ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে পুরানো এ বাজারের আরো সহস্রাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক, বীমা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বসতঘর।
যেকোন মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে নড়িয়া উপজলার একমাত্র ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বাজার সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী মূলফতগঞ্জ ফাজিল মাদ্রাসাটিও।
রবিবার দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের আঙ্গীনায় ফাটল ধরেছে। এরপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১ ও ২ ভবন থেকে আসবাবপত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হাসপাতালের রোগীদের পাশের একটি ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এছাড়া শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ভাঙন আতঙ্কে এলাকার বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে নেয়ায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে বাজার, হাসপাতালসহ আশ পাশের এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ।
এদিকে ভাঙনরোধে সরকার ৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে পদ্মার পাড়ে জিও ব্যাগ ফেলছে।
স্থানীয়রা বলছে, বহুতল ভবন মুহূর্তেই নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এ মুহূর্তে সেখানে বালুভর্তি জিও ব্যাগের কী গুরুত্ব থাকতে পারে। সরকার কোটি কোটি টাকার জিও ব্যাগ নদীতে না ফেলে নদীভাঙনে ইতিমধ্যে সর্বহারা অসহায় লোকদের সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করলে ভালো হতো। আর স্থায়ীভাবে নদী ভাঙনরোধে সরকারের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ দ্রুত প্রয়োজন।
নদী ভাঙ্গনের শিকার আ. রব বেপারী জানায়, ওয়াপদা এলাকায় তার বাড়ি ছিল। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সেখান দিয়ে আজ বড়-বড় লঞ্চ-স্টীমার যায়। নড়িয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে ভাড়া বাসায় উঠেছে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। এ পর্যন্ত একবার সহায়তা পেয়েছেন। ভাঙন রোধে যে জিও ব্যাগ নদীতে ফেলা হয়েছে তা কোনো কাজে আসছে না। ঠেকানো যায়নি ভাঙন। তিনি বলেন, এ অর্থ ভাঙন কবলিত অসহায় ও অনাহারি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।
আল আমিন, সবুজ রানা হওলাদার ও জয়নাল ফকির জানায়, ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। মানুষের জীবন বাঁচছে না। নদীতে জিও ব্যাগ ফেলে কি হবে? যেখানে একটা বহুতল ভবন ২০ সেকেন্ডে নদীগর্ভে বিলীন হয় সেখানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ কি করে উত্তাল নদীর ভাঙন ঠেকাবে। স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া না হলে মানুষের ঘরবাড়ি সম্পদের মতো সরকারি কোটি কোটি টাকাও নদীর পেটে চলে যাবে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর নড়িয়া উপজেলার পদ্মার পাড়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪ হাজার পরিবারের বাড়িঘর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন কবলিতরা একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে দিশেহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছুটছে। পদ্মার তীরবর্তী এলাকার লোকজনের চোখে ঘুম নেই। তারা দিন রাত তাদের সর্বশেষ সম্বল ঘরবাড়ি, দোকানপাট সরিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও চোখের সামনেই মুহূর্তে সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
এলাকাবাসীর দাবি, ভাঙনরোধে স্থায়ীভাবে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সামনে ওই উপজেলার মানচিত্র পদ্মার ভাঙনে আরো ছোট হয়ে যাবে। সর্বস্ব হারাবে নদীপাড়ের অবশিষ্ট মানুষ।
ভাঙনকবলিত এলাকাবাসী সুজন ঢালী, ইব্রাহীম ঢালী জানান, এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই পদ্মা ভাঙতে দক্ষিণে ৫ কিলোমিটার পযর্ন্ত চলে এসেছে। গত পাঁচদিন ধরে ভাঙন শুরু হয় দুইশ’ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী মূলফৎগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশ।
তারা বলেন, বাজারটিতে অবস্থিত নুর হোসেন দেওয়ান ও ইমাম হোসেন দেওয়ানদের তিনতলা ৪টি ভবনসহ ৩ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একেকটি ভবন ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে দুমড়েমুচড়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জয়নাল দেওয়ান, জবেদ দেওয়ান, নাছির দেওয়ান জানায়, এলাকার সর্বস্বহারা মানুষগুলো দিনরাত করে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজলেও তেমন কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি সরকারের পক্ষ থেকে।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানায়, তারা বর্ষার আগেই চেয়েছিল পদ্মার দক্ষিণ তীরে নড়িয়া উপজেলা শহর এবং পুরানো এ মূলফৎগঞ্জ বাজারটি রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থায় নেয়া হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ ভয়াবহ ভাঙনরোধে সরকার পদ্মা নদীর দক্ষিণ (ডান) তীররক্ষা বাঁধ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এরপর গত ২ জানুয়ারি তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে তা একনেকের বৈঠকে পাস করা হয়। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি।
সূত্র আরো জানায়, বর্ষার শুরু থেকে ভাঙন শুরু হলে ৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে কিছু জিও ব্যাগ ফেলে নদীর গতি পরিবর্তনের চেষ্টা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্ত প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং কাজ ধীরগতিতে হওয়ায় ভাঙন ঠেকানো যায়নি। রক্ষা করা যায়নি ঐতিহ্যবাহী এ বাজারসহ মসজিদ, মাদ্রাসা, বহুতল ভবনসহ হাজার হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি।
স্থানীয়রা জানায়, ওই এলাকার অনেক বিত্তবান লোক এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইও পর্যন্ত নেই।
কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ঈমাম হোসেন দেওয়ান, হাসেম দেওয়ান বলেন, গত দুই মাসে পদ্মার ভাঙনে প্রায় ৪ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, পদ্মা নদী নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অতি কাছে চলে আসায় হাসপতালের মালামাল জেলা প্রশাসক মহোদয় এবং সিভিল সার্জনের নির্দেশক্রমে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রোগীদের জন্য হাসপাতাল ভবনের দক্ষিণ পার্শ্বের আবাসিক দু’টি ভবনে ভর্তি কার্যক্রম এবং জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নদী ভাঙনের শিকার প্রায়ং আড়াই হাজার ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। খুব শিগগিরই ৩৫০ জন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে দুই বান্ডিল করে টিন ও নগদ ৬ হাজার করে টাকা বিতরণ করা হবে।