গত চারদিন ধরে স্থানীয় এক টিউবওয়েল থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি বেরিয়ে আসছে। ওই পানি পান করলেই মিলবে রোগমুক্তি। সেরে যাবে মহামারি করোনা, দুরারোগ্য ব্যধি ক্যান্সারসহ নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগ! এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় দূর-দূরান্ত থেকে পানি নিতে শত শত মানুষ ভিড় করছেন উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের সাধু গুরু আনারুলের ফকিরের আস্তানায়।
জানা যায়, গত চারদিন ধরে আনারুলের ফকিরের বাড়ির একটি টিউবওয়েলে কোনো বৈদ্যুতিক মটর বা হাতের চাপ ছাড়াই অবিরত পানি উঠছে। তবে এ পানি পান করে কারো রোগমুক্তি হয়েছে কিনা তা কেউ বলতে না পারলেও উপস্থিত সবাই বলছে শুনেছি রোগ ভালো হচ্ছে। আর এ বিশ্বাসকে পুঁজি করে প্রতারণা ব্যবসার ফন্দি এটেছে একটি চক্র।
প্রশাসন বলছে কেউ প্রতারণা করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবানীপুর গ্রামের মাথাভাঙ্গা নদীর পাড়ে এক বটবৃক্ষের নীচে সাধু গুরু রমজান ফকিরের ভক্ত আনোরুল ফকিরের আস্তানা। আর নদীর পাড়েই বসানো আছে একটি টিউবওয়েল। যা দিয়েই চারদিন আগে হঠাৎ আপনা আপনি পানি উঠতে শুরু হয়। এলাকার লোকজন এটিতে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে এবং রোগমুক্তি হবে এ আশায় পান করার জন্য পানি নেয়া শুরু করেন।
রোগমুক্তির প্রচারণা ছড়িয়ে পড়লে ভবানীপুর ও আশপাশের এলাকার লোকজনও পানি নিতে ভিড় জমায়। কেউ আসছেন গোপন রোগ ভালো করার নিয়তে। আবার কেউ আসছেন ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তি পাবার আশায়।
টিউবওয়েলের মালিক আনারুল ফকির বলেন, ‘অটো পানি বের হওয়ার বিষয়টি ছেলেরা মোবাইলে ভিডিও করে ফেসবুকে দেয়ায় এখন লোকজন পানি নিতে আসছে।’
তিনি বলেন, এ পানি খেয়ে শিয়ালা গ্রামের এক ছেলে সুস্থ হয়েছে এমন বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে মানুষ দলে দলে পানি নিতে আসছে।
শুক্রবার বিকালেও বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ভিড় দেখা গেছে। কেউ বা পানি নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউবা ওখানে থেকেই পানি পান করছেন।
কথা হলে পানি নিতে আসা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের গরুড়া গ্রামের মহিদুল জানান, বিভিন্ন ডাক্তার কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়ে ভালো না হওয়ায় তার ও তার ছোট ভাইয়ের গোপন রোগ মুক্তির জন্য পানি নিতে এসেছেন।
চোখে কম দেখেন ভবানীপুরের হাবিবুর। পানি নিতে কাউকে কোনো টাকা না দিতে হলেও ওই পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করলে ভালো হবে মনে করে খাস নিয়তে পানি নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
বিয়ের ১০ বছর পার হলেও কোনো বাচ্চা না হওয়ায় মেয়ের বন্ধ্যাত্ব দূর করতে পানি নিতে এসেছেন গোয়াল গ্রামের বৃদ্ধা চম্পা।
এদিকে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যবসার ফন্দি আঁটছেন অনেকেই। এটিকে অলৌকিক ঘটনা দাবি করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন কেউ কেউ। তাদের দাবি এ টিউবওয়েলের পানি পান করলে রোগ ভালো হবে। অনেকের রোগ ভালো হয়েছে বলেও দাবি করছেন তারা। তবে, পানি খেয়ে রোগ সেরেছে এমন কারো নাম বলতে পারেননি তারা।
কুঞ্জনগর গ্রামের জামে মসজিদের ঈমাম রমজান আলী জানান, এসব কুসংস্কার। রোগব্যাধি ভালো হবার জন্য মানুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিবে। ঝাড় ফুঁক দিয়ে মনের দ্বিধা দূর করানো যায় কিন্তু দেহের রোগ নয়।
মানুষের সমাগমকে কেন্দ্র করে ঘটনাস্থলে বসেছে মেলার দোকান। এসব দোকানে খেলাধুলাসহ মেয়েদের প্রসাধনী ও চুড়ি বিক্রয় করছেন ফেরিওয়ালারা।
অন্যদিকে, টিউবওয়েলের পানি পানে রোগ মুক্তির গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। টিউবওয়েলের পানি পান করাসহ মানুষ এর পানি বোতলে করে নিয়ে যাচ্ছে।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবাইদুর রহমান জানান, ওই স্থানে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য ঘটনাস্থলটি পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে ও সতর্ক করা হয়েছে।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সেলিম শাহনেওয়াজ জানান, ওই টিউবওয়েলের পানিতে রোগ সারাবে এমন প্রচারণা প্রতারণার ফাঁদ মাত্র। জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৌশলীকে পাঠিয়ে টিউবওয়েলটিকে বন্ধ করে দেয়া হবে।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এম রিয়াজুল আলম বলেন, টিউবওয়েলের পানি স্বাস্থ্যসম্মত কিনা পরীক্ষার পর বলা যাবে। টিউবওয়েলের পানিতে রোগ নিরাময় হবে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং এ পানিতে আর্সেনিক থাকতে পারে। এ পানি পান করার পর ডায়রিয়া ও রোটা ভাইরাস ইনফেকশন হলে তা জনগণের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু সালেহ মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, টিউবওয়েলটি মাথাভাঙ্গা নদীর একেবারে পাড়ে। তাই অতিবৃষ্টির কারণে পানির লেয়ার উপরে উঠে গিয়ে কখনও কখনও চাপ ছাড়াই টিউবওয়েল দিয়ে অনবরত পানি বের হয়ে আসতে পারে। যা স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া গ্যাস থাকলেও চাপ বেড়ে গিয়ে পানি বের হতে পারে।
ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে টিউবওয়েলটি শনিবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, এর আগে মেহেরপুর সদর উপজেলার বিশ্বনাথপুরে এক নর্দমার পচাঁ কাদা পানি খাওয়ার ধুম উঠেছিল ওই এলাকায়। ওইসময় এক লোক প্রচার করেছিল সে স্বপ্নে দেখেছে এ পানি খেলে সব রোগ সেরে যাবে।