গাজার উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ভয়াবহ খাবারের সংকটে ভুগছে। বলা হচ্ছে অঞ্চলটিতে দুর্ভিক্ষ 'আসন্ন'।
খাদ্য সংকটের তীব্রতা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেককে অভুক্ত থাকতে হবে।
এই প্রতিবেদনটি এমন সময় এলো যখন গাজা উপত্যকায় ত্রাণ প্রবেশ সহজ করে দিতে এবং আরও স্থল ক্রসিং খুলে দিতে কাছের মিত্রদেরও ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি হচ্ছে ইসরায়েল। অন্যদিকে ত্রাণ সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের আকাশ ও সমুদ্রপথে পণ্য সরবরাহ খুবই ধীর গতির এবং কম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক বলেন, আসন্ন দুর্ভিক্ষ 'সম্পূর্ণরূপে মানবসৃষ্ট' কারণ 'ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
এদিকে, গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম হাসপাতাল শিফাতে হামাস সেনারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে এমন দাবি তুলে হাসপাতালটিতে সোমবার ভোরে অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
হাসপাতালের ভেতরে ও এর আশপাশে দিনভর সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল, যেখানে হাজার হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছে, বলছেন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা।
হামাস সেনা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। এসময় তাদের একজন সৈন্যও নিহত হয়েছে। যদিও নিহতদের হামাস সদস্য হিসেবে শনাক্ত করা যায়নি।
ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, নিহতদের মধ্যে গাজার হামাসের পুলিশ বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার রয়েছেন, যিনি ওই হাসপাতালে লুকিয়ে ছিলেন। অন্যদিকে গাজার কর্মকর্তারা জানান, ওই কমান্ডার ত্রাণবাহী গাড়িবহরের সুরক্ষার সমন্বয় করছিলেন।
আরও পড়ুন: বড় বাধার মুখে ফিলিস্তিনের নতুন প্রধানমন্ত্রীর সংস্কারের পরিকল্পনা
শিফা হাসপাতালের ভেতরে ও নিচে হামাস কমান্ড সেন্টার গড়ে তুলেছে এমন দাবি করে গত নভেম্বরে হাসপাতালটিতে সর্বশেষ অভিযান চালিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। কিছু ভূগর্ভস্থ কক্ষের দিকে যাওয়ার একটি সুড়ঙ্গ এবং হাসপাতালের ভিতরে অস্ত্র পাওয়া গেছে বলেও দাবি করেছিলেন তারা। তবে অভিযানে আগে তারা যে পরিমাণ অস্ত্র আছে বলে দাবি করেছিল তার চেয়ে কমই ছিল যে কারণে বেপরোয়াভাবে বেসামরিক নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করার অভিযোগে সমালোচকরা ইসরায়েলি বাহিনীকে অভিযুক্ত করেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হাসপাতালে রোগী, চিকিৎসা কর্মী এবং নিরাপত্তার খোঁজে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া লোকজনসহ প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। যুদ্ধের কারণে গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, হামাসের জ্যেষ্ঠ যোদ্ধারা হাসপাতালে পুনরায় সংগঠিত হয়ে ভেতর থেকে হামলার নির্দেশ দিচ্ছে।
হামলায় নিহতদের মধ্যে গাজা পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ফাইক মাভুহও রয়েছেন বলে দাবি করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, তিনি সশস্ত্র ছিলেন এবং শিফায় লুকিয়ে ছিলেন এবং পাশের একটি কক্ষে অস্ত্র পাওয়া গেছে।
গাজা সরকার জানিয়েছে, মাভুহ উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ সুরক্ষা এবং ত্রাণ গোষ্ঠী ও স্থানীয় উপজাতিদের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
হাগারি বলেন, রোগী ও চিকিৎসা কর্মীরা মেডিকেল কমপ্লেক্সে থাকতে পারেন এবং যেসব বেসামরিক নাগরিক চলে যেতে চান তাদের জন্য নিরাপদ পথের ব্যবস্থা রয়েছে।
ইসরায়েল অভিযোগ করেছে যে হামাস তার যোদ্ধাদের রক্ষা করার জন্য হাসপাতাল এবং অন্যান্য বেসামরিক স্থাপনা ব্যবহার করছে এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বেশ কয়েকটি হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে।
গাজার অর্ধেককে অনাহারের দিকে ঠেলে দিতে পারে রাফাহর আক্রমণ
২০০৪ সালে সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের সময় প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি যা এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার তীব্রতা নির্ধারণের জন্য জাতিসংঘের এক ডজনেরও বেশি সংস্থা, সহায়তা গোষ্ঠী, সরকার এবং অন্যান্য সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তারা গাজায় ক্ষুধা পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি বলছে, গাজার মানুষ পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং প্রায় ৬ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ অর্থাৎ গাজার জনগোষ্ঠীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ সর্বোচ্চ মাত্রার খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। খাদ্যের চরম অভাব এবং তীব্র অপুষ্টির গুরুতর স্তরে রয়েছে তারা। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলেরই প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ রয়েছেন।
এখন থেকে মে মাসের মধ্যে যে কোনো সময় উত্তরাঞ্চলে সরাসরি দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যখন ২০ শতাংশ পরিবারে খাদ্যের চরম অভাব থাকে, ৩০ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভোগে এবং প্রতি ১০ হাজার লোকের মধ্যে কমপক্ষে ২ জন প্রাপ্তবয়স্ক বা ৪টি শিশু প্রতিদিন মারা যায় তখন সেই অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মনে করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম শর্তটি পূরণ হয়েছে এবং দ্বিতীয় শর্তটিও পূরণ হওয়ার 'অত্যন্ত সম্ভাবনা' রয়েছে। শিগগিরই মৃত্যুর হার আরও বাড়বে এবং দুর্ভিক্ষের পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ইসরায়েল যদি দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহতে আক্রমণ চালায়, তাহলে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ (গাজার জনসংখ্যার অর্ধেক) বিপর্যয়কর ক্ষুধা পরিস্থিতিতে পড়বে এবং দক্ষিণাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হবে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ম্যাথিউ হলিংওয়ার্থ বলেন, 'এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে এবং এটি ঘটতে মাত্র পাঁচ মাস সময় লেগেছে।’
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী জেমি ম্যাকগোল্ডরিক উত্তর ও মধ্য গাজাসহ ত্রাণের জন্য 'সব রাস্তা' খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাকে করে যে সহায়তা আনা হয় তার তুলনায় এয়ারড্রপ থেকে সহায়তা 'নগণ্য'।
আরও পড়ুন: যুদ্ধবিরতি আলোচনা থমকে যাওয়ায় গাজায় ত্রাণের জন্য আলোচনায় সমুদ্রপথ
গাজা শহরসহ গাজার উত্তরাঞ্চল ছিল আগ্রাসনের প্রথম লক্ষ্যবস্তু এবং পুরো এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এটি এখন গাজার মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু। অপুষ্টি ও পানিশূন্যতায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ফিলিস্তিনি ইস্যু নিয়ে কাজ করা ইসরায়েলি সামরিক সংস্থার মুখপাত্র শিমন ফ্রিম্যান বলেছেন, ইসরায়েল 'গাজা উপত্যকায় প্রবেশের সব সুযোগ দিচ্ছে এবং দেশগুলোকে সহায়তা প্রেরণে উৎসাহিত করছে।
ইসরায়েলের অভিযোগ, জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সময়মতো ত্রাণ বিতরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, শত্রুতা, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের অসুবিধা এবং আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণে গাজার বেশির ভাগ এলাকায় বিতরণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ডি ওয়াল বলেছেন, ইসরায়েলকে ‘যথেষ্ট হুঁশিয়ারি’ দেওয়া হয়েছে যে, তারা যদি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করা অব্যাহত রাখে, বিপুলসংখ্যক লোককে বাস্তুচ্যুত করে এবং ত্রাণ তৎপরতায় বাধা দেয় তবে এর পরিণতি হবে বিপর্যয়কর।
তিনি বলেন, 'নীতি পরিবর্তন করতে না পারলে এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী হবেন তারা।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, আরও ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি ইসরায়েলের বিষয়। ইসরাইলকে এটা করতেই হবে। এটা লজিস্টিকের প্রশ্ন নয়। এর কারণ এই নয় যে, জাতিসংঘ পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়নি। ট্রাক থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে, আর ল্যান্ড ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, পুলিশের ওপর ইসরায়েলি হামলা জনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ, যার ফলে মরিয়া ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় ত্রাণবাহী ট্রাকে উপচে পড়ছে।
সোমবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি অভিযানে অন্তত ৩১ হাজার ৭২৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাস অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রায় ১২০০ মানুষকে হত্যা করে এবং আরও ২৫০ জনকে জিম্মি করে। গত বছর যুদ্ধবিরতির সময় বাকিদের বেশিরভাগ মুক্তি দেওয়ার পরেও হামাস এখনও প্রায় ১০০ জন জিম্মির পাশাপাশি ৩০ জনের দেহাবশেষ নিজেদের হেফাজতে রেখেছে বলে মনে করা হয়।
আরও পড়ুন: কয়েক মাস ধরে দুর্ভিক্ষের সতর্কতার পর গাজায় বাড়তে শুরু করেছে শিশুদের মৃত্যু