সত্যিকার অর্থে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের সংকট নিরসনে শুধু আগের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনই যথেষ্ট হবে না।
মিন্টু ইউএনবিকে বলেন, আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সচল রাখতে আন্তরিক হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিটি ব্যাংকের জন্য কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
মিন্টু বলেন, ‘১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের ব্যাংকিং খাতের সংকট কাটিয়ে উঠতে ২ ট্রিলিয়ন ডলার তারল্য সহায়তা দিয়েছিল।’ ‘বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য তারল্য সহায়তার ব্যবস্থা করা।’
ব্যাখাটি মার্কিন সরকারের ট্রাবলড অ্যাসেট রিলিফ প্রোগ্রাম, বা টিএআরপি। এর অধীনে ২০০৮ সালে আর্থিক সঙ্কটের শুরুতে ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করার জন্য ৭০০ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: কোম্পানির হিসাব নয়, ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করেছে বিএফআইইউ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক
মাল্টিমোড গ্রুপের সিইও মিন্টু বলেন, 'বাস্তব অবস্থা আপনাদের বুঝতে হবে, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকসহ সব খাত মিথ্যা তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকের টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তাহলে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এসব ব্যাংককে আর্থিকভাবে সচল করার জন্য সবকিছু করবে না?’
তাৎক্ষণিক তারল্য সহায়তা ছাড়া যেসব ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে, সেসব ব্যাংকে আমানতকারীদের আস্থা ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের গ্যারান্টি যথেষ্ট নয়, কারণ অন্যান্য ব্যাংকও এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যের কথা জানে।
মিন্টু জোর দিয়ে বলেন, ‘এসব দুর্বল ব্যাংকের জন্য অনতিবিলম্বে তারল্য সহায়তা প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। কারণ একটি ভালো সিদ্ধান্তও যদি বিলম্বিত হয়, তাহলে তা আরেকটি সংকটের দিকে নিয়ে যাবে এবং সেই সিদ্ধান্ত থেকে যে ভালো ফলাফল বেরিয়ে আসতে পারত সেটিকেও ক্ষুণ্ন করবে।’
নতুন সদস্য নিয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পুনর্গঠনের সমালোচনা করেন তিনি। মিন্টুর চোখে শিক্ষাবিদদের অংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি, অন্যদিকে অভিজ্ঞ ব্যাংকারের অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মিন্টু বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপেক্ষা করুন এবং দেখুন দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাগুলোকে আরও বাড়াচ্ছে, যা নিষ্পত্তিমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি কঠোর, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কিছু পরিস্থিতিতে বিপর্যয় ঘটাতে পারে, কারণ এটি ঋণের হার বাড়ায়, যা শিল্প উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে। ফলস্বরূপ, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতাকে উসকে দেয়, যেটিকে সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখেন মিন্টু।
আরও পড়ুন: ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে জনগণের আস্থা ফেরানোর আহ্বান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের
তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রায় ২৫-২৬ লাখ তরুণ দেশের চাকরিবাজারে প্রবেশ করে, যার মধ্যে কয়েক হাজার সরকারি চাকরি পাওয়ার সৌভাগ্যবান হলেও যুবকদের 'সিংহভাগ অংশ' বেসরকারি খাতে কর্মরত।
বর্তমানে ব্যাংকগুলো শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সাপোর্ট দিতে পারছে না, অনেক ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে পড়ায় এলসি খোলার পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমে গেছে এবং কাঁচামালের সংকট ও নিরাপত্তার অভাবে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শেষ ভরসা বলা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিচ্ছে না। অনেক ব্যবসায়ী ‘এলসি খোলার জন্য হাহাকার’ করছেন, কিন্তু ব্যাংকগুলো এলসি নিচ্ছে না।
‘ব্যবসা কীভাবে চলবে বলে আশা করা হচ্ছে?’ প্রশ্ন তুলেছেন মিন্টু।
তিনি সতর্ক করে বলেন, মানুষ যখন জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারে না, বা জনগণের ক্ষোভের ভয়ে ব্যাংকের শাখা খুলতে পারে না, তখন পরিস্থিতি আরও গুরুতর দিকে প্রবাহিত হয়।
মিন্টু মনে করেন, কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত ব্যাংকগুলোর দায়িত্বে থাকা পরিচালকদের চেয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়ভার বেশি।
তিনি পুর্নব্যক্ত করেন, তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব বাণিজ্যিক ব্যাংককে ঋণ দিচ্ছে না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রবীণ এই ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও শিল্পের জন্য প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ।
মিন্টু বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি প্রণয়নে এক মাসেরও বেশি সময় পার করেছে, কিন্তু আলোচ্য ব্যাংকগুলোর তাৎক্ষণিক তারল্য সহায়তা প্রয়োজন যা তারা এখনও পায়নি।’
সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত লেনদেনে ফিরলেই গ্রাহক বা গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করেন মিন্টু।
‘কেবল তখনই অর্থনীতির চাকা ব্যাংকিং খাতের ট্র্যাকে ফিরে আসার আশা করতে পারে,’ বলে উপসংহারে বিষণ্ণভাবে বলেন তিনি।
মিন্টো বলেন, ‘কিন্তু যদি তারা (সমস্যাগ্রস্থ ব্যাংকগুলো) লড়াই অব্যাহত রাখে তবে কেবল তাদের আর্থিক স্বাস্থ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তারা এই খাতের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি বৃহত্তর অর্থনীতিতে বাধা হিসাবে কাজ করবে।’
আরও পড়ুন: ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও অর্থ পাচার রোধে আইএমএফের কারিগরি সহায়তা চায় বাংলাদেশ: অর্থ উপদেষ্টা