যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে শনিবার রাজা তৃতীয় চার্লস শপথ নিয়ে মাথায় রাজমুকুট পরেছেন।অভিষেক অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ক্যান্টাবুরির আর্চবিশপ রাজা চার্লসের মাথায় ৩৬০ বছরের পুরাতন ‘সেন্ট এডওয়ার্ডস ক্রাউন’ পরিয়ে দেন। চার্লস সেসময় চতুর্দশ শতাব্দীর রাজসিংহাসনে বসেন।
রাজতন্ত্র বিলুপ্তির মধ্যদিয়ে জন্ম হওয়া আধুনিক ব্রিটেনে প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রাজা তৃতীয় চার্লস বেজওয়েল্ড সেন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট গ্রহণ করেন।
রাজমুকুট মাথায় পরানোর সময় মধ্যযুগের গির্জাটিতে ট্রাম্পেট বাজছিল এবং উপস্থিত জনতা ‘গড সেভ দ্য কিং!’ বলে উচ্চধ্বনি করেছিল।
বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০০ জন বিশ্বনেতা, অভিজাত এবং সেলিব্রিটিসহ দুই হাজারেরও বেশি অতিথি রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে সরাসরি যোগ দেন। কয়েক হাজার মানুষ লন্ডনে বসে এবং বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ টেলিভিশনে সরাসরি অভিষেক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন।
অনুষ্ঠানস্থলের বাইরেও হাজার হাজার সৈন্য, কয়েক হাজার দর্শক ও বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছিল।
আজকের দিনটি উত্তরাধিকারী থেকে রাজা হওয়া পর্যন্ত চার্লসের সাত দশকের অপেক্ষার সমাপ্তির ক্ষণ।
রাজপরিবার ও সরকারের কাছে অভিষেক অনুষ্ঠানটির প্রতীকী নাম ‘অপারেশন গোল্ডেন অরব’।
বিশ্বজুড়ে লক্ষাধিক মানুষ অভিষেক অনুষ্ঠানটিকে স্বাগত জানিয়েছে। কেউ কেউ আবার এ সময়ে এত বড় আয়েজন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
রাজতন্ত্র বিরোধী গ্রুপ ‘রিপাবলিকান’-এর বিক্ষোভকারীরা একটি অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে জড়ো হয়ে ‘নট মাই কিং’- বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন: রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
তাদের দাবি, কারও বিশেষাধিকার এবং বৈষম্যের বিপক্ষে তারা। দেশ দারিদ্র্যের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে এবং সামাজিক বন্ধন ক্রমে আলগা হয়ে যাচ্ছে, এমন সময় এ ধনের আয়োজন বৈষম্যমূলক। এসময় বিক্ষোভস্থল থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১ দশমিক ৩ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে রাজা ও তার স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
তারা পৌঁছানো মাত্র গির্জায় উপস্থিত অতিথিরা হর্ষধ্বনি জানায়। এসময় উপস্থিত ছিলেন- মার্কিন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, আটজন বর্তমান ও প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং জুডি ডেঞ্চ, এমা থম্পসন ও লিওনেল রিচি সহ সেলিব্রিটিরা।
ঐতিহ্যবাহী অ্যাংলিকান সাজসজ্জার সঙ্গে আধুনিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়।
রাজা চার্লস এসময় লাল ও সোনালি পোশাক পরেছিলেন এবং একটি বাইবেলে হাত দিয়ে শপথ নেন যে তিনি একজন ‘সত্যিকারের প্রোটেস্ট্যান্ট’।
তবে রাজ্যাভিষেকের শপথে এবার একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যাতে বলা হয় চার্চ অব ইংল্যান্ড ‘এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইবে যেখানে সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে’।
এদিন কিং জেমস বাইবেলের চিঠিটি প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক পাঠ করেছিলেন; যিনি ব্রিটেনের প্রথম হিন্দু নেতা।
একজন গসপেল গায়ক একটি নতুন রচিত ‘অ্যালেলুইয়া’ পরিবেশন করেছিলেন এবং প্রথমবারের মতো নারী পাদ্রিরা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।
এছাড়া, এবার প্রথমবারের মতো অভিষেক অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ, হিন্দু, ইহুদি, মুসলিম ও শিখ ধর্মের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: কমনওয়েলথ লিডার্স ইভেন্টে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে মতবিনিময় প্রধানমন্ত্রীর
ঐতিহ্য অনুযায়ী চার্লসকে পবিত্র ভূমি অলিভ পর্বত থেকে আনা তেল দিয়ে অভিষিক্ত করা হয় এবং ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি ৪০০ টিরও বেশি মূল্যবান পাথর দিয়ে সজ্জিত সোনার মুকুট রাজার মাথায় পরিয়ে দেওয়ার আগে তাকে একটি তলোয়ার ও রাজদণ্ড দেন।
ট্রাম্পেট বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাজ্যজুড়ে গান স্যালুট করা হয়েছিল।
এক হাজার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ রাজারা এমন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে মাথায় মুকুট পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
৭৪ বছর বয়সে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে ৪০ তম রাজা হিসেবে রাজ্যাভিষেক হলো চার্লসের।
বর্তমানে রাজার আর নির্বাহী বা রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। গত সেপ্টেম্বরে তার মা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজা হন তিনি, তবে এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে চার্লসের ক্ষমতারোহন সম্পূর্ণ হলো।
বর্তমানে রাজা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। চার্লসের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো একটি বহুসংস্কৃতির জাতিকে একত্র করা এবং বিলুপ্তপ্রায় রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জোগাড় করা।
রাজতন্ত্র বিরোধী গ্রুপ রিপাবলিক জানিয়েছে, তাদের দলের প্রধান নির্বাহীসহ ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ বলেছে, দিনটিকে ব্যাহত করতে চাওয়া লোকেদের জন্য ‘খুব বেশি সহনশীলতা’ দেখানোর সুযোগ নেই।
আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে লন্ডনে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী
অন্যদিকে, এদিন বিবাদমান রাজপরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা যায়। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়াম, তার স্ত্রী কেট উইলিয়াম এবং তাদের তিন সন্তান উপস্থিত ছিলেন। উইলিয়ামের ছোট ভাই প্রিন্স হ্যারি, যিনি প্রকাশ্যে পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন, তিনি একা এসেছেন। তার স্ত্রী মেগান এবং তাদের সন্তানেরা ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতেই রয়ে গেছেন।
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে উইলিয়াম তার বাবার গালে চুম্বন করার আগে নতজানু হয়ে রাজার প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
তারপর ওয়েলবি গির্জার সবাইকে রাজার প্রতি ‘সত্য আনুগত্য’ শপথ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান তিনি। এমনকি টেলিভিশনে অভিষেক অনুষ্ঠান উপভোগকারী লোকদেরও রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আমন্ত্রণ জানান।
আজকের ব্রিটেনে বাসকারী মানুষের সঙ্গে চার্লসের মা এলিজাবেথের অভিষেকের সময়কালে বসকারীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ এখন জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী থেকে আসে, ১৯৫০ এর দশকে যা ১ শতাংশেরও কম ছিল। ব্রিটিশ স্কুলগুলোতে ৩০০টিরও বেশি ভাষায় কথা বলা হয় এবং জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম নিজেদেরকে খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দেয়।
তবুও, ইতিহাসের অংশ হতে সারাবিশ্ব ও সারা ব্রিটেন থেকে বহু মানুষ অনুষ্ঠানস্থলে এসেছিল।
লন্ডনের পূর্বে এসেক্সের রাজকীয় অনুরাগী জিল কফলিন বলেন, ‘কেবল ভালবাসা প্রকাশ করা এবং আমাদের রাজা চার্লসকে দেখার জন্য আজ আসা। তিনি আমাদের মূল ভিত্তি।’