তদারকি কর্মকর্তা জানান, কাজে ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময় আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না। বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করার পর তিন বছরে মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এমন দাবি সংশ্লিষ্টদের। বাঁধের পাশে জমি অধিগ্রহণ এবং বাড়িঘর অপসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার কারণে বাঁধ নির্মাণ কাজে ধীরগতি হয়েছে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক বলেন, প্রথমবার যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়, দ্বিতীয়বার ওই জমি অধিগ্রহণের আওতায় চলে আসায় কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। জটিলতা দূর করতে কিছুটা সময় বিলম্বিত হয়। দ্রুত বাঁধ নির্মাণ কাজের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের অভিযোগ, নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। বাঁধ নির্মাণ কাজ আগে যে স্থানে শুরু করা উচিৎ ছিল তা করেনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। আর কাজে ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ হয়নি।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলে আঘাত হানে। ১৫ থেকে ১৬ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে শরণখোলায় বলেশ্বর নদীর বেড়িবাঁধ ধ্বংস হয়ে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সের নারী-পুরুষ, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, মাছধরা জাল ও নৌকাসহ মালামাল পানিতে ভেসে যায়। শুধু শরণখোলা উপজেলা নয় জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় নদী পাড়ের বেড়িবাঁধ ভেসে গেছে। সরকারি হিসেবে শুধুমাত্র শরণখোলা উপজেলায় সিডরে ৬৯৬ জন নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
উপকূলবাসীর দাবি ছিল, নদী পাড়ের বাঁধ টেকসইভাবে নির্মাণ করা। কিন্তু সিডর আঘাত হানার ১১ বছরেও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা যায়নি। আকাশে মেঘ এবং নদীতে পানি বাড়লে এখনও বলেশ্বর নদী পাড়ের মানুষের দিন-রাত কাটে আতঙ্কে।
শরণখোলার বলেশ্বর নদী পাড়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উত্তর সাউথখালী এলাকায় নদী পাড়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এসকেভেটরের সাহায্যে মাটি তুলে বাঁধ উঁচু করা হচ্ছে। বুলডোজারের সাহায্যে আবার ওই মাটি সমান করা হচ্ছে। সিমেন্ট ও বালি এবং পাথর দিয়ে তৈরি (কংক্লিটের) ব্লক রাখা হয়েছে বাঁধের পাশে রাজেশ্বর এলাকায়। চায়না ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন কাজ তদারকি করছেন।
প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে গাবতলা আশার আলো সাইক্লোন শেল্টারের কাছে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন বাঁধে ভাঙন ধরেছে। ওই সাইক্লোন শেল্টার থেকে বগী পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার দূরত্বে পাঁচটি পয়েন্টে কয়েকশ’ মিটার এলাকা ভেঙে নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। পাইলিং আর বালুর বস্তা ফেলে ওই ভাঙন রোধ করা হয়েছে।
এদিকে প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে আরো একটি পয়েন্ট ভাঙার উপক্রম হয়েছে। যে কোনো সময় বাঁধের ওই অংশটি ভেঙে নদীতে বিলিন হয়ে যেতে পারে।
বাঁধ নির্মাণের তদারকি কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলী শ্যামল কুমার দত্ত জানান, বাগেরহাটের শরণখোলা এবং মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় নদী পাড়ে ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নিমাণ করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ ও বাড়ি ঘর এবং গাছপালা অপসারণের বিষয় নিয়ে প্রথমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। একারণে দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত ধীরগতিতে কাজ হচ্ছিল এবং চলতি বছরে নির্মাণ কাজে গতি এসেছে বলে দাবি করেন তিনি।
প্রকৌশলী শ্যামল কুমার দত্ত আরও জানান, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরও এক বছর সময় বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছে বলে তিনি জানান।
প্রকৌশলী শ্যামল কুমার দত্তের দেয়া তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক মানের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। সিডরের যে উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তার চেয়েও অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এই বাঁধ রক্ষা করতে পারবে। আর বাঁধের স্থায়ীত্ব অন্তত ৫০ বছর হবে বলে তিনি জানান।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস জানান, ৩৫/১ পোল্ডারের অধীনে শরণখোলায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। প্রথমে সেখানে ছোট বাঁধ নির্মাণের জন্য কিছু জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর পর বাঁধ সম্প্রসারণ করতে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রথমবার যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয় দ্বিতীয়বার ওই জমি অধিগ্রহণের আওতায় চলে আসায় পদ্ধতিগত জটিলতা সৃষ্টি হয়।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, জমির দখল হস্তান্তর বুঝিয়ে দেয়ার আগেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বাঁধের কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে জটিলতা নিরসন করা হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের অর্থ বুঝিয়ে দেয়া শুরু হয়। এখনো জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার কাজ চলছে।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেইজ-১ (সিইআইপি-১) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম জানান, ৩৫/১ পোল্ডারের অধীনে শরণখোলা থেকে মোড়েলগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত নদী পাড়ে ৬২ কিলোমিটার মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। বাঁধের উচ্চতা হবে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় মিটার এবং বাঁধের উপরের অংশে প্রস্ততা থাকবে সাড়ে চার মিটার। সিমেন্ট ও বালির সাথে পাথর দিয়ে এমন ভাবে ব্লক নির্মাণ করে বাঁধে বসানো হবে যাতে ঢেউয়ের আঘাতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এই বাঁধ মোকাবেলা করতে পারবে। বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত গেট নির্মাণ ও মেরামত, নদী ভাঙন রোধ এবং ছোট-ছোট নদী-খাল খনন করা হবে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। দি ফাস্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো অফ হ্যানান ওয়াটার কনসাভেন্সি (সিএইচডব্লিউ ই) নামে চায়নার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এই বাঁধ নির্মাণ কাজ করছে। আর বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
তিনি আরও জানান, বাঁধ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। নতুন করে শরণখোলার বগী এবং মোড়েলগঞ্জের কুমারখালী এলাকায় কিছু জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন জানিয়েছে বাঁধ নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বাঁধের কাজ প্রায় ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বিভাগ জানায়, বাগেরহাট জেলায় তাদের ৩১৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। সিডরে বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হোসেন জানান, সিডরে বলেশ্বর নদী পাড়ে বাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ার পর তাদের প্রধান দাবি ছিল নদী পাড়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ। কিন্তু সিডর আঘাত হানার ১১ বছরেও বলেশ্বর নদী পাড়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। অত্যন্ত ধীরগতিতে বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। বর্তমানে বাঁধ যে অবস্থায় আছে তাতে করে কোনো দুর্যোগ এলে সিডরের চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ওই চেয়ারম্যান।
চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হোসেন আরও জানান, তার ইউনিয়নের মধ্যে বগী এলাকা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। বগী এলাকায় পুরাতন বাঁধের বিভিন্ন এলাকা একের পর এক ভেঙে নদীতে বিলিন হচ্ছে। ফলে ওই ইউনিয়নের ৪, ৫, ৬ এবং ৭ নং ওয়ার্ডের মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। নদী শাসন করে দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি ইউপি চেয়ারম্যানের।
এলাকাবাসী জানায়, সিডরের তাণ্ডবে বলেশ্বর নদী পাড়ের বাঁধ লণ্ডভণ্ড হয়ে গ্রামে পানি ঢুকে পড়ে। পানিতে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ, গবাদীপশু, ঘরবাড়ি এবং মানুষের সহায় সম্পদ ভেসে যায়। তাদের দাবির মুখে টেকসই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে ঠিকই তবে কবে নাগাদ শেষ হবে তা তারা বুঝতে পারছেন না।
সিডর দুর্গত কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, নদী শাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে অনেক স্থানে বাঁধের নিচের অংশ ভেঙে গেছে। আকাশে মেঘ এবং নদীতে পানি বাড়লে তাদের মধ্যে আতংক তৈরি হয়। গুনগত মান ঠিক রেখে দ্রুত বাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করার দাবি জানান ওই সব গ্রামবাসী।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিংকন বিশ্বাস জানান, শরণখোলার মানুষের সিডরের ভয়াবহ সেই আতংক এখনো কাটেনি। এখানকার মানুষ আজও টেকসই বেড়িবাঁধের অপেক্ষায় আছে। টেকসই বাঁধ নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। বেড়িবাঁধের বগী এলাকায় নদীর স্রোতের কারণে প্রায়ই ভাঙনের কবলে পড়ে। ভাঙনের হাত থেকে ঠেকাতে হলে সেখানে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করে রিং বাঁধ দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলমের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৬৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি পোল্ডারে প্যাকেজের মাধ্যমে বাগেরহাট সদর, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, রামপাল এবং খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলায় মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধ পুন:নির্মাণ করা হচ্ছে। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত গেট নির্মাণ ও মেরামত, নদী ভাঙনরোধ এবং ছোট-ছোট নদী-খাল খনন করা হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে বলেশ্বর নদী পাড়ে বাঁধ ভাঙন রোধে বৃহস্পতিবার উত্তর সাউথখালী এবং বগী এলাকায় বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে। চিশতিয়া শাহিদরবার শরীফের ব্যান্যারে ওই মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে।