হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দাইফকে লক্ষ্যবস্তু করার দাবি করে শনিবার খান ইউনিসে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৯০ জন নিহত এবং অন্তত ৩০০ জন আহত হয়েছে বল জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
নিহতদের মধ্যে মোহাম্মদ দাইফ ছিলেন কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি, তিনি ও হামাসের দ্বিতীয় কমান্ডার রাফা সালামাকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়।
এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেছেন, শুধু এই দুজন নয়, হামাসের সব নেতাকে হত্যা করাই ইসরায়েলের লক্ষ্য।
কে এই মোহাম্মদ দাইফ
মোহাম্মদ দাইফ ১৯৯০-এর দশকে হামাসের সামরিক শাখা কাশেম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এই ইউনিটটির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও তাকে দায়ী করে আসছে ইসরায়েল।
বেশ কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মোহাম্মদ দাইফ। অতীতে ইসরায়েলের একাধিক হত্যাচেষ্টা থেকে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। এমনকি ইসরায়েলের হামলায় তিনি বর্তমানে পঙ্গু বলে ধারণা করা হয়।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন হামাসের এই শীর্ষস্থানীয় নেতা। এমনকি ইন্টারনেটেও তার খুব বেশি ছবি নেই।
আরও পড়ুন: হামাসের সামরিক শাখার প্রধানকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলা, নিহত ৭১
৭ অক্টোবর সকালে ‘আল আকসা বন্যা’ নামের ওই অভিযানের ঘোষণা দিয়ে দাইফের একটি বিরল ভয়েস রেকর্ড প্রকাশ করে হামাস।
সিনওয়ারের মতো তিনিও ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে ইসলামপন্থী ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি গঠনের পরপরই হামাসে যোগ দেন বলে ধারণা করা হয়।
১৯৮৯ সালে ফিলিস্তিনের প্রথম ইন্তিফাদা বা গণজাগরণের সময় ইসরায়েলি বাহিনী দাইফকে গ্রেপ্তার করে। অবশ্য পরে তাকে ছেড়েও দেয়।
২০০২ সালে কাসসাম ব্রিগেডের তৎকালীন প্রধান ইসরায়েলি হামলায় নিহত হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন দাইফ। তিনি গাজাজুড়ে মাটির নিচ দিয়ে অসংখ্য সুড়ঙ্গ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নায়ক ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া আত্মঘাতী বোমা হামলাসহ বহু ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিককে হত্যার পরিকল্পনার জন্য তাকে দায়ী করে ইসরায়েল।
ছাড়া পাওয়ার পর থেকে দাইফ একেবারে পর্দার আড়ালে চলে গেছেন। তার চেহারা, এমনকি তিনি সুস্থ আছেন কি না, তাও ফিলিস্তিনিদের বেশিরভাগের কাছেই অজানা।
কয়েকটি মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতীতে ইসরায়েলের হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন। আবার অনেকে বলেছে, তিনি হাঁটতে পারেন।
আরবিতে তার নাম ‘দাইফ’ এর অর্থ ‘অতিথি’, যা তার ঘন ঘন স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সার্থক।
মে মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম খান ঘোষণা করেন, তিনি দাইফ, সিনওয়ার ও হামাসের নির্বাসিত সর্বোচ্চ নেতা ইসমাইল হানিয়ার গ্রেপ্তার চান। একইসঙ্গে সেসময় নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্টেরও গ্রেপ্তার চান তিনি।
দাইফের ওপর হামলা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় কী প্রভাব ফেলবে
দাইফকে হত্যা করতে পারলে নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের জন্য তা সর্বোচ্চ বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। অন্যদিকে, হামাসের জন্য তা হবে ব্যাপক মানসিক পরাজয়।
শনিবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন, ‘হামাসের সব নেতাকে হত্যার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। নেতাদের হত্যা করে গোষ্ঠীটির ওপর চাপ বাড়ানো হলে তা যুদ্ধবিরতিতে সহায়ক হবে।’
তাই দাইফকে হত্যা করতে পারলে নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি আলোচনায় আরও ইতিবাচক হতে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
নেতানিয়াহু এর আগেই বলেছেন, ইসরাইল যুদ্ধে তার লক্ষ্য (হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করা) অর্জন না করা পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ শেষ করবেন না।
আরও পড়ুন: ইসরায়েলের হামলা: খান ইউনিসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯০
তবে, দাইফ হত্যাকাণ্ড যুদ্ধবিরতি আলোচনা থেকে হামাসকে সরিয়ে দিতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ এই নেতার মৃত্যু তাদের যুদ্ধবিরতির আলোচনার পরিবর্তে প্রতিহিংসার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষক খালেদ আল-গিন্দি বলেন, ‘ইসরায়েলিদের জন্য এটি তাদের বিজয়ের আখ্যান হতে পারে, যা তারা গত নয় মাস ধরে মরিয়া হয়ে তাড়া করে চলেছে।’
তবে তা হামাসের অবস্থানকে শক্ত করবে বলে মনে করেন আল-গিন্দি।
‘এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়া হামাসের জন্য আত্মসমর্পণেরই সামিল বলে বিবেচিত হবে।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ঢুকে হামাসের হামলায় দেশটির অন্তত ১ হাজার ২০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। সে সময় ২৫০ ইসরায়েলিকে জিম্মি করে নিয়ে যায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র শাসক গোষ্ঠী হামাস। ওই ঘটনার পর থেকে গাজায় ক্রমাগত হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৩৮ হাজার ৩০০-র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।