অপরাজেয় বাংলা
অপরাজেয় বাংলা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে নিবেদিত একটি ভাস্কর্য যা তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিত্রায়িত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত এ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অপরাজেয় বাংলা উদ্বোধন করা হয়। ৬ ফুট বেদীর ওপর নির্মিত ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। ভাস্কর্যটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও আক্রমণে পাক বাহিনী পরাজিত হয়। সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের প্রতীকী চিহ্নই ‘অপরাজেয় বাংলা’। ভাস্কর্যটির তিনটি মূর্তির একটি ডান হাতে দৃঢ়প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। অপরাজয় বাংলার এ তিনটি আকর্ষণীয় মূর্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র বাঙালি জাতির সম্মিলিত শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
সংশপ্তক
সংশপ্তক ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সংকল্পের এক অসামান্য সংমিশ্রণের প্রতীক। এর স্থপতি শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। ঢাকার সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এর অবস্থান।
সংশপ্তক ভাস্কর্যটি একজন আহত মুক্তিযোদ্ধার সাহসিকতা ও নিষ্ঠার প্রতীক। ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাওয়া দেশমাতৃকার বীর সন্তানকে।
মূল ভূমি থেকে ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১৫ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি। এছাড়া এটি নির্মাণে লাল সিরামিক ইট ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো সংশপ্তক ভাস্কর্যটি প্রায় ২৮ ফুট লম্বা।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ভাস্কর্যটি সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ গণহত্যার প্রতীক। বিভিন্ন কোণ থেকে সহিংসতা চিত্রিত করার পাশাপাশি ভাস্কর্যটি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছে।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা কীর্তিমান ভাস্কর শামীম সিকদারের অন্যতম সেরা রচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং রোকেয়া হলের মোড়ে অবস্থিত এ ভাস্কর্য অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যোগায়।
রাজু স্মারক ভাস্কর্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে প্রতিষ্ঠিত রাজু স্মারক ভাস্কর্য বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ভাস্কর্য হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ভাস্কর্য নির্মাণে জড়িত শিল্পীরা ছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও গোপাল পাল। এ সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্যটি বেশ কয়েকটি মূর্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
রাজু স্মারক ভাস্কর্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী মইন হোসেন রাজুর স্মৃতির প্রতি নিবেদিত। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় কিছু রাজনৈতিক কর্মীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় রাজু নির্ভীকভাবে রাস্তায় মিছিল করে এবং ক্যাম্পাসে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এ প্রতিবাদের সময় রাজুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ‘রাজু স্মারক ভাস্কর্য’ প্রতিবাদের ভাষার প্রতীক।
স্বাধীনতা সংগ্রাম
স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাসকে ধারণ করে নির্মিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য। শামীম শিকদার ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন।
১৯৯৯ সালে উদ্বোধন হওয়া স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুলার রোডে সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়ক দ্বীপে অবস্থিত।
মূল ভাস্কর্যটিতে কিছু বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ব্যক্তির মুখের প্রতীক এবং এর শীর্ষে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক আমাদের লাল সবুজের পতাকা রয়েছে। মূল ভাস্কর্য স্বাধীনতা সংগ্রামের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বাগানে ১০৩টি ভাস্কর্য রয়েছে।
অমর একুশ
অমর একুশ ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমূলক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভাস্কর্যটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার কাছে অবস্থিত। এর স্থপতি শিল্পী জাহানারা পারভীন। ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যটি প্রথম উদ্বোধন করা হয়। বহু বছর ধরে অসম্পূর্ণ থাকার পর শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে এটি সম্পন্ন হয়। এটি ১৯৫২ সালে আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছিল।
অমর একুশ মনে করিয়ে দেয় ত্যাগ আর অগণিত প্রাণের বিনিময়ে বাঙালির প্রাপ্তি। এ ভাস্কর্যে একজন মায়ের কোলে শায়িত ছেলে এবং পেছনে স্লোগানরত অবস্থায় একজনের প্রতিকৃতি দেয়া হয়েছে। অমর একুশ নিয়ে যায় ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেই দিনে ভাষার জন্য ছাত্ররা মিছিল করেছিল।
মাতৃভাষার সম্মান রক্ষায় বাঙালির অদম্য সাহসের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি ভাস্কর্যটি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর প্রমুখ ভাষা শহীদদের প্রতি সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছে।