ্বরে পড়ে ব্যথার চোটে তিনি যখন আর হাত-পা নড়াতে পারছিলেন না, তখন গুরুতর কিছু যে হয়েছে তা তার বুঝতে বাকি ছিল না।
শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটলে তিনি একটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ততক্ষণে এই রোগে তিনি কাবু হয়ে গেছেন, যা পরে তার জীবিকার ওপরও প্রভাব ফেলে।
আলেয়ার কথায়, ‘পরের বাড়িতে কাম করি। কাপড় ধুই, ঘর পরিষ্কার করি; প্রথমে কামের চাপের কারণেই শরীরে ব্যথা হইছে বলে মনে হইছিল। তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।’
‘অসুস্থ হইয়া আমি কয়দিন কামে যাইতে পারিনি, এর মধ্যে তারা অন্য কামের লোক ঠিক কইরা ফেলছে। একে তো রোগে ট্যাকা-পয়সা খরচ হয়ে গেছে, তার ওপর কাজও নাই; খুবই বিপদে পইড়া গেছিলাম।’
ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার তিন মাস অতিবাহিত হলেও এখনও শরীরের বিভিন্ন সংযোগস্থলে ব্যথা অনুভব করেন আলেয়া, যা ডেঙ্গুর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ডেঙ্গুর কারণে দেশের নারীরা কোন ধরনের শারীরিক সমস্যা ও জটিলতার মধ্যে পড়ছেন, আলেয়ার গল্পটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত বছর দেশে ৫৭৫ জনের প্রাণ কেড়েছে এডিস মশাবাহিত এই রোগ, নারীরা যার উল্লেখযোগ্য শিকার।
ডেঙ্গুতে নারীদের দুর্ভোগ বেশি কেন?
২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানো ৫৭৫ জনের মধ্যে ২৯৫ জন ছিলেন নারী, যাদের বেশিরভাগের বয়স ২৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। হরমোনের মতো জৈবিক পার্থক্য এবং রক্তস্বল্পতা ও উচ্চ রক্তচাপের মতো শারীরিক জটিলতা নারীদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ডেডিকেটেড হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া সুলতানা রেশমা বলেন, ‘নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কিছু পদ্ধতিগত বাধার সম্মুখীন হন। এতে তাদের চিকিৎসা পেতে দেরি হয়ে যায়। এর ফলে পরবর্তীতে তারা গুরুতর (শারীরিক) জটিলতার মধ্যে পড়েন।’
নারীর সামাজিক অবস্থান ও মূল্যায়নের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। এ বিষয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশের নারীদের বেশিরভাগই নিজের স্বাস্থ্যের চেয়ে পরিবারকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এই বয়সী নারীদের (২৬-৪০) মধ্যে এই প্রবণতা আরও বেশি লক্ষ করা যায়।’
অর্থনীতিতে নারীর অসুস্থতার প্রভাব
দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই (২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী) নারী। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন। ফলে তাদের অসুস্থতায় শুধু নির্দিষ্ট পরিবারটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও পড়ে নেতিবাচক প্রভাব।
আলেয়া বেগমের জন্য ডেঙ্গুর আর্থিক প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক ও কঠোর। অসুস্থ হওয়ার পর তিনি জীবিকা হারিয়ে ফেলেন।
‘ওই সময় আমার চোখ ও ঠোঁট ফুইলা গেছিল। হাঁটা তো দূরে থাক, উইঠা দাঁড়াইতেও কষ্ট হইত’, বলছিলেন এই গৃহকর্মী। তবে সুস্থ হয়ে তিনি কাজে ফিরে যখন দেখেন যে বাসাগুলোতে নতুন গৃহকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দুর্বল শরীর নিয়ে নতুন করে কাজ খুঁজে পেতে ঘাম ছুটে গিয়েছিল বলে জানান তিনি।
সময়মতো চিকিৎসার ঘাটতি
আলেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের পদ্ধতিগত সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। আর্থিক সমস্যা, এমনকি দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবাপ্রার্থীদের দীর্ঘ লাইনও নারীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বিলম্ব হওয়ায় প্রভাব রাখে।
সচেতনতা ও স্বাস্থ্যসেবার দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক সাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘গ্রামের অনেক নারী জানেনই না প্লাটিলেট কাউন্ট বা সিবিসি টেস্ট কী।’
উত্তোরণের পথ
নারীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির বিষয়ে জোর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি আরও আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। ডেঙ্গু নিয়ে জনসচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচিতে রোগটির লক্ষণ ও প্রতিরোধের বিষয়ে নারীদের জানানো ও সচেতন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে নারীদের সচেতনতা বাড়ানো এবং আক্রান্ত নারীদের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস বুথের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক সাদিয়া।
তার মতে, ‘এসব বুথ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক দিকনির্দেশনাসহ স্যালাইন ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা যেতে পারে।’
‘আপনি প্রথমে ডাক্তার দেখাবেন, তারপর পরীক্ষা করাবেন, তারপর আবার ডাক্তারের কাছে যাবেন—এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নারীদের জন্য এটি আরও বেশি পীড়াদায়ক। তবে পুরো প্রক্রিয়াটিকে যদি সুবিন্যস্ত করে এক জায়গায় নিয়ে আসা যায়, তাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলতে পারে।’
ডেঙ্গু থেকে নিস্তার পেলেও আলেয়ার মতো নারীরা এমন পদক্ষেপের ফলে বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারেন।
২০২৪ শেষ হয়ে নতুন বছর শুরু হলেও ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি যেখানে একটুও কমেনি, সেখানে নারীর জীবন ও জীবিকা রক্ষায় পদ্ধতিগত পরিবর্তনের বিকল্প নেই। এতে করে জীবনদায়ী এই রোগ থেকে সেরে উঠলেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবে যে ক্ষতি হয়, তা পাশ কাটানোর সুযোগ পাবেন আলেয়ার মতো অসংখ্য নারী।
১২২ দিন আগে