ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলছে। শুক্রবার(২৮ জুন) দেশসহ বিদেশেও ভোট দিচ্ছেন ইরানিরা। গত মে মাসে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার পর তার উত্তরসূরী নির্বাচনে দেশটিতে ভোট গ্রহণ চলছে।
দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আরও কয়েকজন কর্মকর্তা আজ ভোট দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মোটামুটি এই প্রতিযোগিতাকে ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে দুই কট্টরপন্থী হলেন- সাবেক পরমাণু আলোচক সাঈদ জালিলি ও পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের কালিবাফ। এরপরেই আছেন সংস্কারপন্থী প্রার্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে চাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে রেকর্ড পরিমাণ কম ভোট পড়ার পর শুক্রবারের নির্বাচনে কত সংখ্যক ইরানি ভোট দেবেন তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
৮৫ বছর বয়সি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির রাষ্ট্রীয় সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত থাকলেও প্রেসিডেন্টরা ইরানকে পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাত বা আলোচনার দিকে ঝুঁকতে পারেন।
আরও পড়ুন: হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত: ইরানের প্রেসিডেন্ট-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লাশ উদ্ধার
একমাত্র সংস্কারপন্থী প্রার্থী বলেছেন, তিনি 'ইসরাইল’ ছাড়া সব দেশের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক চাইবেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা একমাত্র সংস্কারপন্থী ভোটের পর সাংবাদিকদের বলেন, 'ইনশাআল্লাহ আমরা ইসরায়েল ছাড়া সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করব।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ে প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারির মধ্যেও পরমাণু সমঝোতায় ফিরে যেতে চাওয়া ৬৯ বছর বয়সি হার্ট সার্জন মাসুদ পেজেশকিয়ান এ মন্তব্য করেন।
২০১৫ সালে বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে দেশটির পরমাণু চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর যারা পশ্চিমাদের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ততা চায় তাদের উজ্জীবিত করতে তার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দিয়েছেন পেজেশকিয়ান। তবে পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কট্টরপন্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তার জন্য অভিশাপ হবে।
ইরাকে ইরানি শ্রমিক, হজযাত্রী ও বন্দিরা বিদেশে ভোট দিয়েছেন
বাগদাদ: ইরাকের ফেডারেল ইরাক ও উত্তরাঞ্চলের আধা-স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি অঞ্চলে অবস্থিত ইরানের ছয়টি কনস্যুলেটে এবং দেশের অন্যান্য এলাকার ভ্রাম্যমাণ ভোটকেন্দ্রে শুক্রবার ভোট দিয়েছেন ইরানি বাসিন্দারা।
ইরাকে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ কাজেম আল-সাদেঘ বলেন, 'আমাদের নির্দিষ্ট কেন্দ্র, কনস্যুলেট এবং ভ্রাম্যমাণ ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এগুলো ইরাকে পরিচালিত কোম্পানিগুলোর (ইরানি) কর্মীদের ভোট দেওয়ার জন্য। এমনকি উপস্থিত কিছু বন্দিও সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে ভোট দিতে পারছেন। আজ নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে চলবে, ইনশাআল্লাহ।’
আরও পড়ুন: ইরানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত যা জানা গেল
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা গেছে, ভোট দেওয়ার জন্য মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।, ভোট গ্রহণের প্রথম দিকে যেসব ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। তেহরানের উত্তরাঞ্চলে পরিদর্শন করা কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই ভিড় দেখা যায়নি।
৪৯ বছর বয়সি শিক্ষক মাহমুদ দারেহেই বলেন, তিনি হার্ট সার্জন মাসুদ পেজেশকিয়ানকে ভোট দিয়েছেন। ‘২০০৫ সালের পর এই প্রথম আমি ভোট দিলাম।’
তিনি আরও বলেন, পেজেশকিয়ান বছরের পর বছর ধরে কট্টরপন্থী সরকারগুলোর সৃষ্ট সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম।
ইরানি ভোটাররা যা বলছেন
ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়া ইরানিদের কেউ কেউ অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে তাদের চিন্তাভাবনা শেয়ার করছেন।
টুসি (সংক্ষিপ্ত নাম) নামের একজন ইরানি বলেছিলেন, তিনি এমন কাউকে ভোট দেবেন ‘যিনি নেতার কথা শোনেন, বিপ্লবী এবং বিপ্লবের নীতির প্রতি অনুগত।’
ভোট গ্রহণে নিরাপত্তা উদ্বেগ নেই: ইরানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট
ইরানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মোখবার ভোট দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক মন্তব্যে মোখবার বলেন, 'নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো নিরাপত্তা উদ্বেগ নেই। ভোটকেন্দ্র ও এর শাখাগুলো যথাযথভাবে স্থাপন করা হয়েছে। দেশে এমনকি দেশের বাইরেও এমন কোনো ভোটকেন্দ্র নেই, যেখানে ভোট গ্রহণ সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানি প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার আশঙ্কা
জনগণকে ভোট দেওয়ার আহ্বান শীর্ষ নেতার
গত মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির স্থলাভিষিক্ত করতে আগাম নির্বাচনে ভোট দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা।
শুক্রবার(২৮ জুন) তেহরানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এই আহ্বান জানান।
নিজের কার্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত একটি মসজিদে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে খামেনি বলেন, 'সন্দেহের কোনো কারণ দেখছি না।’
খামেনি বলেন, বেশি ভোটার উপস্থিতি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জন্য 'অবশ্যই প্রয়োজন'। তিনি এই নির্বাচনকে 'গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরীক্ষা' বলেও অভিহিত করেন।
৬৩ বছর বয়সি রাইসিকে খামেনির একজন শিষ্য এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা পদের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। যিনি শিয়া মতাদর্শের রাষ্ট্রের সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
ইরানে কীভাবে ভোট হয়?
শুক্রবারের নির্বাচনে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সি যেকোনো ইরানি ভোট দিতে পারবেন। সারাদেশে মসজিদ, স্কুল ও অন্যান্য সরকারি ভবনে ৫৮ হাজার ৬৪০টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। একজন ভোটারকে প্রথমে তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হবে এবং একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। তারপরে তারা একটি আঙ্গুল কালিতে ডুবিয়ে ফর্মটিতে একটি মুদ্রণ তৈরি করে। এসময় নির্বাচনি কর্মকর্তারা তাদের আইডিতে স্ট্যাম্প সিল দেয় যাতে তারা দু'বার ভোট দিতে না পারে। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে একজন ভোটার যে প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন তার নাম এবং সংখ্যাসূচক কোড লিখে একটি ব্যালট বাক্সে ফেলে দেন। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। যদিও কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে কমপক্ষে কয়েক ঘণ্টা পরেও ভোট গ্রহণ উন্মুক্ত রাখে।
আরও পড়ুন: রাইসির মৃত্যুতে যেভাবে অস্থির হয়ে উঠতে পারে ইরানের ভবিষ্যৎ
ইরানের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কতটুকু?
ইরানের প্রেসিডেন্টরা চার বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন এবং দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ নেতার অধীনস্থ এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে সর্বোচ্চ নেতার ক্ষমতা আরও জোরদার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে, একজন প্রেসিডেন্ট অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বিষয় উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের নীতিগুলো ঘুরিয়ে দিতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আশীর্বাদে বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেছিলেন। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির নেওয়া কঠোর কৌশলেও খামেনির সমর্থন ছিল।
ইরান কীভাবে শাসিত হয়?
ইরান নিজেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে দাবি করে। শিয়া মতাদর্শ নির্বাচন করে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন পাস করে। তারা জনগণের পক্ষে শাসন করে। তবে, রাষ্ট্রীয় সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নেতার চূড়ান্ত মতামত রয়েছে। সংসদে পাস হওয়া সমস্ত আইনের অনুমোদন গার্ডিয়ান কাউন্সিলে অবশ্যই পাস করতে হবে।
২০০৯ সালে কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের বিতর্কিত পুনঃনির্বাচনের পর যারা ইরানের সবুজ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা এখনো গৃহবন্দি রয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনী শুধুমাত্র সর্বোচ্চ নেতার কাছে জবাবদিহি করে থাকে এবং নিয়মিতই দ্বৈত নাগরিক ও বিদেশিদের গ্রেপ্তার করে এবং তাদেরকে আন্তর্জাতিক আলোচনার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণবিক্ষোভে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর রক্তাক্ত দমন-পীড়ন দেখা গেছে। এদিকে কট্টরপন্থীরা এখন দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। গার্ডিয়ান কাউন্সিল সব প্রার্থীকে অনুমোদন দিয়েছে এবং কখনো কোনো নারীকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেয়নি।
আরও পড়ুন: ইরানের নতুন পার্লামেন্টে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারের ভাষণ