২০১২-১৩ মৌসুমে উইম্বলি স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেলে হেরেছিল মার্কো রয়েসের বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। ১১ বছর পর সেই উইম্বলিতেই ফাইনাল হেরে শৈশবের ক্লাব ডর্টমুন্ড থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে তাকে। তবে ফাইনাল ম্যাচে যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও সতীর্থদের তা কাজে লাগাতে না পারার আক্ষেপ তাকে পোড়াবে সারাজীবন। এই আক্ষেপে পুড়বে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ডর্টমুন্ডের লাখো সমর্থকও।
এমন একটি ম্যাচ ডর্টমুন্ড খেলেছে যেখানে তারা দোষারোপ করতে পারে শুধুই নিজেদেরই। নিজেদের কারণেই ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাসে পরিণত হয়েছে এদিন তেজরিচের ডর্টমুন্ড।
চলুন দেখে নিই কীভাবে সহজে জেতা ম্যাচটি কঠিন করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা হাতছাড়া করল ডর্টমুন্ড।
ফিনিশিংয়ে ব্যর্থ
রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলের দারুণ পেশাদার খেলোয়াড়রা ফাইনাল ম্যাচের প্রথমার্ধেই তিনবার গোলমুখ উন্মুক্ত করে দিলেন। সুযোগ বুঝে লম্বা লম্বা অসাধারণ সব পাসে ফরওয়ার্ডদের কাউন্টারে ওঠার সুযোগও করে দিলেন ডর্টমুন্ডের মিডফিল্ডাররা। তবে গোলরক্ষককে একা পেয়ে, এমনকি উন্মুক্ত গোল পেয়েও বল গন্তব্যে পাঠাতে ব্যর্থ হলেন করিম আদেয়েমি-নিকোলাস ফুলক্রুগরা।
ফাইনাল বা যেকোনো হ্যাভিওয়েট ম্যাচে একটি দলের কৌশলের অংশই থাকে- প্রতিপক্ষ দুয়েকটি ভুল করলেও সেটিই কাজে লাগিয়ে ম্যাচে এগিয়ে থাকা এবং পরবর্তীতে তাদের সামনে রক্ষণের দেওয়াল তোলা।
আরও পড়ুন: ‘অপরাজিত’ থেকে ইউরোপের রাজত্ব পুনরুদ্ধার করল রিয়াল মাদ্রিদ
এই কাজের কাজটি করার সুযোগ ডর্টমুন্ডের খেলোয়াড়রা পেয়েছিলেন তিন তিনবার। প্রথমবার হুতাশে ভুল করে ফেললেও পরের দুইবার তাদের সামনে সুযোগ ছিল তা শোধরানোর। কিন্তু না! সেরকম কোনো লক্ষণই দেখা গেল না হলুদ জার্সিধারীদের। ফলে প্রথমার্ধের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে চেনা রূপে হাজির হলো রিয়াল মাদ্রিদ, আর পরাক্রম দেখিয়ে জিত নিল ম্যাচটি।
সুযোগ তৈরিতে অনীহা
এই বিষয়টি রিয়াল মাদ্রিদের ক্ষেত্রেও বলা চলে। শেষের ২০ মিনিট বাদ দিলে একেবারেই ফাইনালোচিত পারফরম্যান্স করেনি দলটি। তবে জয়ে তাদের সেসব ত্রুটি ছাপিয়ে গেছে।
তাই বলে ‘ইউরোপের কিং’ খ্যাত রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ফাইনাল খেলতে গিয়ে গা ছেড়ে খেলা ডর্টমুন্ডের শোভা পায় না। তার খেসারতও তাদের দিতে হয়েছে দিনশেষে।
ম্যাচের প্রথমার্ধে রিয়াল মাদ্রিদ যখন ছন্নছাড়া ছিল, তখনই তাদের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করে একে একে গোল তুলে নিয়ে আসতে পারত জার্মানির দলটি। খুব বেশি চাপ না দেওয়ার পরও রিয়াল তিনবার তাদের সামনে গোলমুখ ফাঁকা করে দিয়েছে।
জর্মান ফুটবল দর্শন কাজে লাগিয়ে ম্যাচটি প্রথমার্ধেই কার্যত একপেশে করে ফেলতে পারত ডর্টমুন্ড। কিন্তু তা করার পরিবর্তে ভিনিসিউস-বেলিংহ্যামদের ঠেকাতে ব্যস্ত ছিল তারা। ফলে বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বেশ কয়েকবার আর রক্ষণাত্মক খেলতে গিয়ে সুযোগও তৈরি করা হয়ে ওঠেনি।
তেজরিচ জানতেন, বিরতির সময় কার্লো আনচেলত্তি তার শিষ্যদের পুনরুজ্জীবিত করে মাঠে পাঠাবেন। কিন্তু তা বুঝে শিষ্যদের আরও আক্রমণাত্মক হওয়ার নির্দেশনা দিতে দেখা যায়নি তাকে।
গেম ডেভেলপমেন্টে ঘাটতি
স্যানচো-আদেয়েমিকে দ্বৈত ভূমিকায় রেখে মাঝমাঠে পাঁচজন খেলোয়াড় খেলালেও বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে বা ভেতরে বল নড়াচড়া করে গোলের সুযোগ তৈরির মতো কাজ করতে দেখা যায়নি ডর্টমুন্ডকে। প্রতিপক্ষেকে প্রেস করে বল দখলে নিলেও উচ্চাভিলাসী লং পাস আর ভুল পাসে বারবার বল হারিয়েছে তারা। ফলে মাঝমাঠ ছেড়ে রক্ষণে মনোযোগী হতে হয়েছে মিডফিল্ডারদের।
আবার তেজরিচের সতীর্থদের মধ্যে সংযোগেরও অভাব ছিল স্পষ্ট। একে অপরের সঙ্গে বলের আদান-প্রদান, একজনের পায়ে বল গেলে পরবর্তী পাসের জন্য অন্যজন সুবিধামতো পজিশনে যাওয়া- ফুটবলের এই বেসিক বিষয়গুলোতেও ঘাটতি ছিল ডর্টমুন্ডের। তাই রিয়াল ঢিলেঢালা রক্ষণকেও ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছেন ব্ল্যাক-ইয়েলোদের ফরওয়ার্ডরা।
কৌশলে ব্যর্থ তেজরিচ
শুরুর একাদশ নির্বাচনে ভুল করেননি ডর্টমুন্ড কোচ এদিন তেজরিচ। রিয়াল মাদ্রিদের শক্তি, সামর্থ্য আর কৌশল বিবেচনায় নিয়েই উপযুক্ত একাদশ সাজান তিনি। কিন্তু ম্যাচ চলাকালে প্রতিপক্ষের কৌশলে পরিবর্তন এলে বা তারা কোনো বিষয়ে দুর্বলতা প্রকাশ করলে সেগুলো থেকে ফায়দা তুলতে নিজের দলের খেলায় অসংখ্যবার পরিবর্তন আনা যেতে পারে। রিয়াল মাদ্রিদ বারবার এমন সুযোগ দিলেও তা কাজে লাগাতে পারেননি ডর্টমুন্ড কোচ। অন্তত মাঠের খেলায় তা-ই দেখা গেছে।
প্রথমার্ধের বিষয়ে তো আলোচনা হলোই, দ্বিতীয়ার্ধেও বেশ কিছু সময়ের জন্য এমন সুযোগ দিয়েছিল রিয়াল। ম্যাচের এক ঘণ্টা পার হলে হঠাৎ করে ঝিমিয়ে যায় লস ব্লাঙ্কোসরা। সেসময় তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে ফায়দা তুলে নেওয়া যেত, কিন্তু তা করেননি তেজরিচ। অথচ প্রথম গোলের পর ঠিক এই কৌশল কাজে লাগিয়েই দ্বিতীয় গোল পেয়ে যান আনচেলত্তি।
ফুটবলে শক্তির চেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল অনেক বেশি কার্যকর হলেও একরকম ‘গোঁড়া’ ফুটবল খেলে হেরেছে তেজরিচের ডর্টমুন্ড।
ব্যক্তিগত ভুলের ছড়াছড়ি
পুরো ম্যাচজুড়ে ব্যক্তিগত ভুলের মেলা বসিয়েছিল ডর্টমুন্ড। এ কারণে যেমন গোল করতে ব্যর্থ হয়েছে দলটি, তেমনই গোল খেয়ে ম্যাচ হাতছাড়া করেছে তারা।
রিয়ালের বক্সের সামনে বারবার এ বিষয়টি দেখা গেছে। দলবদ্ধভাবে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে যেমন বিপদ তৈরি করতে পারেনি জার্মান দলটি, আবার ব্যক্তিগত দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে নিজেই গোল আদায় করে নিয়ে আসবে, এমন কিছুও করে দেখাতে পারেনি দলটির ফরওয়ার্ডরা। তাছাড়া একজন বল নিয়ে এগিয়ে গেলেও বাকিদের তাকে সাপোর্ট দেওয়ার বেলায় দেখা গেছে অনীহা। ফলে বেশ কয়েকটি আক্রমণ শানালেও তা মূলত অকার্যকর হয়ে গেছে।
আবার রক্ষণে অসাধারণ পারফর্ম করলেও মাঝে মাঝেই ভুল পাস দিয়ে বা বলের দখল হারিয়ে দলকে বেশ কয়েকবার বিপদে ফেলেছেন ডর্টমুন্ডের তরুণ ডিফেন্ডাররা। অভিজ্ঞ হুমেলস ও গোলরক্ষক কোবেলের কল্যাণে বেশ কয়েকবার গোল খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলেও শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে ডর্টমুন্ডকে।
পুরো ম্যাচে জেডন স্যানচো, ইউলিয়ান ব্রান্ডট, মার্সেল জাবিৎসারকে নিজেদের ছায়া হয়ে থাকতে দেখা গেছে। ফলে জয়ের বন্দর তাদের কাছ থেকে ক্রমে শুধু দূরেই সরে গেছে।
পরিশেষ
প্রথমার্ধে রেফারি রিয়ালের পক্ষে দুয়েকটি সিদ্ধান্ত দিলেও ডর্টমুন্ডের গোল আটকানো বা রিয়ালকে গোলের সুযোগ করে দেওয়ার মতো পক্ষপাতিত্ব এদিন করতে দেখা যায়নি। রিয়ালের যে পারফর্ম্যান্স ছিল ম্যাচজুড়ে, তাতে কিংবদন্তি মার্কো রয়েসকে শিরোপা জয়ের মাধ্যমে দুর্দান্ত এক বিদায় জানাতে পারতেন তার সতীর্থরা। তবে কৌশলের ভুল আর পারফরম্যান্সের ঘাটতিতে চোখের জলে বিদায় নিতে হয়েছে তার।