রবিবার সকালে রিগনকে সরকারের প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
দুপুরে শেলাবুনিয়া চার্চে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। পরে এ দেশের মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা এই ধর্মযাজককে বাগেরহাট জেলার মোংলায় উপজেলার শেলাবুনিয়া গ্রামের চার্চের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
এর আগে, রবিবার সকাল নয়টা ৩৬ মিনিটে সরকারের একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে করে রিগনের কফিনবন্দি মরদেহ বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা পরিষদ চত্বরে আনা হয়। এসময় বিউগল বাজিয়ে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে বাংলাদেশ সরকার। পরে রিগনের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় সাধারণ মানুষ।
এসময় খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়, মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম, খুলনা ধর্ম প্রদেশের বিশপ রমেন বিশ্বাস, ফ্রান্সিস সুদান হালদার, শেলাবুনিয়া ধর্মপল্লির পালক পুরোহিত শেরাফিন সরকার, ফাদার রিগনের ভাগ্নে মরিনো ক্যাবিস্ত্রো উপস্থিত ছিলেন।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আব্দুল খালেক সাংবাদিকদের বলেন, ফাদার মরিনো রিগন ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি এদেশে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে এসেছিলেন। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি জীবনবাজী রেখে স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এগিয়ে আসেন। তিনি ধর্ম, শিক্ষা, নারী অধিকার,স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা কল্যাণমূখী কাজে নিজেকে সমর্পণ করেন। তার প্রতি মংলাসহ দেশের মানুষ আজ কৃতজ্ঞ। প্রতিবছর তার জন্মদিনে মোংলাতে রিগন মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখাসহ এ দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত মহান এই ব্যক্তি গত বছরের ২০ অক্টোবর ইতালিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফাদার রিগন ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিন্নাভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্রিস্ট ধর্মযাজক হিসেবে তিনি ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে আসেন।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে অবশেষে তিনি মংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে একটি চার্চ ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওই গ্রামেই স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন।
বাংলাদেশে বসবাসের পর থেকে তিনি বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার কৌতূহল ও নিবিড় ভালোবাসার জন্ম হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি, লালনের সংগীত ও দর্শনের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। তার মাধ্যমে ইতালিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন। যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য নিজের প্রতিষ্ঠিত চার্চে গোপনে একটি চিকিৎসাক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। তার এই ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা নিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে পুনরায় রণাঙ্গনে ফিরে গেছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমও ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে ফাদার মারিনো রিগনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং ২০১২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ফাদার মরিনো রিগানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এদেশে সমাহিত করার ব্যবস্থা করে।