ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘যাকে ধরে নিয়ে যান, তাকেই খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন। এভাবে জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না।’
সোমবার (২৯ জুলাই) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়কের অবিলম্বে মুক্তি ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট এ মন্তব্য করেন।
সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী- আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা রিটটি করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও সারা হোসেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন আইনজীবী অনীক আর হক।
রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ শুনানিতে অংশ নেন; তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে সোমবার বেলা দেড়টার দিকে ওই রিটের ওপর শুনানি শুরু হয়।
শুনানির এক পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, ‘টিভিতে দেখেছি, এই ছয়জন (সমন্বয়ক) কাঁটা চামচ দিয়ে খাচ্ছেন।’
এরপর আদালত বলেন, ‘কাউকে আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছেন, সেসবের ছবি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানান মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি কি জাতির সাথে মশকরা নয়? এটি আপনাদের কে করতে বলেছে? ডিবি অফিসে যাকে ধরে নিয়ে যান, তাকেই খাবার টেবিলে বসান। এভাবে জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না।’
আরও পড়ুন: ছয় সমন্বয়ককে 'বিবৃতি দিতে বাধ্য করার' অভিযোগ ভিত্তিহীন গুজব: ডিবি প্রধান হারুন
শুনানির শুরুতে আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের ওপর অবাধে গুলি ছোড়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বিবিসি, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভিডিও ফুটেজ আছে। আমাদের সেনাবাহিনী মাত্র ২০ গজ দূরত্ব থেকে ব্রাশ ফায়ার করেছে। আন্দোলনকারীদের হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
‘স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, (সহিংসতায়) ১৪৭ জনের মুত্যৃ হয়েছে। (আন্দোলন চলাকালে) সরকারি বাহিনীগুলো ছিল সশস্ত্র, বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছিলেন নিরস্ত্র। গত কয়েক দিনের ভিডিও ফুটেজও আমরা দিতে পারব।’
হাইকোর্ট তখন বলেন, ‘বিবিসি বাংলাসহ অনেক বিদেশি মিডিয়া নিউজ বিকৃত করে প্রচার করেছে। সুতরাং ওইসব নিউজ আসলে অকাট্যভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।’
এরপর মানজুর বলেন, ‘স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই ১৪৭ জনের মৃত্যুর কথা বলেছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দুই শতাধিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছে। সেসবের ভিডিও ফুটেজ আছে। ভিডিও ফুটেজগুলো কীভাবে অস্বীকার করবেন?’
আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন শিশুর মৃত্যুর কথা তুলে ধরে মানজুর বলেন, ‘একটি শিশু ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।’
হাইকোর্ট তখন বলেন, ‘এর দায় কার?’
মানজুর বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এটা সরকারের দায়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার কোনো সুযোগ নাই।’
তিনি বলেন, ‘৬ জন সমন্বয়কে ডিবি তুলে নিয়ে গেছে। ডিবি বলছে- নিরাপত্তার জন্যেই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাহলে তাদের দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানো হলো কীভাবে? এখানে সবাই বাংলাদেশের মানুষ; কেউ পাঞ্জাব থেকে আসেনি।’
হাইকোর্ট তখন বলেন, ‘এখানে অনেক রাজনৈতিক বিষয় জড়িত আছে। সুতরাং কোর্ট যেন বিতর্কিত না হয়।’
আরও পড়ুন: আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের
এরপর আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, ‘আমাদের আর্জি হলো তাজা গুলি ছোড়া বন্ধ করা; তাতে প্রাণরক্ষা হবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, সেটাও আমরা চাই না। যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ; তারাও দেশের সম্পদ। অবশ্যই তাজা গুলি (ছোড়া) বন্ধ করা উচিত। আমরা আর একটিও প্রাণহানি চাই না। এরা তো আমাদেরই সন্তান। আন্দোলন দমন করার আরও অনেক উপায় আছে।’
শুনানিতে সারা হোসেন বলেন, ‘যাদের তুলে নেওয়া হয়েছে, বলা হচ্ছে- নিরাপত্তার জন্যে তাদের তুলে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা শাখা বলছে- তাদের গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি, তারা (ডিবি) হেফাজতে আছে। কিন্তু সংবিধানে এমন কোনো সুযোগ নাই, এমনকি কোনো আইনেও নাই। তাহলে তাদের কেন কোনো আদালতে হাজির করা হচ্ছে না বা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না?’
তিনি বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই গ্রেপ্তার নয়। তাহলে এভাবে আটক রাখার ক্ষমতা তারা কোথায় পেল? নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে তুলে নেওয়া যায়- এটা কোথায় আছে? গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া কাউকে তুলে নেওয়ার কথা কোথায় আছে? আমরা কখনো এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। এই ৬ জনের রিলিজ (মুক্তি) চাই।’
এসময় জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যা হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না।’
আদালত তখন বলেন, ‘কোটা সমস্যার তো আপিল বিভাগে সমাধান হয়েছে!’
পান্না বলেন, ‘সমস্যার তো সমাধান হয়নি। একাত্তর সালে দরজার কড়া নেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজা হতো। এখন রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্লক রেইড দেওয়া হচ্ছে। দরজার কড়া নেড়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে- ছাত্র আছে কি না। তাদের মোবাইল কেড়ে নিয়ে চেক (পরীক্ষা) করা হচ্ছে। এটা কি আইনসঙ্গত?’
এদিন রাষ্ট্রপক্ষে প্রথম শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে আইনের প্রয়োগ করবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। যারা রিট আবেদন নিয়ে এসেছেন, তারা নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, বিটিভি, সেতু ভবন, মেট্রোরেলে আর হামলা হবে না? নংসিংদীর জেলে হামলা হয়েছে। সেখানকার বন্দিরা পালিয়েছে। এটা কীসের ইঙ্গিত?’
তখন আদালত বলেন, ‘এ ঘটনার আগে মিছিলে একটি ছেলে গুলি খেয়ে মারা গেছে। তারপর এই ঘটনা ঘটেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একটা মব (নাশকতাকারীরা) গিয়ে সেখানে হামলা করে।’
মেহেদী হাছান বলেন, ‘দেশে যদি নাশকতা হয়, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি আইন প্রয়োগ করতে পারবে না?’
তিনি বলেন, ‘যারা মারা গেছে তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি বেআইনিভাবে গুলি করে থাকে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই রিট আবেদনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমরা দেখতে পেয়েছি, ডিবি অফিসে ৬ জন (সমন্বয়ক) কাঁটা চামচ দিয়ে খাচ্ছেন।’
তখন ডিবির উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। যাকে খুশি ধরে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন, ছবি তুলে আবার সেটি প্রচার করেন।’
এরপর মেহেদী হাসান বলেন, ‘(শুনানির সময়) ওই ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা তো (আদালতে) আসেননি।’
এসময় অনীক আর হক বলেন, ‘আজকে এটা মৌখিক আদেশ দেন।’
আদালত তখন বলেন, ‘মৌখিক আদেশে কোনো কাজ হবে না।’
পাল্টা মন্তব্যে অনীক বলেন, ‘আপনার একটা মৌখিক আদেশ অনেক বড় একটি বার্তা দেবে। অনেক প্রাণ বাঁচবে।’
এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, ‘দুই পক্ষেরই অনেকে হতাহত হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ উপায়ে বল প্রয়োগ করেছে- এই বিষয়টি আবেদনের কোথাও বলা নেই। তারা (রিটকারী) ভিত্তিহীন ধারণার ওপর আবেদনটি নিয়ে এসেছেন।’
আদালত তখন বলেন, ‘যদি ওই ৬ ছাত্রকে আটক না করে থাকে, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (তাদের) আদালতে হাজির করেন।’
মোরশেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে তাদের পরিবার কী বলছে সেটি দেখতে হবে। ২০০ লোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে- এটার প্রমাণ কী?’
শুনানি চলাকালে আদালতের উদ্দেশে অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দেশে শান্তি চাই, সহিংস পরিস্থিতি চাই না। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন নেই, তারপরও আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও সার্বিক দিক বিবেচনা করে একটি আদেশ দেওয়া প্রয়োজন।’
মঙ্গলবার শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন আদালত।