জাতিকে স্মার্ট, কুসংস্কারমুক্ত ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ।
'স্মার্ট বাংলাদেশ: দৃশ্যমান উন্নয়ন, বর্ধিত কর্মসংস্থান' স্লোগান নিয়ে বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
ইশতেহারে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। দল ক্ষমতায় ফিরে এলে এসব সম্প্রদায়ের জন্য কী পদক্ষেপ নেবে তার পরিকল্পনা রয়েছে এতে।
ইশতেহারে শুধু আগামী পাঁচ বছরের কথাই বলা হয়নি, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্পও তুলে ধরা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এ রূপকল্পতে বলা হয়েছে, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ইশতেহারে এই বর্ধিত সময়ের মধ্যে এসব সম্প্রদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপসহ একটি স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নির্মূল করা হবে। তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অগ্রাধিকারমূলক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বাংলাদেশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সব সম্প্রদায়ের সমান অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেন। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ এসব সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, স্বায়ত্তশাসন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
উন্নয়ন ও অগ্রগতি
ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের জমি, বাড়িঘর, উপাসনালয় ও অন্যান্য সম্পদ রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সুবিধাবঞ্চিত নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং চাশ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ বিধান ও সুযোগ অব্যাহত।
জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারিত করা হয়েছে এবং সড়ক ও বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাউন্নত করা হয়েছে।
সরকার জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণকে উৎসাহিত করে।
বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য, সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় জাতিগত সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বিভিন্ন ধারা আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে; যাতে স্থানীয়, ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিকল্পিত ও বাস্তবায়ন করা যায়।
তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জনগণের সুবিধার্থে উচ্চ মূল্যের মশলা চাষ, কফি ও কাজুবাদাম চাষ, তুলা চাষ ও সৌরশক্তি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে।
নিজ নিজ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সার্বিক কল্যাণে চলমান কর্মসূচির পাশাপাশি মন্দির, শ্মশান, প্যাগোডা ও গির্জার উন্নয়নে অনুদান অব্যাহত রয়েছে।
আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার
সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই সাংবিধানিক বিধান সমুন্নত রাখার উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্পিত সম্পত্তি আইন সংশোধন করা হয় এবং অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আইন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে।
একটি জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংখ্যালঘুদের জন্য একটি বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে। ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখবে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা নৃশংস হামলা ও বৈষম্যের শিকার হয়। এই সম্প্রদায়ের অনেককে হত্যা করা হয়েছিল, অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং তাদের বাড়িঘর, জমি, ব্যবসা দখল ও লুটপাট করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এসব অমানবিক ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধ করবে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে আওয়ামী লীগ তার নীতি বজায় রাখবে। এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্রে তাদের জীবন, সম্পত্তি, মর্যাদা এবং সমান অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
বস্তি, চর, হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলসহ অনুন্নত এলাকার সুষম উন্নয়ন এবং সেখানকার অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
অবহেলিত সম্প্রদায়
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত। এসব সম্প্রদায় সমাজে অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত। তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও মূলস্রোতে সম্পৃক্ত করতে কর্মসূচি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকারাবদ্ধ।
বেদে ও অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে তারা আয়বর্ধক কার্যক্রমে জড়িত হতে পারে এবং সমাজের মূলধারার সঙ্গে একীভূত হতে পারে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ সহায়তা ও আবাসন কর্মসূচি দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা হবে।
হিজড়া সম্প্রদায়
হিজড়া সম্প্রদায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ছোট অংশ। শুরু থেকেই এই সম্প্রদায় বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত। আওয়ামী লীগ সরকার হিজড়া সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে এবং সমাজের মূলস্রোতে তাদের সম্পৃক্ত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, হিজড়াদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করা হবে। শিক্ষা, আবাসন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য নগদ সহায়তা ও আবাসন কর্মসূচি দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা হবে।