বুয়েট ক্যাম্পাসে দুই যুবককে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের বার্তা সম্বলিত লিফলেট প্রচার করতে দেখা গেছে। নতুন একটি সিসিটিভি ফুটেজে এই চিত্র ধরা পড়ে। লিফলেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পশ্চিমা মূল্যবোধ পরিত্যাগ করতে এবং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠনটি।
ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীভূত এই ‘চরমপন্থী গোষ্ঠীর’ গোপন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় কিছু শিক্ষার্থীকে অনলাইনে এবং ফোনে বারবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। তারা এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফুটেজটি প্রকাশ্যে আসে।
মার্চ জুড়ে কয়েক দফায় ইমেইলের মাধ্যমে হিযবুতের প্রচারণার পরে এই শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ওই প্রচারণায় হিযবুত তাহরীর শিক্ষার্থীদের খিলাফতের আলোকে দেশ পরিচালনার লড়াইয়ে অংশ নিতে বলে এবং ছাত্রলীগকে সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
১৯ ফেব্রুয়ারির প্রায় ৩ মিনিটের ওই ফুটেজে দেখা যায়, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবনের শ্রেণিকক্ষগুলোর মাঝের গলি দিয়ে দুই যুবক একটি ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর দুজনে ঘুরে দাঁড়ায়, একজন নজরদারির জন্য সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এবং অন্যজন তার ব্যাগ থেকে লিফলেট বের করে বন্ধ শ্রেণিকক্ষগুলোর দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। যাতে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে এলেই লিফলেটগুলো দেখতে পায়।
আরও পড়ুন: বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষার পরিবেশ দুটিই থাকা উচিত: ড. হাছান মাহমুদ
এ সংস্থাগুলো কীভাবে শিক্ষার্থীদের ইমেইল অ্যাকাউন্ট পেয়েছে সেটি তদন্ত করতে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানায়।
ই-মেইল প্রচারণা ও লিফলেট বিতরণের ভিডিও ছাড়াও একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, অতীতে তারা বুয়েটের আশপাশের দেয়ালে হিযবুতের পোস্টার লাগানো অবস্থায় পেয়েছেন।
ইমেইল পাওয়া ও হিজবুতের বার্তা সম্বলিত কিউআর কোড ছাপানো পোস্টার দেখার কথাও নিশ্চিত করেছে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার ছিল তাদের নিয়ে জামায়াত-ই-ইসলামী সমর্থিত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের ভাড়া করা লবিস্ট এবং আইনজীবীদের ফেসবুক পেজে অপপ্রচার চালাতে দেখা গেছে।
১৯৭১ সালে ‘গণহত্যা’ পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা ছাত্রসংঘ থেকে ১৯৭৭ সালে নতুন নাম নিয়ে ছাত্রশিবির দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি মূল লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে।
নিজস্ব ধরনের হত্যা মিশন ও প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর শিক্ষার্থীদের রগ কেটে ফেলা শিবিরের ট্রেডমার্ক বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিরক্ষা থিংক ট্যাংক আইএইচএস জেনের বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও বিদ্রোহ সূচক অনুযায়ী, এই সংগঠনটি তৃতীয় সবচেয়ে সক্রিয় কোনো রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে স্থান পেয়েছে।
এর আগে গত জুন মাসে দুর্গম হাওর এলাকায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে বুয়েটের ২৪ জন ছাত্র, শিবিরকর্মী ও নেতাকর্মী ধরা পড়েন।
আরও পড়ুন: বিরাজনীতিকরণের নামে বুয়েটকে জঙ্গিবাদের আখড়া বানানো যাবে না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ সময় শিবিরের সঙ্গে আটকদের আনুগত্য নিয়ে গণমাধ্যমের সত্যতা নিশ্চিত করেন স্থানীয় জামায়াত নেতারা। এমনকি শিবিরের একজন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এক সাক্ষাৎকারে গর্ব করে বলেছিলেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় বুয়েটে শিবির ও অন্যান্য চরমপন্থীদের সক্রিয় উপস্থিতি সামনে আসে, যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার ও চরমপন্থি রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগে ৫ মাসের ব্যবধানে দুই শিক্ষার্থীর ওপর নির্মম হামলা চালানো হয়।
একজন হলেন- আরিফ রায়হান দীপ। তাকে তারই এক সহপাঠী তাদের ডরমিটরিতে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে আহত করেন। পরে তিনি মারা যান। অন্যজন তন্ময় আহমেদ, শিবির কর্মীরা ছুরিকাঘাত করে মৃত ভেবে ফেলে গেলেও বেঁচে যান। এখনো বেঁচে আছেন ভয়ংকর ছুরির আক্রমণের ক্ষত নিয়ে।
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অপরাধ হালকা করতে পরিকল্পিত চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে- যেখানে বলা হচ্ছে চ্যানেলগুলো পুরো ভিডিও সম্প্রচার করছে না এবং ভিডিওতে ভয়েস না থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
যাচাই করে দেখা যায়, যে ৬টি চ্যানেল ভিডিও পোস্ট করেছে, সবগুলোতেই দেখা যাচ্ছে যে সিসিটিভি ফুটেজে গোপনে লিফলেট বিতরণের মুহূর্তগুলো ধরা পড়েছে।
আরও পড়ুন: র্যাগিং: বুয়েটের ২৬ শিক্ষার্থীকে শাস্তি
একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কর্মরত এমন একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, 'কেন একই ফুটেজ একাধিক চ্যানেলে প্রচার করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য করতেই ইচ্ছাকৃত এই কাজ করা হচ্ছে। এই ভবন বুয়েটেরই। আর একই সিসিটিভি ফুটেজ চালানো সমস্যা নয়।’
সম্প্রতি এক পোস্টে তন্ময় বলেন, 'বুয়েট ক্যাম্পাসে এসব সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ছিল পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ নিয়ে কথা বলতে রাজি না হওয়ায় সুবিধা হয়েছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ফারুক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, 'কোনো শিক্ষার্থী যেন এই দুষ্টচক্রের মগজ ধোলাইয়ের শিকার না হয়, সেজন্য ক্যাম্পাসে এ ধরনের উগ্রবাদী চক্রের কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পূর্ণ সহযোগিতা নেওয়া জরুরি। সব মহলের সহযোগিতা না পেলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড রোধ করা কঠিন।’
আরও পড়ুন: বুয়েটের হল থেকে শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার