সৌদি আরবে চলতি বছরের হজ চলাকালে মরুভূমির পবিত্র স্থানগুলোতে চরম তাপমাত্রার কারণে ১৩০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।
রবিবার (২৪ জুন) সৌদি কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানয়।
সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহাদ বিন আব্দুররহমান আল-জালাজেল বলেছেন, নিহত ১ হাজার ৩০১ জনের মধ্যে ৮৩ শতাংশই অননুমোদিত হজযাত্রী। তারা পবিত্র নগরী মক্কা ও এর আশেপাশে হজের আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য প্রচণ্ড তাপমাত্রার মধ্যে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আল এখবারিয়া টেলিভিশনকে মন্ত্রী বলেন, ৯৫ জন হজযাত্রীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে রাজধানী রিয়াদে চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, মৃত হাজিদের অনেকের সঙ্গে পরিচয়পত্র না থাকায় পরিচয় শনাক্ত করতে দেরি হয়েছে।
তিনি বলেন, মৃতদের মক্কায় দাফন করা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ৬৬০ জনেরও বেশি মিশরীয় নাগরিক। কায়রোর দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৩১ জন ছাড়া বাকি সবাই অননুমোদিত হজযাত্রী ছিলেন। অননুমোদিত হজযাত্রীদের সৌদি আরব ভ্রমণে সহায়তাকারী ১৬টি ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করেছে মিসর।
সাংবাদিকদের ব্রিফ করার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ নিহতের ঘটনাই মক্কার আল-মুয়াইসেম এলাকার জরুরি কমপ্লেক্সে ঘটেছে। চলতি বছর সৌদি আরবে ৫০ হাজারের বেশি অনুমোদিত হজযাত্রী পাঠিয়েছে মিসর।
সৌদি কর্তৃপক্ষ অননুমোদিত হজযাত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার লোককে বহিষ্কার করে। তবে অনেকেই পায়ে হেঁটে মক্কা ও এর আশপাশের পবিত্র স্থানগুলোতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। তাদের বেশিরভাগই মিশরীয়। অনুমোদিত তীর্থযাত্রীদের বিপরীতে, প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে তাদের ফিরে আসার জন্য কোনৈা হোটেল ছিল না।
শনিবার এক বিবৃতিতে মিসর সরকার জানায়, ১৬টি ট্রাভেল এজেন্সি হজযাত্রীদের পর্যাপ্ত সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে বলা হয়, এসব সংস্থা এক ধরনের ভিসা ব্যবহার করে অবৈধভাবে হজযাত্রীদের সৌদি আরব ভ্রমণের সুবিধা দিয়েছে। এসব ভিসা ব্যবহার করে মক্কা ভ্রমণের অনুমতি দেয় না।
সরকার আরও বলেছে, সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য পাবলিক প্রসিকিউটরকে বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আল-আহরাম দৈনিক জানায়, কিছু ট্রাভেল এজেন্সি এবং হজ ট্রিপ অপারেটররা মিশরীয় হজ প্রত্যাশীদের কাছে সৌদি পর্যটন ভিসা বিক্রি করেছে, যা সৌদি আইন লঙ্ঘন করেছে। হজযাত্রীদের জন্য বিশেষ ভিসা লাগে। এসব সংস্থা প্রচণ্ড গরমে মক্কা ও পবিত্র স্থানগুলোতে হজযাত্রীদের নরকের মধ্যে ফেলে রেখেছে বলে জানিয়েছে পত্রিকাটি।
নিহতদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার ১৬৫ জন, ভারতের ৯৮ জন এবং জর্ডান, তিউনিসিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া ও মালয়েশিয়ার বেশ কিছু সংখ্যক হাজি রয়েছেন। এছাড়া দুই মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) নিজস্ব গণনা অনুযায়ী এ তথ্য জানানো হয়।
বার্তা সংস্থা এপি স্বাধীনভাবে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে না পারলেও জর্ডান ও তিউনিসিয়ার মতো কয়েকটি দেশ এই বাড়তি গরমকে দায়ী করেছে। বিশেষ করে হজের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে প্রচণ্ড গরমে হাজিদের অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখেছেন এপির সাংবাদিকরা। কেউ কেউ বমি করে পড়ে যান।
ঐতিহাসিকভাবে, হজে মৃত্যু অস্বাভাবিক কিছু নয়, যেখানে এ সময় ২০ লাখেরও বেশি লোক পাঁচ দিনের তীর্থযাত্রার জন্য সৌদি আরব ভ্রমণ করে। তীর্থযাত্রার ইতিহাসে পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েও বিপুল সংখ্যক মানুষকে মরতেও দেখা গেছে।
কিন্তু এবারের হিসাব ছিল অস্বাভাবিক রকমের বেশি, যা ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
এপির তথ্য অনুয়ায়ী, ২০১৫ সালে মিনায় পদদলিত হয়ে ২ হাজার ৪০০ হজযাত্রী নিহত হন। সৌদি আরব কখনই পদদলিত হয়ে হতাহতের পুরো মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি। একই বছরের শুরুতে মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে আরেকটি ক্রেন ধসে ১১১ জন নিহত হয়।
হজে দ্বিতীয় সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ছিল ১৯৯০ সালে পদদলিত হয়ে ১ হাজার ৪২৬ জন নিহত হয়েছিল।
সৌদি ন্যাশনাল সেন্টার ফর মেটিওরোলজির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর হজের সময় মক্কা ও শহরের আশেপাশের পবিত্র স্থানগুলোতে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। শয়তানের প্রতীকী পাথর ছুড়ে মারতে গিয়ে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
জলবায়ু পরিবর্তন এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিশেষজ্ঞদের ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ব যদি জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব প্রশমিত করতে সফল হয়, তবুও ২০৪৭ থেকে ২০৫২ সাল এবং ২০৭৯ থেকে ২০৮৬ সাল পর্যন্ত 'চরম বিপৎসীমা' অতিক্রম করা তাপমাত্রায় হজ অনুষ্ঠিত হবে।